Tuesday, 12 January 2016

লেম



                                                   লেম  
                                                          মলয়কান্তি দে

          মাত্র তিনদিনের ছুটি নিয়ে করিমগঞ্জ গিয়েছিল উৎপল। পৈত্রিক বাড়ির ভাগ বাঁটোয়ারা সংক্রান্ত  ব্যাপার,  দাদা খবর দিয়েছিল একটু আলাপ আলোচনার দরকার আছে। কাজটা জরুরী। তাই এই তিনদিনের সময় বের করতেই হল। নইলে আজকাল আর করিমগঞ্জ যাওয়ার কথা ভাবতে পারেনা।  সময় বের করাই মুশকিল, তার ওপর রাস্তার যা অবস্থা, সব উৎসাহে জল ঢেলে দেয়। 

উৎপল আর নবারুণ চাকরিসুত্রে গৌহাটি এসে গৌহাটিরই বাসিন্দা হয়ে গেছে। দুজনেরই বাল্যকাল থেকে শুরু করে স্কুল জীবন, কলেজ জীবন, এমনকি চাকরি জীবনেরও অনেকখানি কেটেছে করিমগঞ্জে। দুজনেরই অজস্র স্মৃতি ছড়ানো ঐ শহরে। যেতে ইচ্ছে করলেও চট করে যাওয়া  হয়না। গেলেও খুব যে বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডা হয় তা নয়। গৌহাটি হোক আর করিমগঞ্জ হোক, সবখানে সবাই নিজের নিজের রুটিনের জালে আটকা পড়ে গেছে। নিয়মিত কোনও আড্ডার অবকাশ আর নেই। তবু উৎপলদের মত ভিন শহরের বাসিন্দা হয়ে যাওয়া কেউ কেউ এলে, করিমগঞ্জের বন্ধুরাও একটু সময় বের করে নেয় আড্ডার। গৌহাটিতেও উৎপল নবারুণরা মাঝে মাঝে এর বা ওর বাড়িতে আড্ডায় বসে। তখন তাদের আলাপচারিতার অনেকখানি দখল করে রাখে করিমগঞ্জ। যাবার আগের দিন উৎপল নবারুণকে টেলিফোনে জানিয়েছিল, কাল যাচ্ছি করিমগঞ্জ। শুনে নবারুণ বলেছিল, বাঃ, যা, ঘুরে আয়। ফেরার পর আসিস।  করিমগঞ্জের গল্প শুনব।

এবারও বন্ধুদের সঙ্গে তেমন আড্ডার সুযোগ ছিলনা। জমি-বাড়ি সংক্রান্ত কথাবার্তার ফাঁকে দু-একজনের সাথে বড়োজোর দেখা করা যাবে, এমনটাই ভেবেছিল উৎপল। সেই মত করিমগঞ্জে পৌঁছনর দ্বিতীয় দিন, সন্ধ্যাবেলা তথাগতর বাড়ি গিয়েছিল। রাত ন’টা অবধি গল্প করে বাড়ি ফিরেছে। খাওয়া দাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে একটা লিটল ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিলকরিমগঞ্জ থেকে বেরোয় পত্রিকাটা, উৎপল আগে দেখেনি। পরিচিত দু-একজনের সাথে অনেক অপরিচিত লেখকের লেখা। রাত বারোটা নাগাদ আবার তথাগতর ফোন। ঘুমিয়ে পড়েছিলি ?

-      না, বল।
-      রাজর্ষির মা মারা গেছেন। 
-      সে কিরে, কখন?
-      এইতো, আধঘণ্টা হবে।

উৎপলরা তখন মাত্র কলেজে উঠেছে। আবিষ্কার করেছে বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা মারার আনন্দ। আড্ডা হত রাস্তাঘাটে, কলেজের গেটের সামনে, পানের দোকানের পাশে, বা মাঝে মাঝে, পকেট সায় দিলে পাড়ার চায়ের দোকানে। সিগারেটে টান দেবার আগে বড়ো বেশী এদিক ওদিক তাকাতে হত। সব সময় মনে হত এই বোধহয় বাড়ির কোনও গার্জেন, পাড়ার কোনও দাদা-কাকু-মেসো বা স্কুলের কোনও স্যার দেখে ফেললেন। দরকার পড়েছিল একটু নিভৃত একটা আড্ডার জায়গা। তখন রাজর্ষি জানাল ওর একখানা আলাদা ঘর আছে, যেখানে আড্ডা মারলে কেউ কিছু বলবে না। এবং সেটাও ছাদের উপরে। অনেক স্বাধীনভাবে হৈ হুল্লোড় করা যাবে । বৃষ্টি-বাদলার দিনে তো বটেই, এমনিতেও মাঝে মাঝে ওরা রাজর্ষির ঘরে আড্ডা জমাত। আরও পরে, যখন তাদের গোপন রাজনৈতিক আলাপ আলোচনার জন্য দীর্ঘ সময়ের বৈঠকের দরকার পড়েছিল, তখন থেকে রাজর্ষির বাড়িটাই ওদের প্রায় ঠিকানা হয়ে ওঠে। যখন তখন চাইলেই চা করে দিতেন মাসীমা। আট কাপ, দশ কাপ।  দুপুর, বিকেল কিংবা রাত দশটাতেও মাসীমার কোনও ক্লান্তি ছিলনা। কখনও আবার সঙ্গে মুড়ি-মাখা, কোনও দিন ফুলুরি। কখনও রাত বারোটায় রাজর্ষি বাড়ি ফিরেছে, সঙ্গে বন্ধুদের এক দুজন, রাজর্ষি মাসীমাকে বলেছে ওর ভাত সবাইকে ভাগ করে দিতে। মাসীমা ঐ মাঝরাতে কিছু না কিছু ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এবং সবাই মোটামুটি ভরপেট খেতে পেয়েছে । হয়ত ওঁর নিজের ভাতও ভাগ করে দিয়েছেন। ছেলের বন্ধুদের সবাইকে নামে চিনতেন। পরে যখন জীবিকার ধাক্কায় কেউ কেউ করিমগঞ্জ ছেড়ে কোনও দূর শহরের বাসিন্দা হয়ে গেছে, একজন কারো সঙ্গে দেখা হলে অন্যদেরও খোঁজ নিতেন। কয়েক বছর আগে একবার উৎপল দেখা করতে গেলে বললেন, তোর ছেলে তো এবার ক্লাস নাইন হল বোধহয়। উৎপল অবাক হয়ে গিয়েছিল। সেই মাসীমা মারা গেছেন। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। তথাগতকে জিজ্ঞেস করল, শ্মশানে যাবি তো তোরা, ক’টা নাগাদ যাওয়া হবে জানিস কিছু ? তথাগত জানায়, আত্মীয়স্বজনদের জন্য অপেক্ষা করতে হবে,  সব কিছুর জোগাড় যন্ত্র করতে হবে। আলো ফোটার পরেই বেরোনো ঠিক হয়েছে। আমরা কজন চলে যাব একটু পরে, তুই বরং ভোর ভোর সোজা শ্মশানে চলে আয়। উৎপলের খুব ইচ্ছে করছিল এক্ষুনি তথাগতদের সঙ্গে বেরোতে। মাসীমার শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকার সুযোগ পাবে এটা সুদূর কল্পনাতেও ছিলনা। সুযোগ যখন পাওয়া গেল, না যাওয়ার  মানে হয়না। কিন্তু সবদিক ভেবে তথাগতর পরামর্শটাই সঙ্গত মনে হল। পরদিন রাতের বাসে ও গৌহাটি ফিরবে। ঘুম হবে না। গৌহাটি পৌঁছে সেদিনই আবার অফিস। আজকের রাতটা পুরো জাগলে ধকল বেশী হয়ে যাবে।  

মাসীমার কাছে নানা ব্যাপারেই উৎপল আর তার বন্ধুরা ঋণী । শুয়ে শুয়ে আজ আবারও মাসীমাকে কৃতজ্ঞতা জানাল উৎপল। পুরনো বন্ধুদের অনেকের সাথেই আজ দেখা হয়ে যাবে, যাদের সাথে হয়তো গত পনেরো কুড়ি বছর বা তারও বেশী সময় ধরে দেখা হয়নি। মনের মধ্যে একটা উত্তেজনা টের পাচ্ছিল সেঘুমোবার চেষ্টার মধ্য দিয়ে রাত কাটল এবং এক সময় অন্ধকার সামান্য ফিকে হতেই মুখে চোখে জল দিয়ে তৈরি হয়ে রাস্তায় বেরোল । এবড়ো খেবড়ো ভাঙ্গা রাস্তা, কত দিন সংস্কার নেই কে জানে। তবু অভ্যস্তের মত পা চালালো উৎপল। নভেম্বরের মাত্র শুরু। কিন্তু বেশ জাঁকিয়ে কুয়াশা পড়েছে। অন্যমনস্কভাবে হেঁটে এক সময় নদীর পাড়ের বস্তির কাছাকাছি পৌঁছয় উৎপল এবং পুরনো অভ্যাসে বস্তির ভেতরকার সরু পায়ে চলা পথটার দিকে এগোতে গিয়েও থেমে গেল বস্তির ভেতর দিয়ে শর্ট-কাট হয়, নইলে পিচ রাস্তা ধরে অনেকটা পথ ঘুরে তবে শ্মশানে পৌঁছনো যাবে। কিন্তু আজ এতগুলো বছরের পর এই বস্তির রাস্তায় পা ফেলতে উৎপলের সঙ্কোচ হচ্ছে 

বস্তির ভেতর রাস্তা বলতে এর বাড়ির উঠোনের মধ্য দিয়ে তার বাড়ির পুঁই মাচার তলা দিয়ে ওর বাড়ির জানালা ঘেঁষে চলে যাওয়া। এক সময় এই বস্তির ভেতর উৎপলদের চলাফেরা এতই স্বাভাবিক ছিল যে  হেঁটে গেলে কেউই কৌতূহল দেখাত না। কিন্তু আজ পা বাড়াতে গিয়েও সঙ্কোচে দাঁড়িয়ে পড়েছে উৎপল। এই রকম প্রায় অন্ধকার ভোরে বস্তির ভেতর ঢোকাটা ঠিক কাজ হবে না হঠাৎ করে কার না কার চোখে পড়ে যাবে, হয়তো অচেনা কেউ। এমন কি চেনা কেউ হলেও এত বছর পর এই অস্পষ্ট আলোয় ওকে না ও চিনতে পারে। সতর্ক উৎপল পিচ রাস্তা দিয়েই হাঁটে।  

শহরের একেবারে শেষ সীমায়, কুশিয়ারা নদীর পাড়-ঘেঁষা ঐ এলাকাটায় কিছু গরীব আর নিম্নবিত্ত মানুষের বসতি। একসময় ঐ সব মুটে-মজুর রিক্সা-ওলা, ঠেলাওলাদের মধ্যে সংগঠন গড়ার কাজে লেগেছিল উৎপল, নবারুণ, তথাগতরা। সংগঠনটা অবশ্য মূলত: নবারুণের তৈরি। কিন্তু উৎপল বা তথাগতর নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল। ওখানেই এক বাড়িতে সারা রাত মিটিং করার পর ভোরের দিকে পুলিশ ওদেরে ঘিরে ফেলে। উৎপলরা পালিয়ে যেতে পেরেছিল কারণ এ পাড়ার অলিগলি ওরা যত জানে, পুলিশ ততটা জানত না। তাছাড়া, এলাকার লোকেরা পুলিশকে সহযোগিতা করেনি। দিন পনেরো পরে নবারুণ শিলচরে এক সমর্থকের বাড়ি থেকে ধরা পড়ে। নবারুণকে পুলিশ কতটা টর্চার করেছে, মার খেয়ে নবারুণ কতটা কি কনফেস করেছে, জানার উপায় ছিলনা। তাই উৎপলরা প্রায় দুবছর গা ঢাকা দিয়ে থাকেপরে সবকিছু ধামাচাপা পড়ে গেলে শহরে ফিরলেও তখন ওরা মাঝপথে ছেড়ে দেওয়া পড়াশোনা শেষ করা ও চাকরি খোঁজার কাজে ব্যস্ত। রাজনীতি যেটুকু করতো সেটা ছাত্র এবং মধ্যবিত্তদের মধ্যে। এই পাড়ার লোকগুলোর সাথে যোগাযোগ তখনই কমে যেতে থাকে। বস্তিতে যাওয়া হত না। লোকগুলোর সঙ্গে এখানে সেখানে দেখা হত। কথাবার্তা হত। পরিচয়টা হারিয়ে না গেলেও ফিকে হয়ে আসছিল। কিন্তু চাকরি বাকরিতে ঢুকে পড়ার পরে আর যোগাযোগ থাকেই নি। লোকগুলোর কারা কারা বেঁচে আছে, কে কী করছে, কিছুই জানেনা উৎপল। আজ এত বছর পর এ পাড়ার কাছাকাছি এসে অনেকের কথাই মনে পড়ছে, উৎপল মনে মনে ভাবল, সুযোগ পেলে আজ একবার সকলের খোঁজ নেবে।  

ঘুরপথে এসেও অন্যদের থেকে আগেই শ্মশানে পৌঁছে গেল উৎপল। শ্মশানের দিকে তাকিয়ে ওর তাক লেগে গেল। ওর চেনা শ্মশানটা ছিল বাঁধ পার হয়ে নদীর পাড় ঘেঁষে শুধুমাত্র একটুকরো সমতল জমি, পাকা কোনও চুল্লী ছিলনা, লোকেরা ফাঁকা জায়গা খুঁজে চিতা সাজাত। পোড়া কাঠ পড়ে থাকত নদীর ঢালে, যতদিন না জল বেড়ে সব কিছু ধুয়ে নিয়ে যায়। কোনও বেড়া বা পাঁচিল দিয়ে সীমানা চিহ্নিত করা ছিলনা।  শ্মশানের অপরিহার্য অঙ্গ যে কালী মন্দির, সেটাও ছিল একটু তফাতে, বাঁধের এদিকে। কালীমন্দিরে কোনও  নিত্যপূজার ব্যবস্থা  ছিল না, কোনও পরিচালনা ব্যবস্থাও ছিলনা, তবু অন্তত:  সন্ধ্যাবেলা দু-একটা প্রদীপ কেউ জ্বালিয়ে দিত। । শ্মশানের তাও ছিলনা। সেই শ্মশান এখন স্থানীয় এমপি না এমএলএর ফান্ডের টাকায় একেবারে সেজে গুজে রূপসী হয়ে আছে। পাকা চুল্লী হয়েছে দুটো, চুল্লীর নীচে থেকে পাকা ড্রেন, যাতে দাহ শেষ করে জল ঢেলে দিলে আর কোনও আবর্জনা উপরে জমে থাকবেনা। চারদিকে পাকা দেয়াল তোলা হয়েছে। দেয়ালের পাশ ঘেঁষে সিমেন্টের বাঁধানো বেঞ্চের সারি। একপাশে একটা টিনের চাল দেওয়া পাকা ঘর, বৃষ্টিবাদলার কথা ভেবে। কয়েকটা লাইট-পোস্টও আছে। রাত করে যারা আসবে তাদের সুবিধার জন্য। এখন অবশ্য কোনও লাইট জ্বলছে না। পুরো জায়গাটা তাই কুয়াশা মেখে ভুতুড়ে হয়ে আছে। সামনেই কুশিয়ারা। কত বছর পরে কুশিয়ারা নদীর তীরে এসে দাঁড়িয়েছে উৎপল। ওপারে কুয়াশায় ঢাকা বাংলাদেশ –উৎপলের মনে হল হঠাৎ যেন বিগত জন্মের কোনও দৃশ্যের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। দূরে হরিবোল শোনা গেল। রাজর্ষিরা আসছে।

          আধঘণ্টার মধ্যে শ্মশান চত্বর সরগরম হয়ে উঠলো। এক দল চিতা সাজাতে লেগে গেছে। কেউ  রাজর্ষিদেরে তৈরি করছে মুখাগ্নির জন্য। ভোর ভোর ভাবটা একটু তাড়াতাড়িই কেটে গিয়ে একটা ব্যস্ত  সকাল এসে জায়গা করে নিলউৎপল একবার গিয়ে খাটে শোয়ানো মাসীমার মুখের দিকে তাকালো। অনেক বুড়িয়ে গিয়েছিলেন। বয়স বোধ হয় নব্বই ছাড়িয়েছিল।  কয়েক পলক গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আস্তে আস্তে সেই জায়গা থেকে সরে আসে উৎপল। একটু দূরে বন্ধুদের একটা গুলতানি চলছিল। এর মধ্যে অনেকের সাথেই ওর দেখা হয়ে গেছে। কবে এলি, কেমন আছিস, এই সব তথ্য বিনিময়ের ফাঁকে প্রায় সবার গলায় একটাই অনুযোগ। তোরা তো ভাই করিমগঞ্জ ছেড়েই দিলি। ভালই করেছিস। এই তো রাস্তাঘাট, কারেন্টের অবস্থাও দেখেছিস।  কোনও দিকে কোনও ডেভলাপমেন্ট নেই। গৌহাটি যেতে মিনিমাম চৌদ্দ ঘণ্টা, কখনও সেটা  চব্বিশ ঘণ্টাও হয়ে যায়। তার মাঝে কোথাও আটকা পড়লে তো আর হয়েই গেল।

           বন্ধুদের সঙ্গে ঘাসের উপর বসে গল্প করতে করতে উৎপল চারদিকে চোখ বুলাচ্ছিল। চিতা এখন প্রবল পরাক্রমে জ্বলছে, ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশে উঠছে। উৎপল এবার উঠে তথাগতর দিকে ইশারা করে বাঁধের দিকে এগোয়। তথাগতও উঠে এসে ওর সঙ্গ নিয়েছে। বাঁধ বলতে আসলে একটা পাকা দশ ইঞ্চি ইটের দেয়াল। দু-পাশে মাটি ফেলে ঠেকা দেওয়া। দেয়ালের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে হয়, একের পিছনে এক। আগু পাছু করে ওরা দুজন এগোচ্ছিল। বাঁধের পাশ থেকেই বস্তির শুরু। একটু এগিয়ে উৎপল দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখাদেখি তথাগতও দাঁড়াল। উৎপলের দৃষ্টি অনুসরণ করে তথাগতও চোখ রাখে আলকাতরা মাখানো টিনের চালের ঘরটার দিকে। তারপর হেসে বলে, মনে পড়ছে ? উৎপলও হাসে। তারপর জিজ্ঞেস করে, বীরেন্দ্র কি করে এখন ? কী আর করবে, রিকসাই চালাচ্ছে হয়ত। তবে ঠিকঠাক বলতে পারবনা। দেখিও নি অনেকদিন। আরও একটু এগিয়ে বাঁধের উপর থেকে বস্তিটাকে কিছুক্ষণ দেখল ওরা। তারপর বাঁধ থেকে নেমে বস্তির আনাচে কানাচে হাঁটল কিছুক্ষণএখন আর বস্তি ঘুমন্ত নেই। সবাই কাজে কর্মে ব্যস্ত হয়ে আছে। যে কজনের মুখোমুখি হল ওরা, প্রায় সবাই বাচ্চা কাচ্চা আর কম বয়সী বৌ। তারা কেউ ওদেরে চিনতে পারল না। যারা চিনতে পারত ওরা হয়ত কাজে বেরিয়ে গেছে। বস্তির চেহারা বলতে গেলে একই আছে। বীরেন্দ্রদের ঘরটা আরও একটু জীর্ণ হয়েছে, দু-একজনের ঘর আবার পাকাও হয়েছে। এভাবে বাইরে থেকে বস্তিটাকে দেখে ওরা ফিরে আসে।

এবার আর বন্ধুদের গুলতানিতে যোগ না দিয়ে ওরা নিজেদের মধ্যে নানা ব্যাপারে কথা বলতে বলতে এদিক ওদিক হাঁটে এবং এক সময় চিতার কাছাকাছি পৌঁছয়। ছোটখাটো চেহারার একটি ছেলেকে অনেকক্ষণ ধরে উৎপল দেখছিল, পরনে লাল সালুর একটা টুকরো, পাকা হাতে লম্বা বাঁশ দিয়ে চিতাটাকে এদিকে ওদিকে খুঁচিয়ে দিচ্ছে। কখনো দু এক টুকরো কাঠ তুলে দিচ্ছে চিতায়। দূর থেকে কোনও সাধু টাধু ভেবেছিল, কাছাকাছি হতে দেখলো ছেলেটা মুখ চেনা। ঐ বস্তিরই হবে। নাম টাম মনে পড়ছে না। ছেলেটাও মুখ তুলে উৎপলকে দেখে হাসল। ভাল আছ উৎপল দা ? আগেই দেখেছি তোমাকে, কথা বলার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। উৎপলের ঠিক মনে পড়ল না, আগে কখনও ছেলেটি এভাবে তাকে দাদা বলে ডেকেছে কি না, বা এভাবে কথা বলেছে কি না। তবু হাসিমুখে বলল, ভাল আছিরে, তুই কেমন আছিস? এইতো চলে যাচ্ছে। ছেলেটা কথা বলার সময় দরকারের চেয়ে বেশী মাথা ঝাঁকায়, যেন বলার  আগেই সব বুঝে গেছে। একটু এগিয়ে উৎপল চাপা গলায় তথাগতকে বলে, ছেলেটাকে চিনি কিন্তু নাম মনে করতে পারছি না। তথাগত বলল, ওই বস্তিরই হবে। আমারও মুখ-চেনা লাগছে। 

চিতার আগুনের আড়ালে ধীরে ধীরে স্মৃতি হয়ে যাচ্ছিলেন মাসীমা । দাহকার্য শেষ হতে বাকী নেই  বুঝতে পেরে সবাই চিতার কাছে জড়ো হচ্ছে এখন। ক্রিয়াকর্ম শেষ হলে কলস ভরে ভরে জল এনে চিতা শান্ত করা হল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব দেখছে এই সময় লাল সালু পরা ছেলেটা উৎপলকে ডাকল, উৎপল দা-উৎপল তাকালে আগের মতই মাথা ঝাঁকিয়ে  বলল, একটু এসো এদিকে। ছেলেটার ডাকার মধ্যে কথার তুলনায় ইশারার প্রাধান্য দেখে উৎপলের হাসি পাচ্ছিল। আরও খেয়াল করল, ছেলেটা যার সঙ্গে কথা বলছে তার চোখের দিকে যতটা তাকায়, তার থেকে বেশী তাকায় এদিক-ওদিকে। মনে মনে সামান্য বিরক্ত হলেও কৌতূহলে ছেলেটার পিছন পিছন উৎপল এগিয়ে গেল পাকা ঘরটার দিকে। ঘরটার কোনও দিকে কোনও দেয়াল নেই, চার দিকেই সিমেন্টের বেঞ্চের মত বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আসা যাওয়ার জায়গা রেখে। উপরে ঢেউটিনের চাল। উৎপল দেখল, একদিকের বেঞ্চের উপর একটা ছোট কাঠের টুকরোর উপর লাল কাপড়ের টুকরো পেতে তার ওপর বসানো হয়েছে কালীর একটি ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। ছবির নীচের দিকটা সিঁদুর লেপটানো, সামনে কয়েকটি বাসি ফুল। আর তার পাশে স্টিলের একটা ছোট থালা। ছেলেটা নানা কথা বলে যাচ্ছে। গৌহাটিতেই তো থাকো। ভাল, ভাল। বৌদি,  বাচ্চা কাচ্চারাও সেখানেই? খুব ভাল। নবারুণ-দাও তো গৌহাটিতে। খুব ভাল। এই সব বকবকানির মধ্যে আগের মতই একবার এদিকে, একবার ওদিকে এবং তার মধ্যে একবার উৎপলের দিকে তাকিয়ে স্টিলের থালার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, আমার কালীকে কিছু দাও। যা তোমার ইচ্ছে। উৎপল কিছুটা বিরক্ত হলেও বাক্য ব্যয় না করে পার্স বের করলো। মনে মনে দশ না পঞ্চাশ দশ না পঞ্চাশ জপে শেষ পর্যন্ত একটা দশ টাকার নোট স্টিলের থালায় রাখল। কালীর ছবিতে প্রণাম টনাম করল না। ছেলেটা আগের মতই অনেকবার মাথা নেড়ে  বলল ঠিক আছে, ঠিক আছে। দশ টাকায় খুশী হল কি না বোঝা গেল না। ওর বকবকানি একই মাত্রায় চলছে। তুমি, নবারুণ-দা, তোমরা সবাই কোথায় উঠে গেছ, আমি তো যে লেম সেই লেমই রয়ে গেলাম। ছেলেটা কি বলছে ঠিক ধরতে না পেরে উৎপল এমনি হাসি হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেকদিন পর লেম শব্দটা শুনতে পেল। আজকাল কেউ কি লেম, অর্থাৎ কুপি বা লম্ফ জ্বালায় ? কে জানে। উৎপল এবার ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে,

-      এখানে পূজো কে দেয় ?
সেই একই ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে ছেলেটা বলে,
-      তিন-বেলা মায়ের সেবা করি। শ্মশান যাত্রীরা দক্ষিণা টক্ষিনা দেন।
-      বাড়িতে কে কে আছে রে তোর ? উৎপল প্রশ্নটা না করে পারেনা।
-      বাবা তো মারা গেছেন। মা আছেন।  বউ ছেলে মেয়ে আছে। 
-      রুজি রোজগার কি করিস, মানে অনেকদিন পরে দেখা তো, সব খবর জানিনা।
-      রুজি আর কোথায়। করি এটা সেটা, যখন যা পাই।
-      কিছু মনে করিস না, তোর নামটা কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিনা।
-      আরে আমি তো হারান। ভুলে গেলে ? সেই যে তোমরা পালিয়েছিলে, পুলিশ তো আমাদেরেই নিয়ে থানায় পুরল।

এবার উৎপল পূর্ণ দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকায়। দেখতে ছোটখাটো হলেও ভাল করে তাকিয়ে উৎপল বুঝে, দড়ি পাকানো চেহারা, চল্লিশের বেশীই হবে বয়স। এই ছেলেটির সাথে কোন রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল বলে মনে পড়ছে না। এমনকি কথাবার্তাও সে-ভাবে হয়ে থাকলে মনে পড়ত। বিশেষ করে ওর কথা বলার আলাদা ভঙ্গীর জন্য। উৎপলের স্মৃতিশক্তি এখনও নির্ভরযোগ্য এটা সবাই স্বীকার করে । কিন্তু চেহারাটা এত পরিচিত, সকলের নাম জানে, এমনকি কারা কারা গৌহাটি থাকে তা ও জানে। আবার বলল পুলিশ ধরেছিল । উৎপল কোন সমাধানে আসতে পারেনা। ছেলেটার কথায় কি কোনও অভিযোগের সুর আছে ? কোনও অনুযোগ ? ঠিক বোঝা গেল না। তবে এখন মনে হচ্ছে দশ টাকার নোট দেওয়াটা একটু বেশী তাচ্ছিল্য হয়ে গেছে। একবার ভাবল আরো কিছু টাকা ছেলেটার হাতে গুঁজে দেয়। কিন্তু সঙ্কোচে আটকাচ্ছিল। নিজের ব্যবহারে নিজেই বিরক্ত হয় উৎপল।

তথাগত ডাকছিল। শ্মশান যাত্রীরা এবার ফিরছে। উৎপল বলল, চলিরে, পরে দেখা হবে। ছেলেটা আগের মতই অনেক বেশী মাথা নাচিয়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাও। কতদিন পরে দেখলাম।

গৌহাটি ফেরার পর উৎপল তার রুটিনে ঢুকে পড়ে। অফিসের ব্যস্ততা, ছেলের পড়াশোনা সংক্রান্ত দৌড় ঝাঁপ, স্ত্রীর ডাক্তার দেখানো ইত্যাদি কাজে দিন যেতে থাকে যেমন যায়। এরই মধ্যে একদিন নবারুণের বাড়ী গেল, যেমন মাঝে মাঝে সময় করে যায়। রাজর্ষির মায়ের কথা উঠল। করিমগঞ্জের কথা উঠল। কিছুক্ষণ নানা প্রসঙ্গে কথা চালাচালি হল। নবারুণের স্ত্রী চায়ের সঙ্গে গরম পকোড়া ভেজে আনল ।  উৎপল বলল, পকোড়াগুলো পরে খাব, একটু গরম করে দিও। উৎপলের স্ত্রী বলল,

-      বুঝতে পেরেছি তোমাদের প্ল্যান। যা করবে তাড়াতাড়ি কর। বাবাই একা আছে। দেরী করলে চলবে না।

একটু পরে গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে দু একটা চুমুক দেবার পর দুজনেই যেন টের পেল, কথাবার্তায় এবার জুত আসছে।

ফিরে আসার পর হারানের কথা খুব একটা মাথায় ছিলনা। আজ করিমগঞ্জের গল্প করতে করতে  হঠাৎ মনে পড়ায় উৎপল নবারুণকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছারে, শ্মশানে একটা ছেলের সাথে দেখা হল। ছেলে মানে দেখতে ছোটখাটো, কিন্তু বয়স এখন চল্লিশ বিয়াল্লিশ হবে। নাম বলল হারানআমাদের সবাইকে চেনে। তোর কথাও বলল। মুখ চেনা মনে হচ্ছিল কিন্তু তার বেশী কিছু মনে পড়ল না। ওকে নাকি পুলিশ ধরেছিল, ঐ ঘটনার কানেকশনে। মনে করতে পারছিস, হারান নামের কাউকে? আমার মনে হল, বীরেনদা-দের বস্তিরই হবে। হারান ? নবারুণ স্মৃতি হাতড়ায়। দেখতে কেমন বলত ? কালো, ছোটখাটো চেহারা, কথা বলতে খুব মাথা নাচায়। ডান চোখের ভুরুর ওপর একটা কাটা দাগ আছে, ছোটবেলায় কেটে ফেটে গিয়েছিল হয়ত। নবারুণ হারান নামের এমন কাউকে মনে করতে পারেনা। জিজ্ঞেস করে – কোন প্রসঙ্গে এসব কথা উঠল ? উৎপল তখন ওকে পুরো ব্যাপারটা বলে। তাকানোর ভঙ্গী, মাথা ঝাঁকানোর ভঙ্গী, ফ্রেমে বাঁধানো কালী, এমন কি লেম শব্দটি পর্যন্ত। কিন্তু নবারুণ নামে-মানুষে এক করতে পারেনা। বলে, দেখলে অবশ্যই চিনব। ঐ পাড়ার ছেলে হলে চিনব না তা হতে পারেনা।   

-      আসলে ছেলেটার কথার মধ্যে কোনও অভিযোগ ছিল না হয়ত । তবে কেমন খারাপ লাগছিল। আচ্ছা, শুনেছিলাম আমাদেরে ধরতে না পেরে পুলিশ ঐ বস্তির কিছু লোককে উঠিয়ে নিয়ে যায়, কাদেরে সেটা জেনেছিলি তুই ?  

-      জেনেছিলাম। মানে খবর পেয়েছিলাম। বীরেন্দ্রকে ধরেছিল, ওর ঘরে আমাদের থাকার নানা চিহ্ন ছড়িয়ে ছিল। বীরেন্দ্র তো আমাদের সঙ্গেই পালিয়েছিল। ওর কাছে টাকা পয়সা কিছুই ছিলনা।  বীরেন্দ্র বেচারা বাসেই উঠতে পারেনি। ওকে তো বাস-স্ট্যান্ড থেকেই ধরেছিল। একটা চায়ের দোকানের পিছন দিকে ঘাপটি মেরে ছিল, আমাদের কাউকে পেলে টাকা চেয়ে নিয়ে বাসে উঠবে। কার্তিক নামের একটা ছেলেকেও ধরেছিল। পুলিশ ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমরা কোনদিকে পালিয়েছি। ও বলেছিল দেখেনি। পুলিশ সন্দেহ করেছিল ও জেনেও মিথ্যে বলেছে।  এ ছাড়া আরও দুজনকে ধরেছিল যাদেরে আমি নাম শুনে ঠিক চিনতে পারিনি তখন। হয়তো তেমন পরিচয় ছিলনা। এখন আর মনে পড়ছে না তাদের কারো নাম হারান ছিল কি না। কবেকার কথা। তবে কারো এগেন্‌স্টে স্পেসিফিক চার্জ কিছু ফ্রেম করেনি। একটু আধটু পিটিয়ে বুঝে গেছে এরা আমাদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু খবর দিতে পারবেনা। কেবল বীরেন্দ্রকেই বোধ হয় মাস চারেক রেখেছিল।

-      তাহলে হতে পারে এই ছেলেটাও অ্যারেস্ট হয়েছিল।

-      আচ্ছা, ছেলেটাকে কেমন বুঝলি, মানে, বোধ-বুদ্ধি কেমন ? রাজনৈতিক কথাবার্তা বোঝার মত ছেলে ?

-      আরে না। একেবারেই বোদা-মার্কা।

-      তাহলে হয়ত মাঝে মাঝে সিগারেট বা খৈনি আনতে পাঠাতাম। বা চা করে দিতে বলতাম । নাকি রিক্সা টিক্সা চালাত ? ঐ বস্তির অনেক ছেলে রিক্সা চালাত এবং আমাদেরে রাস্তায় পেলে কথা বলত।

-      হতেও পারে।

এবার ওরা মদ্যপানে মনোযোগ দেয় এবং টুকটাক নানা বিষয়ে কথা বলতে থাকে। রাজ্য-রাজনীতির শেষতম রসিকতা থকে শুরু করে সম্প্রতি রিলিজ করা সিনেমা, নতুন কোনও শারীরিক সমস্যা এবং বাসে হঠাৎ স্কুল জীবনের এক ক্লাসমেটের সাথে এত বছর পরে দেখা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ আসে এবং চলে যায়। কিন্তু নবারুণ হঠাৎ আগের কথার খেই ধরে বলে,

-      ঐ ছেলেটা যে বলল, তোমরা সবাই কোথায় উঠে গেছ, আমি সেই লেম রয়ে গেলাম, তাতে কী  মনে হচ্ছিল ? মানে, ওর কি এমন কোনও ফিলিং আছে যে আমরা ওকে, বা ওদেরে ঠকিয়েছি ? ধোঁকা দিয়েছি ? বা ব্যাবহার করেছি ?   

-      ওর কথায় কোনও ঝাঁজ ছিলনা। ইন ফ্যাক্ট ছেলেটাকে আলাদা করে মনে রাখার মত কোনও ব্যাপার ছিলনা। ওই অ্যারেস্ট হওয়াটা ছাড়া। কিন্তু ওর ঐ কালী-সাধকের বেশ ভূষা, তারপর ঐ ফ্রেমে বাঁধানো কালী, বাসী ফুল – এসব দেখে ওকে আমার কেমন যেন গল্পের চরিত্র মনে হচ্ছিল। তাই মনে থেকে গেছে। 

-      জানিনা ছেলেটা কে। তবে কিছু লোক আমাদের বিরুদ্ধে কুৎসা হিসেবে এই রকমের কিছু কথা বলে বেড়ায়। বিশেষ করে যারা একসময় আমাদের সঙ্গে ছিল, তাদেরে বোঝায়, দেখ, একসঙ্গে রাজনীতি করলে, আর আজ ওরা কোথায় আর তোমরা কোথায় । সেই জন্য জিজ্ঞেস করছি, তোর  তেমন কিছু মনে হয়নি?

-      আমিতো সেরকম কিছু বুঝলাম না। ইন ফ্যাক্ট, ঐ লোকগুলোর কথা ভাবলে আমার একটা অপরাধ-বোধ হয়। আসলে দেখ, আমরাও এক সময় যথেষ্ট খারাপ অবস্থায় ছিলাম। দু একজনকে বাদ দিলে আমাদের কেউই ধনীর ছেলে নই। আমাদের ছোটবেলা এমনকি কলেজ জীবন অনেক কষ্টেসৃষ্টে কেটেছে। রাজনৈতিকভাবে একসময় আমরা জেনেছিলাম আমাদের এবং আমাদের মত আরও বহু বহু লোকের দারিদ্র্যের জন্য দায়ী এই সিস্টেম। এবং এই সিস্টেমকে পালটাবার জন্য ওই লোকগুলোকেও ডেকে নিয়েছিলাম সঙ্গে, বুঝিয়েছিলাম, একমাত্র লড়াই করেই আমাদের অবস্থা পাল্টানো সম্ভব। অবস্থা পাল্টানোর আশায় লোকগুলো আমাদের সঙ্গী হয়েছিল। অনেক কষ্টও স্বীকার করেছে। সিস্টেম সেই একই জায়গায় রয়ে গিয়েছে। ঐ লোকগুলো, যারা একেবারে দিন আনা দিন খাওয়া অবস্থায় ছিল, তাদের অবস্থার বিন্দুমাত্র উন্নতি তো হয়ই নি, অনেকের অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে। আমরা কিন্তু আগের তুলনায় দিব্যি ভাল জায়গায় পৌঁছে গেছি। ভাল চাকরি বাকরি করি, বাড়ি গাড়ী আছে, আমাদের ছেলে-মেয়েরা ভালো স্কুলে পড়ে, দামী কাপড় পরে, আমরা মলে কেনাকাটা করি, মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখি। যে সিস্টেমকে পালটাব বলেছিলাম, কোনও না কোনও ভাবে আমরা যেন ঐ সিস্টেমের অংশ হয়ে গেছি। ঐ লোকগুলো তো আমাদেরে হিংসে করতেই পারে। অথচ দেখা হলে ওদের বেশীর ভাগ লোকই নিজের দুরবস্থার কথা বলেও কোনও টাকা পয়সা চায় না। নিজের থেকে দিতে গেলে সঙ্কোচে পড়ে যায়। দু একটা লুম্পেনের কথা বাদ দে। এই লোকগুলোর কথা ভাবলে আমার নিজেকে বড়ো স্বার্থপর মনে হয়।

-      এখানে স্বার্থপরতার কি আছে ? আমরা একটা আন্দোলন গড়তে চেয়েছিলাম। সেটা সফল হলে ওদেরও ভাল হত। সফল হয়নি, তার দায়ভাগ সবাই মিলে নিচ্ছি। ওই ছেলেটা অ্যারেস্ট  হয়েছিল, পুলিশের দু একটা ডাণ্ডা খেয়েছে, তাতে কি ? আমিও অ্যারেস্ট হয়েছিলাম। পুলিশ আমাকে টর্চারও করেছে। তোরাও দেড় দু বছর পালিয়ে কাটিয়েছিস। সাফারিংস আমাদের হয়নি ? আর তাছাড়া আমরা তো সংগ্রাম থেকে সরে যাইনি। নানা ভাবে নানা লড়াই-এর সাথে যুক্ত আছি। হয়ত চাকরির জন্যে বা পরিবারের জন্যে অনেক কিছুতে সরাসরি যোগ দিতে পারিনা, তা বলে কি আমরা সব কিছু ছেড়েছুড়ে হাত ধুয়ে বসে আছি ?  তুই যাদের কথা বলছিস, ওরা কোনও সময় আমাদের সঙ্গে ছিল, পরে সরে গেছে। এখন হয়ত একটা লিফলেটও হাতে নিতে ভয় পাবে। 

কথা শেষ করে নবারুণ গেলাসে চুমুক দেয়। যেন মনে পড়ে গেছে এই রকম ভঙ্গীতে উৎপলও গেলাস তুলে এবং চুমুক দিতে গিয়ে দেখে ওর গেলাস খালি। এদিক ওদিক তাকিয়ে উৎপল বোতল খুঁজে নেয় এবং নিজের পেগ পূর্ণ করে। উৎপলের স্ত্রী আসার পর থেকেই রান্না ঘরে নবারুণের স্ত্রীর সাথে আড্ডা জমিয়েছিল। এই মোক্ষম সময়ে বেরিয়ে আসে এবং উৎপলকে নতুন করে গেলাস ভরতে দেখে উদ্বেগ দেখিয়ে বলে,

-      কি গো, ক’ পেগ হল ? গাড়ী চালিয়ে ফিরতে হবে সেটা মনে আছে তো ?

নবারুণ ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলে, কি টাইমিংস। উৎপলের স্ত্রী সোফায় বসে চওড়া করে হাসে। উৎপল অবশ্য স্ত্রীর কথায় মনোযোগ না দিয়ে বলে,  

-      আমি ব্যাপারটাকে অন্য রকম করে দেখছি। আজকে যদি আমাদের কয়েকজনের অবস্থা আগের তুলনায় ভাল হয়ে যায়, সেটা কিসের জোরে ? আমাদের একটাই পুঁজি, আমরা মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে, ছোটবেলা থেকে পড়াশোনা ব্যাপারটা বুঝি। পড়াশোনাটা আমাদের মাথায় ঢোকে। পড়াশোনার জোরে চাকরি পেয়েছি । আর চাকরিতে উন্নতি করেছি কারণ আমাদের দক্ষতা ছিল। দক্ষতার যা যা মানে হয় সব মিলিয়েই বলছি। আসল কথা হচ্ছে আমাদের সব সময়ই ফিরে আসার একটা রাস্তা ছিল। মুভমেন্ট যখন আঘাত পেল, আমরা তখন আবার পড়াশোনার জগতে ফিরে এলাম। জানতাম, পড়াশোনা শেষ করে চাকরি একটা পাওয়া খুব কঠিন হবেনা, এবং তখন জীবন একটা সহজ খাত খুঁজে পাবে। বিয়ে, বাচ্চাকাচ্চা, প্রমোশন। লোন নিয়ে বাড়ি। নবারুণ আমি ক্লাসের কথা বলছি। ক্লাস হিসেবে কিছু প্রিভিলেজ আমাদের ছিল যেটা হয়ত ঐ বীরেন্দ্র, কার্তিক বা সেই হারানের ছিলনা। বড় রকমের বিপদে পড়লে আমাদেরে বাঁচিয়ে আনার একটা চেষ্টা আমাদের পরিবার করতে পারত। ওদের সেরকম কেউ ছিলনা। আমার মনে হয় যেন কিছু লোক কাদায় ছিল, আমরা বাবু শ্রেণীর কয়েকজন পোশাক ময়লা করে কাদায় নেমেছিলাম ওদেরে তুলে আনব বলে। অঙ্গীকার করেছিলাম সঙ্গে থাকব। তারপর পিঠে ডাণ্ডা পড়তেই দিব্যি ভাল ছেলের মত হাত পা ধুয়ে পড়তে বসে গেলাম।  ওরা পড়ে রইল যে যেখানে ছিল। বাড়তি জুটল পুলিশের থাপ্পড়, কিছু হয়রানি, রুজি রোজগারের ক্ষতি।

নবারুণ একটু চুপ করে যায়। গেলাস ভরে এবং চুমুক দেয়। ওর মুখটা ঘামা ঘামা দেখাচ্ছে। একটা চাপা উত্তেজনার অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে তার হাবভাবে। উৎপল হিসেব করে দেখে, দু পেগ হয়েছে। বিশেষ কারণ না থাকলে এটাই ওদের লিমিট। সে যা যা বলল তা কি নেশার ঘোরে ? বোধহয় একটু বেশী কড়া করে বলা হয়ে গেছে। কিন্তু ও ওর আন্তরিক উপলব্ধির কথাই বলেছে। সত্যিই এই কথাগুলো ওর ভাবনায় আসে।  তবু উৎপল জানে, নবারুণ খুব স্পর্শকাতর। একটা আদর্শ, যেটাকে ওরা পরিত্যাগ করেনি, এবং একটা জীবনযাত্রা, যেটার উপর ওদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই, দুটোর মধ্যে প্রাত্যহিক কিছু সংঘাত থাকে। সেই সংঘাতে ওরা সবাই কিছু না কিছু ক্ষতবিক্ষত। স্বাভাবিকভাবেই নবারুণ বেশী স্পর্শকাতর বলে জ্বালাটা বেশী অনুভব করে। তার মধ্যে আজ এই প্রসঙ্গ তুলে ও হয়ত নবারুণকে একটা কোণে ঠেলে দিয়েছে। সহজাত প্রবৃত্তিতে ও এখন একটা প্রত্যাঘাতের প্রস্তুতি নেবেউৎপল ঠিক করল এ প্রসঙ্গে আর কথা বাড়াবে না। 

এই সময় নবারুণের স্ত্রী শেষ ক’টি পকোড়া নিয়ে এসে সোফায় বসল এবং একটা মুখে পুরল। কেমন হয়েছে বললে না তো । উৎপল প্রসঙ্গান্তরে যাবার এমন সুযোগ হাতছাড়া করেনা। দারুণরান্নাঘরে লুকিয়ে বসে আছ, তারিফ করার সুযোগই পাচ্ছিনা। কেউ এলেই রান্নাঘরে চলে যাও, তাহলে আড্ডা হয় কি করে। তোমরা তোমাদের আড্ডা দাও, আমরা আমাদের আড্ডা দিই। তোমাদের কথা আমরা বুঝব না, আমাদের কথায় তোমরা মজা পাবেনা। এভাবে আরও কিছুক্ষণ খেজুরি কথাবার্তায় সময় কাটে। এক সময় উৎপলের স্ত্রী তাড়া দেয়, ছেলে একা আছে ঘরে। উঠি উঠছি করে আরও কিছু সময় কাটিয়ে উৎপলরা ওঠে। বাইরে বেরিয়ে এসে চাবির বোতাম টিপে গাড়ীর দরজা খোলে। উৎপলের বউ উঠে বসে। নবারুণ এতক্ষণ বিশেষ কিছু কথা বলেনি। টুকটাক মাথা নেড়ে বা সামান্য মুচকি হেসে আড্ডায় তাল দিয়ে যাচ্ছিল। এবার হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে বলে ওঠে,

-      রিভল্যুশনারি কাজকর্মের সাথে কোনও সেবা প্রতিষ্ঠানের কাজের তুলনা হয় না। মাও জে দং বলেছিলেন না, বিপ্লব কোনও সূচীকর্ম নয়! একটা বড় আন্দোলনে অনেকের অনেক ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি হয়। আন্দোলন যারা পরিচালনা করে, তাদের পক্ষে সম্ভব নয় আলাদা ভাবে প্রতিটি ব্যক্তির সমস্যা দেখা, সব সময় সকলের পাশে থাকা। এমন তো নয় যে আমরা কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য এই আন্দোলন গড়ে তুলে ছিলামএমন নয় যে এই আন্দোলন থেকে আমরা কোনও ব্যক্তিগত লাভ কুড়িয়েছি। আমাদের আন্তরিকতায়, আমাদের ডেডিকেশনে ফাঁকি ছিল না। আর স্যাক্রিফাইস কি আমাদের কম ছিল ? যদি এই আন্দোলনের রাস্তায় না হেঁটে আমরা ক্যারিয়ারিস্ট হতাম, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতাম, কিরকম রেজাল্ট করতে পারতাম বল। অতগুলো বছরও নষ্ট হত না, ভাল রেজাল্ট করে অনেক বড় চাকরি করতাম। যেখানে আছি তার অনেক বেশী উঁচুতে থাকতে পারতাম। আরো আয়েসের জীবন পেতে পারতাম। কই, তার জন্য তো আমরা কেউ কোনও আফসোস করি না।

উৎপল নবারুণকে সময় দেয় পুরো কথাটা বলার। দাঁড়িয়ে কথাটা শুনে। কিছুই নতুন কথা নয়। কিন্তু কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়না। ওর স্ত্রী গাড়িতে উঠে বসে আছে। নবারুণের স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে অতিথি বিদায়ের বাকী ফর্মালিটি সারবে বলে। তবু উৎপল কিছুটা সময় দেয় যাতে নবারুণের কথাটা তার প্রয়োজনীয় স্পেস পায়। তারপর বলল, চলি।  নবারুণ অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ায়। 

নবারুণের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে উৎপল গাড়ীতে উঠে বসে স্টার্ট দিল। হাত নাড়িয়ে রওয়ানা হল।

বাড়ি ফিরে জামা কাপড় পালটে হাত মুখ ধুয়ে উৎপল খেতে বসেছে, নবারুণের আবার ফোন। উৎপল খেতে খেতেই ফোন ধরে, হ্যাঁ, বল।

-      ঘুমিয়ে পড়েছিস ?

-      না।

ভূমিকা না করে নবারুণ বলতে থাকে

-      আমার সত্যিই কোনও গিল্‌টি ফিলিং হচ্ছে না। .........  জেল থেকে বেরিয়ে .........  ......... পুরোনো মুভমেন্টে ফিরে যাওয়ার ............ ছেড়ে দিইনি। অন্য ফ্রন্টে ......... চাকরি বাকরির কিছু বাধ্য বাধকতা থাকে।

নবারুণের উচ্চারণ জড়ানো। কেমন যেন আহত শোনাচ্ছে ওর গলা। উৎপল মোবাইল কানে লাগিয়ে খাওয়ায় মন দেয়। ওদিকে নবারুণ বলে চলেছে -

......... কিন্তু আমি তো সরে আসিনি ........... যেবার আমি অ্যারেস্ট হলাম, তোরা তো জানিস ....... অ্যাক্‌টিভ যোগাযোগ রাখি ...... আমিই হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা......
________________________
(একা এবং কয়েকজন, গুয়াহাটি, ২০১৪)

No comments:

Post a Comment