বাঘ ও কুকুরের
গল্প
- মলয়কান্তি
দে
কুকুরটা একেবারে বাঘের মতন গর্জায়।
ভয়ে ভয়ে মাথা তোলে বাঘুয়া। এত বড় তিনতলা বাড়িটার ঠিক কোন ঘরে যে এখন আছে
কুকুরটা, ঠাহর করতে পারে না। এক একটা ডাক সোজা এসে ওর কলজেতে কামড় বসাচ্ছে। চাপা
গরগরে ডাক, বুকের ভেতরটা ঝনঝনিয়ে ওঠে সেই ডাকে। একেক সময় যেমন মেঘ ডাকে, চাপা
গুড়গুড় শব্দে লম্বা সময় ধরে, সেই শব্দে কানে তালা লাগে না কিন্তু বাড়িঘরের দরজা জানালা
ঝনঝনিয়ে ওঠে, এ ঠিক সেই রকমের ডাক। কুকুরটাকে অনেকবারই দেখেছে বাঘুয়া। সারা
শরীরে চকচকে কালো লোম, আকারে যেন প্রায় একটা পূর্ণবয়সের বাঘ। বাঘের
মতই রাগী রাগী মুখটা সব সময় হাঁ করে থাকে। গাঢ় লালরঙের পাতলা জিভখানা সারাক্ষণ ঝুলতে
থাকে লকলক করে, দু পাশে ঝিলিক দেয় শাদা শাদা দাঁত। দেখলেই বুকের ভেতর কি যেন খামচা
দিয়ে ধরে। বাঘুয়াকে দেখে কখনও তেড়ে আসে নি, কিন্তু কেমন একটা হেলাফেলার চোখে
তাকায়। সে যে বাঘুয়া, এ বাড়ির বুড়ো কর্তার খাস পেয়ারের মানুষ, কত স্নেহ করেন বুড়ো
কর্তা ওকে, কুকুরটা তবু তাকে একটুও রেয়াত করে না। আর
আজতো মনে হচ্ছে কুকুরটার যত রাগ, যত গরগরানি, সব স্রেফ এই বাঘুয়ারই
জন্যে। ছাড়া পেলেই ছুটে এসে ওর টুঁটি চেপে ধরবে। ভয়ে
একেবারে সিঁটিয়ে যায় বাঘুয়া।
বেলা নিশ্চয় বারোটা হবে। আকাশে খাড়া রোদ। গাছপালার
নীচে ছায়ারা জড়োসড়ো হয়ে আছে। দু তিন জন লোক মিলে বাগানে সাফ সাফাইয়ের
কাজ করছে। কেউ কুটো কাটা সরাচ্ছে। কেউ ঘাস ছাঁটছে। অন্য দুজন গর্ত
খুঁড়ছে, বাঁশের খুঁটি পোতা হবে। ওখানে ম্যারাপ বাঁধা হবে। বাঘুয়া
জানে, আর ক’দিন বাদেই বুড়ো কর্তার নাতির বিয়ে। আত্মীয় স্বজনে বাড়ি এখন ভরে আছে। সকাল
থেকেই নানা লোকের ব্যস্ত আনাগোনা চলছে। একজন
লোক মাটিতে ইলেকট্রিকের তার ফেলে ফেলে এগিয়ে গেল একদিক থেকে আরেক
দিকে। তার পেছনে চলেছে মই হাতে আরেকজন। অন্য সময়
হলে বাঘুয়া এখন সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াত, আগ্রহ নিয়ে সকলের কাজকর্ম দেখত। বাইরের লোকদের
উপর একটু হম্বি তম্বিও করত। হাত চালাও, হাত চালাও। বসে আছো কেন? সে জানে এসব তার
অধিকার। সে বুড়ো কর্তার খাস লোক। তার কথা হল বকলমে বুড়ো কর্তারই কথা। হুঁ হুঁ
বাবা। বাঘুয়াকে ঘাটাতে এসো না।
কিন্তু আজ তার নিজেরই এমন অবস্থা, এই যে বকুল গাছের চিলতে ছায়ায় গুটি সুটি মেরে বসে আছে
বাঘুয়া, পাশ দিয়ে চলে যাওয়া লোকেরা তাকে যেন দেখেও দেখছে না। বাঘুয়ার এই লাল-লাল, ফোলা-ফোলা, জল আটকে থাকা
চোখদুটো, আর তার এই জবু থবু হয়ে বসে থাকা, এতেই যেন সকলের কাছে কিছু একটা বার্তা
পৌঁছে যাচ্ছে। বাঘুয়া ভয় পাওয়া জন্তুর বোবা দৃষ্টিতে জুলজুল করে দেখছে সবাইকে। অন্য
সময় বাড়ির সবসময়ের কাজের লোকেরা বাঘুয়াকে দেখলে দু-একটা কথা
বলত। ওরাও জানে বাঘুয়া খোদ বুড়ো কর্তার মানুষ। কিন্তু আজ ওরাও কিছু একটা বুঝে ওকে পাশ
কাটাচ্ছে। কত দিন ধরে বাঘুয়া মনে মনে হিসেব করেছে, আরেকটা মোচ্ছব
হবে এ বাড়িতে। কত আমোদ করবে সে, ব্যান্ডপার্টির বাজনার সাথে নাচবে। কত খাওয়া দাওয়া
হবে। নতুন কাপড় পাবে। তারপর মোচ্ছব মিটে গেলে মন-ভরানো বকশিস!
কিন্তু মাঝের থেকে কি যে হয়ে গেল। এই যে বেলা দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, কেউ জিজ্ঞেসও
করে নি সে কিছু খেয়েছে কি না। অজান্তেই তার হাত চলে গিয়েছিল গালে। অনেকক্ষণ
ধরেই গালে একটু জ্বালা করছে। বাঘুয়া খেয়াল করে নি। এখন হাত ছোঁয়াতে
জ্বালাটা টের পেল। হাত উল্টে দেখল বাঘুয়া, শুকিয়ে আসা একফোঁটা রক্ত। ছোট-দাদাবাবুর
আঙটি পরা হাতের ঘুষি লেগেছিল গালে। হাড়ের ওপর। চামড়া চিরে রক্ত বেরিয়েছে। দুই চোখে অনেক ক্ষণ ধরে লটকে
থাকা দু ফোঁটা জল এবার যেন ছাড়া পেয়ে ওর কালো পাথুরে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।
মাঝে মাঝেই বাঘুয়ার ভীরু চোখ চলে যাচ্ছে দোতলার বারান্দার দিকে। বুড়ো
কর্তা কখনও এসে এই দোতলার বারান্দায় দাঁড়ান। কখনও চেয়ার পেতে
বসেন। কখনও দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ ফেলেন। আজ শুধু দেখল খুব ফর্সা, চশমা পরা একজন
ছোকরা বাবুকে। মোবাইলে কার সাথে খুব হেসে হেসে কথা বলছে। বাঘুয়া বুঝতে পারে এটাই
বুড়ো কর্তার নাতি। বড় নাতি। বড় দাদাবাবুর বড় ছেলে। এই নাতিরই বিয়ে। কত ছোট দেখেছিল বাঘুয়া আর এখন কত বড় হয়ে
গেছে। একবারই দেখল শুধু। আর যখনই তাকিয়েছে, বারান্দা ফাঁকা। এমনিতে
এ বাড়িতে লোকজন বলতে এক থাকেন বুড়ো কর্তা নিজে, আর থাকে পরিবার নিয়ে তার মেজো ছেলে। তিন
ছেলের বড় এবং ছোট - দুজনেই বউ বাচ্চা
নিয়ে বাইরে থাকে। চাকরি করে। বেশ ভারি ভারি চাকরি তাদের। হাকিম গোছের কিছু হবে
নিশ্চয়ই, বাঘুয়া অতো ভাল বলতে পারবে না। ছোট-দাদাবাবু দু-মাস তিন-মাসে বাড়ি আসে। বউ
বাচ্চাদের কথা বার্তা হাসির শব্দে সেই ক’দিন বাড়িতে একটু লোকজনের আওয়াজ পাওয়া যায়।
বড়-দাদাবাবু আসেন সেই বছরে দু-বছরে। অনেক দূরে থাকেন
বড়-দাদাবাবু, সেই দিল্লি-বোম্বাই। বড় দাদাবাবুকে চোখে পড়লো না বাঘুয়ার। বোধহয় আসেন
নি এখনও, একেবারে বিয়ের দিন হিসেব করে আসবেন। ব্যস্ত মানুষ।
এই বড় দাদা আর ছোট দাদা বাইরে থাকলে বাড়িটা একেবারে নিরিবিলি হয়ে যায়। গিন্নি-মা
মারা গেছেন অনেক বছর হয়ে গেল। বুড়ো কর্তার দেখভালের আলাদা লোক আছে। চা-বাগানের
কাজকর্ম কিছুই এখন বুড়ো কর্তা দেখেন না। সেসব এখন মেজো-দাদাবাবুর হাতে। মেজো-দাদাবাবুর
আরও নানা ব্যবসা আছে। বাঘুয়া সব জানে না। মেজো-দাদাবাবুর কাছে নানা কাজে নানা লোক
আসে দিন ভর। বাঘুয়া তাদের চা-বাগানে কানাঘুষোয় একটা কথা শুনেছে এবার। মেজো
দাদা না কি এবার ইলেকশনে দাঁড়াচ্ছেন। এমেলে হবেন। বাগানের কেউ কেউ তাকেও জিজ্ঞেস
করেছে, তু জানিস নাই? জানে না বাঘুয়া। তবে না জানলেও সে জানার মত করেই মাথা
নেড়েছে। এবং বলেছে, সময় আসুক, বলব সব। সন্ধ্যাবেলা অবশ্য মেজো-দাদাবাবু বড়
একটা বাড়িতে থাকেন না। গাড়ি করে বেরিয়ে যান। কখনও বউ ছেলে মেয়ে সঙ্গে যায়। কখনও
একা। সঙ্গে থাকে মেজো-দাদাবাবুর এই প্রিয় কুকুরটা।
সন্ধ্যাবেলা বাড়ির নীচের তলার বড় হলঘরটায় বড় বড় আলো জ্বলে। তখন বুড়ো কর্তার
কাছে আসেন শহরের নানা মান্য গণ্য লোক। বুড়ো কর্তাকে শহরের লোকেরা খুব
মান্যি করে। খুব ধর্ম-কর্ম করেন বুড়ো কর্তা। মাঝে মাঝে নামঘরে যান। সভা-সমিতিতে
যান। বুড়ো কর্তাকে লোকেরা গোহাইঁদেউ বলে ডাকে, শুনেছে বাঘুয়া। কিছু বলতে গেলে বলে
গোহাইঁ মানু। শুনে শুনে বাঘুয়াও বলতে চেষ্টা করেছিল। তার ঠিক আসে না। সে বুড়ো
কর্তাই বলে। বয়স হয়ে বুড়ো কর্তার চেহারা যেন আরও খুলেছে। ছোটবেলায় দেখা সেই কোট
প্যান্ট পরা পাক্কা বিলিতি সাহেবটি আর নেই। এখন তার রুপোলী চুল
ঢেউ খেলিয়ে ঘাড় অবধি নেমেছে, ধবধবে ফর্সা মুখ, রোদ পড়লে একটু লালচে দেখায়। শাদা
ধুতি আর শাদা পাঞ্জাবিতে তাকে যে কী অপরূপ দেখায়। ঠিক যেন ভগবানের মত।
সেই ভগবানকে একটি বার দেখার জন্যেই সকাল থেকে বাঘুয়ার ভাষাহীন চোখ দুটো
চঞ্চল হয়ে আছে। কতবারই সে ভেবেছে, এই বুঝি দোতলার বারান্দায় হাসি মুখে এসে
দাঁড়াবেন বুড়ো কর্তা। প্রশান্ত দৃষ্টিতে তাকাবেন বাড়ির চারদিকে। আর অমনি বাঘুয়া ছুটে যাবে সামনের উঠোনে, যাতে
বুড়ো কর্তার নজরে আসে। বুড়ো কর্তাকে সে বলবে সব কথা। পুঁছবে,
কেন ছোট দাদাবাবু তাকে মারল। কি দোষ করল সে। আর দোষ যদি কিছু করেছে তো বুড়ো কর্তা নিজের
হাতে শাস্তি দেবেন। জুতো মারবেন দরকার হলে। কিন্তু এই ছোট দাদাবাবু, ছোটবেলা কত
কোলে তুলেছে বাঘুয়া, কত বল খেলেছে, বাঘ সেজে কতবার ছোট দাদাবাবুর নকল বন্দুকের
গুলি খেয়ে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়েছে বাগানের ঘাসে, সেই ছোট-দাদাবাবু ওর গায়ে হাত তুলল?
ওকে ঘুষি মারলো?
মনে খুব লেগেছে বাঘুয়ার। অভিমানে বুকে মোচড় দিচ্ছে। কিন্তু
এই অভিমান স্পষ্ট কোনও দিশা পাচ্ছে না। কারণ নিজেকে নির্দোষ ভাবার তার কোনও
উপায় নেই। ট্রেনের দুলুনিতে শেষ রাতের দিকে তার ঘুম এসে গিয়েছিল। সেই সময় কে তার
বুকে আঁকড়ে থাকা চটের ব্যাগের ভেতর থেকে কাগজে মোড়া, রশি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা প্যাকেটটা
হাপিশ করে দিয়েছে। সে টেরও পায় নি। এটাই তো তার দোষ। সে
তো না বলতে পারবে না। ছোট-দাদাবাবু এত করে বলে দিয়েছিল, খুব সাবধানে নিয়ে যাবি।
খুব দরকারি জিনিষ আছে এতে। বুড়ো কর্তার জন্যে জড়িবুটির ওষুধ। ট্রেনের জেনারেল
কামরায় ওর জন্যে সীটের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ছোটবাবুর অফিসের লোক। কোয়ার্টার থেকে
বেরোবার সময় ছোট-দাদাবাবু নিজে ওর হাতে তুলে দিয়েছিল চটের ব্যাগ। তার ভেতরে ছিল
কাগজের প্যাকেট। বলেছিল সে-ও আসবে ওই একই গাড়িতে, তবে অন্য কামরায়। এমন কি রাতে
একবার যখন কি জানি কোন এক ষ্টেশনে গাড়ি থামলে পরে ছোট-দাদাবাবু জানলা দিয়ে কাগজের
ঠোঙায় করে পুরি সবজি দিয়ে গেল, তখনও তো সে সেই একই ভাবে চটের ব্যাগটা বুকে আঁকড়ে
ছিল। পুরি সবজি খেয়ে হাত ধোবার জন্যেও উঠে যায় নি। কাগজে হাত মুছে জানালা দিয়ে
ছুঁড়ে ফেলেছে। জলতেষ্টা পেলে জল খেতেও যায় নি। কাঠের বেঞ্চে বসে কামরার নানা লোকের
নানা কথা শুনতে শুনতে দিব্যি জেগে ছিল সে। তারপর এক সময় রাত গভীর হল। কামরায়
লোকজনের ওঠা নামা কমে এলো। চারদিকে বসে বসে ঢুলতে থাকা যাত্রীরা
কেউ কেউ ঘুমিয়ে এ ওর গায়ে হেলে পড়ছিল, এসব দেখল বাঘুয়া। কেউ কেউ
শুয়েও পড়েছে কামরার মেঝেতে। কোথাও গাড়ি থামলে বাইরে কারা ছুটে ছুটে যাচ্ছে,
রাতজাগা ভারী গলার ব্যস্ত কথা বার্তার টুকরো কানে এসেছে। তারপর একসময় শেষ রাতের
ঠাণ্ডা হাওয়া এসে গায়ে লাগলে বেশ আরাম হচ্ছিল তার। কখন যে ঘুমে ঢলে পড়েছিল, বুঝতেই
পারে নি।
জাগল যখন তখন চারদিক বেশ ফরসা। জেগেই সে দেখে তার কোলের কাছে নেতিয়ে পড়ে
আছে চটের ব্যাগ। ভেতরের কাগজের প্যাকেটটা নেই। আঁতকে
উঠেছিল বাঘুয়া। প্রায় চিৎকার দিয়ে বলেছিল, প্যাকেটটো
কোথা গেল? শুনে আশপাশের লোকজন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। একজন
ভালমানুষের মত মুখ করে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে? আরে, প্যাকেট ছিল। এই
ব্যাগের ভিতরে প্যাকেট ছিল একটা। কোথা গেল? লোকজন অবাক চোখে ওর দিকে তাকাল। একজন
বলল, কি ছিল প্যাকেটে? দরব ছিল আইজ্ঞা, জড়িবুটির দাওয়াই ছিল।
হামার বুড়া বাবার ওষুধ। বাঘুয়ার গলাটা কান্না কান্না শোনাল। সন্দেহের চোখে ও
চারপাশের লোকজনের দিকে তাকাল। সবাইকেই কেমন ভাল
মানুষ ভাল মানুষ দেখাচ্ছে। আবার মনে হচ্ছে এরাই কেউ ওর ঘুমের মধ্যে ব্যাগটা সরিয়ে
এখন ভাল মানুষ সেজে চোখ পিটপিট করছে। না কি অন্য কেউ প্যাকেট সরিয়ে নেমে পড়েছে
কোনও রাতের স্টেশনে! কিছুই বুঝতে না পেরে বাঘুয়া বেঞ্চের তলা, ওপরের বাঙ্ক তন্ন
তন্ন করে খুঁজতে থাকে। তার মন বলে এক্ষুণি ছোট-দাদাবাবুকে খবরটা দেওয়া দরকার। কিন্তু
কোথায় খুঁজে পাবে ছোট-দাদাবাবুকে। ছোট-দাদাবাবু এই ট্রেনেই আছে, অন্য কামরায়। উঁচা
কামরা সেটা। বাঘুয়া জানে না সে কেমন কামরা। সে কি পারবে খুঁজে বের করতে? অসহায়
ভাবে সে পাশের লোকটির দিকে তাকায়। সেই লোক বলে, তোমার সঙ্গে কে একজন আছে না, যে
তোমাকে রাতে খাবার দিয়ে গেল! যেন ছোট-দাদাবাবুর কাছে পৌঁছবার একটা রাস্তা খুঁজে
পাবে, এমনি আগ্রহ নিয়ে সে বলে ওঠে, হামার ছোট-দাদাবাবু। বুঢ়া বাবার ছোট ব্যাটা। এই
গাড়িতেই আছে। ওপাশ থেকে অন্য একজন বলে ওঠে, আচ্ছা ভাই, তোমার ছোট দাদাবাবু এই একই
ট্রেনে আসছে তো ওর বাবার ওষুধ তোমার হাতে দিল কেন? নিজেই তো সঙ্গে নিতে পারত! এই
প্রশ্নের উত্তর বাঘুয়ার জানা নেই। ওর মনেও আসে নি এমন প্রশ্ন। কাজের কথায়
আবার উল্টে প্রশ্ন করা যায় না কি? কাজ তো যা বলে দেয় সেটাই করতে হয়।
কেন করবে, করে কী হবে, সে প্রশ্ন কি করে কেউ? আর সব চেয়ে বড় কথা, বুড়ো কর্তার কাজ –
এটা শুনলে তো আর কিছুই জিজ্ঞেস করার থাকে না। লোকটির কথার উত্তরে কিছুই বলতে পারে
না সে। আরও যে দু চারজন ঘাড় ঘুরিয়ে এই কথাবার্তা শুনছিল, তাদের একজন তার সঙ্গের
লোকটির দিকে তাকিয়ে কেমন রহস্যময় চোখ ঠারে। বাঘুয়ার নজরে পড়ে সেই চোখ ঠারাঠারি। বুঝলি
কিছু? তারপর গলা নামিয়ে দুজনে খুব ফিসফাস করে। অন্যজন বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ে।
বাঘুয়া কিছুই বুঝতে পারে না। সে শুধু ছোট-দাদাবাবুর সঙ্গে দেখা হলে কী বলবে সেটাই ভাবতে
থাকে।
ট্রেনখানা যেন জোর পাচ্ছে না চলতে। ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চলছে। বাঘুয়া আর অন্য
কারুর দিকে তাকায় না। নিজের ভাবনায় ডুবে যায়। তার অভিব্যাক্তিহীন চেহারায় সেই
ভাবনার কোনও ছাপ ফোটে না। সেই যারা ঠারে ঠোরে কথা বলে ছিল, তাদেরই একজন এবার ওকে
বলে, তোমার ছোট দাদাবাবু কী করে। চাকরি করে আইজ্ঞা। হাকিমের চাকরি। ওরা আবার
নিজেদের মধ্যে কথা শুরু করে। এবার আর তেমন ফিস ফাস নয়। কিছু কথা কানেও আসে
বাঘুয়ার।
... দু-নম্বরি পয়সা। অনেকেই এভাবে পাঠায়।
... কেউ টের পেয়ে টার্গেট করেছিল, বুঝলি? সুযোগ বুঝে হাতিয়ে নিয়েছে।
... ওদের না কি এরিয়া ভাগ করা থাকে,
শুনেছি। নিজের এরিয়ার মধ্যে কাজ সারতে না পারলে অন্য
এরিয়ার লোকদের কাছে খবরটা বেচে দেয়।
... এই ব্যাটা বোধ হয় ডিফু-তে এসে বিক্রি হয়ে গেছে। না-কি ডিমাপুরে, কে
জানে।
...
কথাগুলো কানে আসে, কিন্তু তার বার্তা কিছুই বোধগম্য হয় না বাঘুয়ার। কে
বিক্রি হল, কি করে বিক্রি হল, কিছুই বুঝতে না পেরে শূন্য চটের থলিটাকেই আগের মত যত্নে
আঁকড়ে ধরে সে বাইরের দিকে তাকায়। ছোট-দাদাবাবু বলেছিল সকাল নাগাদ মরিয়ানিতে এসে
গাড়ি ঢুকবে, ছোট দাদাবাবুকে জানালায় দেখতে পেলেই ও যেন গাড়ি থেকে নেমে আসে। মুখের
ভেতরটা তেতো লাগছে। কেমন যেন হাত পা চলছে না বাঘুয়ার। তার মনে হয় মরিয়ানি ষ্টেশনে
এসে ছোট দাদাবাবুকে দেখে ও নামতেই পারবে না। দাঁড়াতেই পারবে না বোধ হয়। গাড়িটা যে
কখন মরিয়ানি ঢুকবে।
কামরা থেকে নামতে যেতেই ছোট-দাদাবাবুর চোখ পড়ল চটের থলির দিকে। এ কি?
প্যাকেট কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে কোনও উত্তর দিতে পারে না বাঘুয়া। পুরোপুরি নামেও নি সে
ট্রেন থেকে। অসহায় দৃষ্টি মেলে ছোট-দাদাবাবুর দিকে তাকিয়ে ছিল। পেছনের লোকের
ধাক্কা খেয়ে এখন একেবারে দাদাবাবুর মুখোমুখি। - আইজ্ঞা, চুরি হইয়ে গেল। কী? এত
জোরে আওয়াজ করল ছোট দাদাবাবু, আর তার সাথে বাঘুয়ার শার্টের কলারের দু পাশে ধরে এমন
জোরে ঝাঁকানি দিল যে, বাঘুয়া পড়েই যাচ্ছিল প্রায়। অনেকটা যেন ঝুলে রইল তার কলারের
ফাঁসে। চারদিকের চলমান ভিড় থেকে কেউ কেউ ঘুরে তাকাচ্ছে তাদের দিকে। দু এক জন
দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। টনক নড়ে ছোট দাদাবাবুর। যেন অনেক কিছু একসাথে বলতে গিয়ে সব কথা গিলে ফেলল ছোট-দাদাবাবু।
চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যেন আগুন গিলে বসে আছে। হিসহিসে গলায় বলল, চল্, বাড়ি চল্।
একটু পরে আবার সামান্য গলা তুলে বলল, এত কষ্ট করে জঙ্গল খুঁজে খুঁজে জোগাড় হয়েছিল
জড়িবুটির ওষুধ। তুই এভাবে হারিয়ে ফেললি? দাদাবাবুর গলা কি একটু নরম শোনাল? কিছু একটা
ভরসায় ও দাদাবাবুর পেছন পেছন হাঁটে। ষ্টেশনের বাইরে ওদের জীপগাড়ি খানা। মেজো-দাদাবাবু
এই গাড়ি করেই বাগানে যান। বাঘুয়া গিয়ে জীপের পেছনে ওঠে। ছোট-দাদাবাবু গাড়ি স্টার্ট
দেয়। যোরহাটের বাড়ি অবধি গাড়িখানা এত জোরে চালায়
যে পিছনের সীটে বসে বারবার এদিক ওদিক হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল বাঘুয়া। গেটের ভিতরে এসে
গাড়ি থামে। গাড়ি থেকে নামতে ভয় পাচ্ছিল বাঘুয়া। ছোট-দাদাবাবু আবার তার কলার ধরে টেনে
হিঁচড়ে নামায় ওকে। টানতে টানতে নিয়ে যায় নীচের
তলার বারান্দার পাশের ঘরখানায়। তারপর দরজা
বন্ধ করে দেয়।
ঘরের ভেতর একটা সোফায় বসে ছিল মেজো-দাদাবাবু। এভাবে ওদের ঢুকতে দেখে উঠে
দাঁড়ায়। কী হয়েছে?
ছোট-দাদাবাবু উত্তর না দিয়ে ওকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলার মত করে ছুঁড়ে দেয়। টাল
সামলাতে না পেরে বাঘুয়া মাটিতে উবু হয়ে বসে পড়ল। তারপর
যা তাকে জীবনে করতে হয় নি কখনও, কিন্তু যা তার রক্তের ভেতর
ছিল, সেই রক্ত-বাহিত অভ্যাসে দু-হাত জোড় করে কান্না কান্না গলায় বলে উঠে, হামি
কিছু জানি না দাদাবাবু।
- তুই
জানিস না কিছু? বল কাকে দিয়েছিস।
- আইজ্ঞা
শেষ রাইতে চোখ লেগে গেল আর...
কথা শেষ করতে পারে না বাঘুয়া। কলার টেনে তাকে দাঁড় করিয়েই মুখে ঘুষি চালিয়ে
দেয় ছোট দাদাবাবু। হাউ হাউ করে ডুকরে কেঁদে ওঠে বাঘুয়া। মেজো দাদাবাবু এবার ব্যস্ত
হয়, আস্তে, আস্তে। এখন আর কেলেঙ্কারি বাঁধাস না।
ঘুষি খেয়ে মেঝেতে বসে পড়ে বাঘুয়া।
কান্না কান্না মুখে দু ভাইয়ের মুখের দিকে নির্বোধ দৃষ্টি মেলে তাকাতে থাকে। মেজো-দাদাবাবু
জিজ্ঞেস করল, কত ছিল? ছোট দাদাবাবু উত্তর না দিয়ে পলকহীন চোখে তাকাল মেজো
দাদাবাবুর দিকে। তাকিয়েই থাকল। মেজো দাদাবাবুও তাকিয়ে ছিল ভাইয়ের চোখে। এক সময় চোখ
সরিয়ে বাঘুয়ার দিকে তাকালো। ছোট-দাদাবাবু
বলে, আমার হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। গাধাটাকে বিশ্বাস করে এমন ভুল হল!
- মেজো-দাদাবাবুর
মুখ থমথম করছে। চাপা গলায় বলে, ইলেকশনে কী হবে তা হলে?
- আর
ইলেকশন। আমার যে কী গেল সে আমিই জানি।
- গেল
তো আমার। দরকার তো আমারই ছিল।
ছোট-দাদাবাবু রেগে উঠে কি বলতে যেতেই মেজো দাদাবাবু বলে উঠল, এই শোন, আগে
এটাকে বের কর। বাজারে ঢোল পেটাস না।
তারপর নিজেই বাঘুয়াকে ধরে দাঁড় করিয়ে বলেন, তুই বাইরে যা তো এখন। সাবধান,
কোথাও যাবি না কিন্তু। বাড়িতেই থাকবি। না পেলে পুলিশ ডাকব।
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে এখানে কিছুক্ষণ, ওখানে কিছুক্ষণ, এভাবে নানা জায়গায় বসে
থেকে থেকে রোদ চড়া হতে বাঘুয়া এসে আশ্রয় নিয়েছে এই বকুল গাছের তলায়। তখনই কুকুরটার
ডাক শুনতে পেয়েছিল। আর এই প্রথম কুকুরটাকে ভয় করতে থাকে তার। জীপগাড়িখানা ঢোকার
সময় বাগানের মালী গেট খুলে দিয়েছিল। সে দেখেছে ছোট-দাদাবাবু কি ভাবে বাঘুয়াকে টেনে
হিঁচড়ে নিয়ে ঘরে ঢোকালো। বেরিয়ে আসার পর মালিটাকে
আর চোখে পড়ে নি বাঘুয়ার। তবে ওর থেকেই কথাটা পাঁচকান হয়েছে নিশ্চয়। তাই অন্য কাজের
লোকেরাও বাঘুয়ার কাছে ভিড়ছে না। আনমনে আবার গালে হাত বোলায় বাঘুয়া। পেটের ভুকটা
এখন খুব জানান দিচ্ছে।
কুকুরটা আবারও ডাকছে। আর সেই দাকের সঙ্গে এবার বাঘুয়ার মনে
ছোট-দাদাবাবুর চেহারাটাই ভেসে উঠল। ছোট-দাদাবাবুর
রেগে ওঠা মুখটা যেন কুকুরের মুখের সাথে মিলে যাচ্ছে। চাপা স্বরের কথাগুলো যেন কুকুরটার
গরগরানি। কানে আছড়ে পড়ছে কুকুরের ডাক, আর চোখ বন্ধ করে বাঘুয়া দেখতে পাচ্ছে ছোট-দাদাবাবুকে। পেছন
থেকে উঁকি দিচ্ছে মেজো-দাদাবাবু।
ট্রেনের সেই লোকটির কথা মনে পড়ে যায় তার। তোমার ছোট দাদা-ই তো ওষুধটা সঙ্গে
নিয়ে আসতে পারত। যেন নিজের স্বপক্ষে একটা যুক্তি খুঁজে পায় বাঘুয়া। ঠিকই তো। এত
কষ্ট করে জোগাড় করা ওষুধ ছোট দাদাবাবু কেন নিজের কাছেই রাখল না? যেন বুড়ো কর্তাকে
পেলে এ নিয়েই নালিশ জানাবে বাঘুয়া। তার দোষ কোথায়, দোষ তো সব ছোট-দাদাবাবুর। ভেবে
মনটা একটু শান্ত হয় বাঘুয়ার। বেলা ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। শরীরটা
ঝিমিয়ে আসছে। গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়েই পড়েছিল বাঘুয়া।
- আরে
বাঘ বাহাদুর যে!
পরিচিত গলার আওয়াজে ঘুমের চটকা কেটে যেতে চোখ খুলে এদিক ওদিক তাকায় বাঘুয়া।
আর তখনি যাকে সামনে দেখে, তাকে দেখে আনন্দে আপ্লুত হয় সে। জামাই-দাদাবাবু! তার
মানে কলকাত্তার দিদিরা এসে গেলেন? কখন এলেন? এই আমুদে লোকটাকে দেখলে সব সময়ই আনন্দ
পায় বাঘুয়া। সমস্ত দুঃখ কষ্ট সরে গিয়ে তার মুখের শক্ত, রেখা-বহুল চামড়ায়, তার
ঘোলাটে চোখ দুটোয় খুশি ঝিলিক দিল। এগিয়ে গেল সে জামাই-দাদাবাবুর দিকে। একটাই শব্দ
উচ্চারণ করতে পারল, আইজ্ঞা!
- কেমন
আছো, বাঘ বাহাদুর?
উত্তরে কিছু একটা বলতে গিয়েও শব্দ যোগায় না বাঘুয়ার মুখে। মাথাখানা
প্রবলভাবে এপাশ ওপাশ ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দেয়, ভাল আছে। জামাই-দাদাবাবুর টুকটাক কথার
উত্তরে শরীরটা নানা ভাবে দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে তার ভাব প্রকাশ করে। যেন শরীরের এই সব
ভঙ্গীই তার ভাষা। তখন তার মনেও পড়ল না সকাল থেকে যা হয়ে গেছে তার সঙ্গে। ওর মুখের
দিকে তাকিয়ে কিছু কি বুঝল জামাই দাদা?
- কি
হয়েছে তোমার বল তো? গালের ওপর রক্ত শুকিয়ে আছে, মুখটাও কেমন শুকনো দেখাচ্ছে?
বাঘুয়ার মনে হল ও কেঁদেই ফেলবে। নানাভাবে মাথা নাড়িয়ে বোঝাতে চাইল, কিছুই
হয় নি। জামাই দাদা কি বুঝল কে জানে। তার মুখে চিন্তার ছায়াটা জেগেই রইল।
- ঠিক
আছে। ভালো থাকলেই ভালো।
পাজামা পাঞ্জাবি পরা জামাই দাদা চলে গেল বাগানের অন্য দিকে। ঘরে বেশীক্ষণ
থাকে না জামাই-দাদা। বেরিয়ে যায় এদিকে সেদিকে। এমন কি বাড়ির
গাড়িটাও চড়তে চায় না। রিক্সা নিয়ে বেরোয়। বুড়ো কর্তার
একমাত্র মেয়েটি, পড়তে গিয়েছিল দিল্লি না কোথায়। সেখানে এই দাদার সাথে পরিচয়। ভাব
হয়ে যায় দুজনের মধ্যে। তারপর বিয়ে। জামাই-দাদাবাবুটি ঠিক এ বাড়ির লোকের মত নয়। কেমন
যেন কাছের মানুষ বলে মনে হয়। কানাঘুষোয় শুনেছে বাঘুয়া, এই বিয়েতে বুড়ো কর্তার মত
ছিল না। এদের মতো বড়লোক নয় জামাই-দাদার পরিবার। সেই জন্যেই বোধ হয় এর ব্যবহারে
ঠাট-বাট কম। বাঘুয়া ভাবে।
বাঘ বাহাদুর। এই নামে আর কেউ ওকে ডাকে না। বাঘুয়া নামটা অবশ্য টিকে গেছে।
সেটাও তো তার পাওয়া নাম। সেই কবে ছোকরা বয়সে একটা বাঘ মেরে ফেলেছিল সে। সেই থেকে
তার মা-বাপের দেওয়া নামে আর কেউ ডাকে না ওকে। সে হয়ে গেল বাঘুয়া। ইনাম দিয়েছিলেন
বুড়োকর্তা। তখন তো আর বুড়োকর্তা বুড়ো ছিলেন না, বাঘুয়ারা বলত মালিক বাবা। তাকে
বানিয়েছিলেন নিজের খাস লোক। এমনিতে বাগানের নিত্যকার কাজ যা আছে তা করত, তবে মালিক
বাবা বাগানে এলে বাঘুয়ার কাজ ছিল সব সময় তার কাছে কাছে থাকা। ভিড় জমলে সে একা হাতে
ভিড় সামলাতো। কাউকে মালিক বাবার কাছে ঘেঁষতে দিত না। মালিক বাবা বসতে চাইলে চেয়ার
এগিয়ে দিত। গাড়িতে উঠবেন তো দরজা খুলে দিত। এমন কি মালিক বাবা কাছাকাছি অন্য
বাগানে গেলেও বাঘুয়ার ডাক পড়ত। সব বাগানের লেবারদের মধ্যেই ছড়িয়ে গিয়েছিল তার বাঘ
মারার গৌরবগাঁথা। সেটা বেশ কাজে লাগত এই ভিড়
নিয়ন্ত্রণে। লেবাররা সমীহ করতে শিখেছিল তাকে। আস্তে আস্তে মালিক বাবার বয়স হয়ে
গেলে বাগানে আর বেশী আসতেন না। তখনও মাঝে মাঝে তার ডাক পড়ত যোরহাটের
বাড়িতে। বাগান থেকে সাইকেল চালিয়ে গিয়ে হাজির হত বাঘুয়া। আজকাল তেমন আর ডাক পড়ে
না। তবু মাঝে মাঝে সে নিজে থেকেই গিয়ে হাজির হয়। একবার বুড়ো কর্তার
সঙ্গে দেখা হলে, বুড়োকর্তার দু একটা কথা শুনলে তার মন ভাল হয়। এবারও ডাক পড়েছিল। এসে
শুনল, বুড়োকর্তা নয়, এবার ডেকে পাঠিয়েছে ছোট-দাদাবাবু। তারপর
তো ছোট-দাদাবাবুর সঙ্গে তার কাজের জায়গায় যাওয়া। আর এই ট্রেনে করে ফিরে আসা। আর এই
ফিরে আসার পথে অতো বড়ো একটা কাণ্ড ঘটে যাওয়া। বড় একটা শ্বাস ফেলে বাঘুয়া। জামাই-দাদাবাবুর
সঙ্গে দেখা হতে মনটা যেমন হাল্কা হয়ে গিয়েছিল, এখন আবার বুক খানা ভারী হয়ে যায়।
বিয়ের পরে এ বাড়িতে এসে জামাই-দাদা কারও কাছ থেকে শুনে ছিল তার বাঘ মারার বৃত্তান্ত। সেই
থেকে নাম দিয়েছে, বাঘ বাহাদুর। একমাত্র জামাই-দাদাই এখনও মনে
করিয়ে দেয় তার বাঘ মারার ইতিহাস। বাকিরা তো বোধ হয় ভুলেই গেছে। এমনকি
বুড়ো কর্তারও কি মনে আছে, সে যে একদিন একটা বাঘ মেরেছিল, সে যে বাঘুয়া! শরীরটা আর
টানতে পারছে না সে। ইচ্ছে করছে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় বলে আবার
বকুলের গোড়ায় পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করল বাঘুয়া।
- এই
বাঘুয়া, তোকে ছোট দাদাবাবু ডাকছে।
ডাক শুনে যখন চোখ খুলল বাঘুয়া, তখন বেলা পড়ে গেছে। ছায়া নেমেছে চারদিকে। শুধু
বাড়ির পেছন দিককার একটা উঁচু গাছের মগডালে হাল্কা রোদ লেগে রয়েছে তখনও। তড়াক
করে উঠে দাঁড়াল সে। পা বাড়াতে গিয়েই আবার তার ভয়টা ফিরে এলো। আবার
মারবে ছোট-দাদাবাবু? ভয়ে ভয়ে পা ফেলে আবার সে সেই বারান্দার লাগোয়া ঘরটাতে ঢোকে।
দুটো আলাদা সোফাতে ছোট ও মেজো দাদাবাবু বসে আছে। কেউই
কোনও কথা বলল না। বাঘুয়া পালাক্রমে দুজনের দিকেই তাকায়। কী করবে বুঝতে পারে না।
তারপর এক সময় মেজো-দাদাবাবুই বলেন,
- সত্যি
করে বল, কারা সরিয়েছে প্যাকেট।
- আইজ্ঞা,
হামি কিছু জানি নাই। ঘুম আসে গেল চোখে, আর কুছু নাই জানলাম।
ছোট-দাদাবাবু সোফা ছেড়ে উঠে আসে মারমুখো হয়ে। আর কুকুরটার কথা মনে করে
বাঘুয়া দু হাত বুকে এনে জড়ো করে।
- তুই
জানিস, আমার কত বড় সর্বনাশ করে দিলি? শালা জানোয়ার!
আবার কান্না পেয়ে যায় বাঘুয়ার। বলতে ইচ্ছে করে, ওতো দামের ওষুধ আপনি কেন
নিজের কাছে রেখে দিলেন না দাদাবাবু? বলা হয় না। ভাষা যোগায় না মুখে। হাউ মাউ করে
কিছু একটা বলে যার একটি বর্ণও বোধগম্য হয় না। মেজো-দাদাবাবু এবার বলে, শোন, তুই
বাগানে চলে যা। কারো সাথে কোনও কথা বলবি না। যখন খবর দেব, চলে আসবি। মনে রাখিস,
এটা কিন্তু পুলিশ কেস। বাধ্য ছেলের মত মাথা নাড়ে বাঘুয়া। মেজো-দাদাবাবু দরজা খুলে
দেয়। আর সারা দিন যাকে এক ঝলক দেখার জন্যে বাঘুয়ার প্রাণ আঁকু পাঁকু করছিল, সেই
বুড়ো কর্তা কি না একেবারে দরজার সামনে! বুড়ো কর্তা খোলা দরজা দিয়ে এক পলক দেখলেন
জবু থবু হয়ে থাকা বাঘুয়াকে, আর তারপর ছোট ও মেজো দুই ভাইকে দেখলেন। দুই ভাইয়ের
কেউই সরাসরি বাবার দিকে তাকাচ্ছিলো না। অন্য দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পাথরের মত
দাঁড়িয়ে ছিল। বাঘুয়া তার কান্না কান্না
চোখে একবার বুড়ো কর্তাকে আর একবার দুই ভাইকে দেখছিল। তার ইচ্ছে হচ্ছিল এক্ষুণি
গিয়ে বুড়ো কর্তার পায়ের কাছে পড়ে। কিন্তু দুই ভাইয়ের উপস্থিতিতে সেরকম সাহস হল না।
বুড়ো কর্তা কি বুঝলেন কে জানে, যা বুঝলেন তা নিজের মধ্যেই রেখে স্বাভাবিক ধীর পায়ে
বারান্দা থেকে নামলেন।
একটু ক্ষণ অপেক্ষা করে মেজো-দাদাবাবু বাঘুয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, এবার যা।
বাঘুয়া পায়ে পায়ে ঘর থেকে বেরোয়। বারান্দা থেকে উঠোনে নামে। তার পর ভীরু পায়ে গেটের
দিকে এগোয়। তার পেছনে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। এতক্ষণে গেটের দু পাশে দুটো শাদা আলোর
ডোম জ্বলে উঠেছে। শুভ্র আলো ছড়াচ্ছে সেগুলো থেকে। মন ভালো করা আলো। গেটের দিকে
এগোতেই বাঘুয়ার নজর পড়ে, সামনে বুড়ো কর্তা। সেই শাদা ধুতি পাঞ্জাবি, ফর্সা পায়ে
দামী চকচকে চামড়ার জুতো, সেই ঘাড় পর্যন্ত লম্বা কোঁকড়ানো রুপোলী চুল, সেই ভগবানের
মত চেহারা। আর কিছু ভাবতে পারে না বাঘুয়া। ছুটে গিয়ে বুড়োকর্তার সামনে মাটিতে বসে
পড়ে। আবারও সে অনেক কিছু বলার চেষ্টা করে। তার সব শব্দ জট পাকিয়ে দুর্বোধ্য কিছু
আওয়াজ বেরোতে থাকে মুখ দিয়ে। তার দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন বুড়ো
কর্তা। কি যেন ভাবেন মনে মনে। তার দুই চোখে এবং মুখের চামড়ায় করুণা ও প্রশান্তির
ছাঁচ অটুট। একটু সময় তাকিয়ে থাকেন বাঘুয়ার ্দিকে।
তারপর আবার চোখ তুলে তাকান সেই ঘড়টার দিকে, যেখানে দুই ছেলের সঙ্গে বাঘুয়াকে
দেখেছিলেন একটু আগে। তারপর বাঘুয়াকে পাশ কাটিয়ে পা বাড়ান। তার মুখে অম্লান থাকে
করুণা ও প্রশান্তি। তাঁর চলে যাওয়া ফর্সা পা দুটির দিকে তাকিয়ে বাঘুয়া তখনও তার
সেই দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বলেই চলেছে। ভগবান ফিরে তাকালেন না।
দোতলার জানালা দিয়ে গোটা দৃশ্যটি দেখছিল জামাই-দাদা। চাপা
উচ্চারণে বলে ওঠে, - বাঘটা শালা কুকুরের মত কুঁই কুঁই করছে দেখো।
(উজান, তিনসুকিয়া, ২০১৫)
No comments:
Post a Comment