হরুঠাকুরের আত্মকথন
-মলয়কান্তি দে
[এক]
আজ সন্ধ্যায় আমি হরুঠাকুরের আত্মকথন শুনতে যাব। হরুঠাকুর
বলেছে, সন্ধেবেলা চলে আসিস। ওর মোটর গ্যারেজের লোকেশনটা ভাল
করে বুঝিয়ে দিয়েছে। গ্যারেজের পিছন দিকে ওর
ছোট্ট অফিস ঘরে ও
আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমার খাতিরে ও নাকি আজ
অন্য কোনও সঙ্গী রাখবে না। আমি
যেন দেরী না করি। বুঝিয়ে বলার দরকার ছিল না, কারণ আমার
ছোটবেলার শহরটা খুব বেশী বদলায় নি। তবু যেহেতু
আমি দীর্ঘদিন বাইরে আছি, ভেবে নিয়েছে আমার খুঁজতে অসুবিধে হবে।
হরু ঠাকুরের সাথে আজ সকালে আমার দেখা হওয়াটা বেশ নাটকীয়।
গতকাল একজনের সাথে দেখা করতে পাথারকান্দি গিয়েছিলাম। আজ সকালে বাসে করে
ফিরছি, বাসটা শহরে ঢোকার মুখেই লেভেল ক্রসিং-এ আটকে গেল। ভস ভস শব্দ করে রেলের একটা
ইঞ্জিন ডানদিক থেকে বাঁদিকে সান্টিং করতে গেল, সেটা ফিরবে, তারপর গেট খুলবে। সকাল
দশটার ভিড়। যাদের তাড়া আছে তারা কেউ কেউ নেমেও যাচ্ছে। লেভেল ক্রসিং পার হয়ে সামান্য
হাঁটলেই বাস স্ট্যান্ড। এই বাসের যাত্রা ওখানেই শেষ। আমি ছুটিতে আছি
বলে আমার তাড়া নেই। বসে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে শহরের বদল
দেখছি। নতুন দোকান পাট অনেক হয়েছে। আবার পুরনো দোকানের সাইনবোর্ড পাল্টে
গেছে কোথাও। ছিল শ্যামলী মাইক হাউস, হয়ে গেছে পিঙ্কি মোবাইল স্টোর। এসব দেখতে
দেখতে নিজের মধ্যে বেশ ডুবে ছিলাম।
হঠাৎ মনে হল কী যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে আমার। কারণ খুঁজতে সচেতন হয়ে
চারপাশে তাকাই এবং তখনই দেখি, আমার ঠিক পাশের সীটে বসা যাত্রীটি হাই পাওয়ারের চশমার
ভেতর থেকে আলপিনের মতো ছুঁচলো দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। এমনই তীব্র সেই তাকানো, মনে
হচ্ছিল যেন আতস কাচের ভেতর দিয়ে ঘন হয়ে আসা আলোর মতোই সেই চাউনি আমাকে বিঁধছে। আমি
ঘুরে তাকাতেও লোকটি চোখ সরাল না দেখে আমার বিরক্তি জন্মাল। লোকটি জানে না যে এভাবে
কারো মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা অভদ্রতা। আসলে, যখনই আমি আমার এই নিজের শহরে
ফিরি, এখানকার লোকগুলোর সেই পুরনো ঢিলেঢালা অভ্যাস দেখে খুব বিরক্ত হই। আর আমি যে
একটা বড় শহরের মানুষ, সেটা জাহির করতে সুযোগ পেলেই তর্ক শুরু করি। অনেক সময় ঝগড়াও বাঁধে। এই লোকটা
শুরু থেকে আমার পাশে ছিল না, মাঝপথে কোথাও উঠেছে। বেশ তেড়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু
তার আগেই চশমা-ধারী বলে উঠল, তুই রাঘব না?
আমি হতভম্ব। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। মোটামুটি ফর্সা রঙ, মাথার চুল ছোট করে
ছাঁটা, তাই মুখখানা বেশ বড় দেখাচ্ছে। গালে
না-কামানো দাড়ির শ্যামলা আস্তর আর চোখে কালো, চওড়া ফ্রেমের হাই পাওয়ারের চশমা। এমন
চশমা, যা পরলে চোখদুটো টুনি বাল্বের মত জ্বলছে মনে হয়। দুই
ঠোঁটের ফাঁকে একটা চালাক চালাক হাসির সরু রেখা। গায়ে সুতির
শাদা পাঞ্জাবি ঘামে জবজবে। এই চেহারার
মালিককে আমি আগে দেখেছি বলে মনে পড়ছিল না। লোকটির দিকে তাকিয়ে একটু আমতা আমতা করেই
বললাম, আপনাকে, মানে তোমাকে ঠিক...
আমি সতু রে, সত্যব্রত। ছতর বতরকে মনে নেই?
হঠাৎ আমি এই অচেনা মুখটিতে কয়েকটি পরিচিত রেখা আবিষ্কার করি। আরে, এ তো
আমাদের হরুঠাকুর। রাগ সরে হাসি ফুটল মুখে। ছতর বতর নামে অবশ্য আমরা ওকে ডাকতাম না।
ডাকতো কেবল স্কুলের বন্ধুরা। আমরা, পাড়ার ছেলেরা এমনিতে সতু বলতাম,
পরের দিকে নাম দিয়েছিলাম হরুঠাকুর। সত্যব্রত নামটা তো
জীবনে মুখে এনেছি বলে মনে হয় না। এখন ও নিজেই নিজেকে ছতর বতর নামে চেনাতে
চাইছে দেখে মজা লাগল। কখন লেভেল ক্রসিং-এর গেট খুলে গাড়ি
গড়াতে শুরু করেছিল, এখন একেবারে স্ট্যান্ডে এসে থেমেছে। হরুঠাকুর আমার শার্টের
হাতা ধরে টানল। ওর পেছন পেছন নামলাম। ভিড় এড়িয়ে একটু ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়ালাম।
- তারপর,
কত বছর পরে দেখা! কোথায় থাকিস এখন? করিমগঞ্জে থাকলে তো চোখে পড়ত।
এত প্রশ্নের কী উত্তর দেব। ছাড়া ছাড়া ভাবে কিছু বলছিলাম। আর
কথাবার্তার ফাঁকে খুঁটিয়ে দেখছিলাম ওকে। আমার
ধন্দ যাচ্ছিল না। গলার স্বর তো সেই এক। চেহারার আদলটাও চেনা যাচ্ছে। তবু, এ কি
আমাদের সেই সতু, যে গুছিয়ে কথাই বলতে পারতো না? কিছু বলতে গেলে তড়বড় করে যত কম শব্দে
পারে, প্রয়োজনীয় কথাটা বলে ফেলে ভাবত যেন ঘাড় থেকে বোঝা নামল। অনেক শব্দ ঠিকঠাক উচ্চারণও
করতে পারত না। আমরা ওকে কত ভাবে খ্যাপাতাম। রাগ করত না, শুধু একটা চওড়া হাসি সারা
মুখে ছড়িয়ে বসে থাকত। আর এখন কেমন চৌকস লোকের মত চোখে মুখে কথা বলছে! চেহারায়, পোশাক
আশাকে ওকে দেখাচ্ছেও তেমনি। পুরোদস্তুর একজন চালাক চতুর সফল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ।
সত্যি বলতে, ওকে একদিন এরকম একজন
সফল সুখী মানুষের চেহারায় দেখব, এটা স্বপ্নেও
ভাবি নি।
আমার চমকানো ভাব দেখেই বোধ হয় হরুঠাকুরের ঠোঁটের রেখায় আবারও একটা সরু হাসি
উঁকি দিল। আমার পিঠে হাত রেখে এবার জিজ্ঞেস করল, আছিস তো কয়েক দিন?
আমি ‘হ্যাঁ’ বলতে বলল, - তাহলে চলে আয় না একদিন সন্ধ্যার পর। আজই
আয় বরং। আজ ফ্রি আছি। সময় নিয়ে আসবি, গল্প হবে। কি রে, আসবি তো? আমি ভেবে নিলাম। আজ
সন্ধ্যায় আমার তেমন কোথাও যাওয়ার নেই। বললাম, ঠিক আছে।
আজই। হরুঠাকুর আমার কাঁধে হাত রেখে খুব অন্তরঙ্গ গলায় বলল, একটা কথা, তোর চলে কি
না জানি না, আমি কিন্তু ভাই সন্ধ্যা হলেই একটু ওই সব নিয়ে বসি। তুই খেলে ভাল, না
খেলে জোর করব না। আমাকে কিন্তু খেতেই হবে।
আমি মুচকি হাসলাম। সে হাসির যেমন খুশী অর্থ করা যায়। ঠিক
করলাম, আমাকে যেতেই হবে। সেই ক্লাস সিক্সে তিন বার ফেল করে
স্কুল ছেড়ে দেওয়া সতু, ব্যাটা কেমন করে আজ একখানা আস্ত ভদ্রলোক হয়ে উঠল, একবার গিয়ে
দেখে আসি। সতু হাত টাত নেড়ে ওর ঠিকানা বুঝিয়ে দিল।
বাড়ি এসে স্নান খাওয়া বিশ্রামের ফাঁকে বার বার মনে পড়ছিল সতুদের কথা।
আমাদের পাড়ায় বসন্ত বৈরাগীর বাড়িতে ভাড়া থাকত সতু আর ওর মা। এমনিতে পাড়ার অন্য
পাঁচটা বাসিন্দার মতই ছিল ওদের চলা-বলা-খাওয়া-পরা। আলাদা করে কিছু বোঝার বয়স আমাদের
নয়। কেউ কেউ ওকে কখনও ‘বাভনা’ বলে ডাকত। এভাবেই
জেনেছি সতুরা ব্রাহ্মণ। কিন্তু এটা কী এমন দরকারি তথ্য সেটা
বুঝতাম না। বড়দের মুখে শুনেছি ওরাই আমাদের পাড়ায় একমাত্র ব্রাহ্মণ পরিবার। কেউ কেউ
সতুকে বলতেন, বাবারে, তাড়াতাড়ি দুই চাইরটা মন্ত্র-উন্ত্র হিখিলাও। তেউ আর আমরার
পুরইতর লাগি অলা মাথা মারা লাগতো নায়। সতুকে পুরুতের বেশে কল্পনা
করে আমাদের হাসি পেত। সবাই জানে, পড়াশোনায় ওর মাথা একেবারেই নিরেট। হাই স্কুলে উঠে ইংরেজিতে নিজের নামের বানান
লিখতে প্রায়ই নানা উল্টোপাল্টা করত। খাতার মলাটে নামটা এমনভাবে লিখেছিল,
গুরুপদ স্যার ঠিকঠাক বুঝতে না পেরে, বা হয়তো বুঝেও একটু মজা করার জন্যে, খাতাটা
উঁচিয়ে ধরে বললেন, এইন কে বা, ছতর বতর? নিজের খাতা চিনতে পেরে সতু উঠে দাঁড়িয়েছিল।
মাস্টারমশাই বললেন, ও তুমি নি? তে নেও, ভালাউ অইছে। ছতর বতর চকর বকর। সত্যব্রত
চক্রবর্তী সেদিন থেকে ছতর বতর চকরবকর হয়ে গেল। সতু রাগ করতো না। মুখে সেই চওড়া হাসিটা মেলে ধরত, আর সেই হাসিটা দেখে সবাই আরও বেশী
করে ওর বন্ধু হয়ে যেত।
সতুর দেড় বছর বয়সে নাকি ওর বাবা মারা যান। ওর মাকে আমরা সব সময় বিধবার বেশে
দেখেছি। শান্ত রোগা চেহারার মহিলা। তেমন ফর্সা না হলেও বেশ উজ্জ্বল
গায়ের রঙ। আমরা পিসি বলে ডাকতাম, কোন সম্পর্কে জানিনা।
ওঁর গলার স্বর কখনও ওদের বেড়ার বাইরে বেরত না। আমরা কেবল সতুকে খেলায় ডাকতে গেলে
কখনও শুনতাম। মাঝে মাঝে উনি আমাদের ঘরেও আসতেন। মা ওঁকে খুব যত্ন করে পিড়ি পেতে
বসতে দিত। কথা বার্তা যা বলতেন উনি, খুব মোলায়েম গলায়। ওই সময়টাতে আমাদের মার
আচরণও খুব সংযত হয়ে যেত। বেশ নিচু গলায় কথা বলত মা। আমাদের বকাঝকা করত না। উনি যাবার
জন্য উঠে দাঁড়ালে মা ঘরে যা আছে, হয়তো এক ফালি কুমড়ো বা দুটো আলু - ওঁর হাতে তুলে
দিত। হাত বাড়িয়ে সেই কুমড়ো বা আলুর উপহার গ্রহণ করার ভঙ্গীটা আমরা হা করে দেখতাম। ভাবতাম,
হাত পেতে কিছু নেওয়াও কত সুন্দর হয়! শুনেছিলাম বসন্ত বৈরাগী নাকি ওদের কাছ থেকে
নামমাত্র ভাড়া নেয়, এক ব্রাহ্মণ পরিবারকে ভাড়াটে হিসেবে পেয়েছে, এই পুণ্যের কাছে নাকি
টাকা পয়সা কিছুই নয়। বসন্ত বৈরাগীর গুড়ের দোকান ছিল বাজারে। মোটামুটি চলত। সতুদের
কি করে চলত আমি জানি না। মাঝে মাঝে ওর এক মামা আসতেন। ধূতি শার্ট পরা একজন লম্বা মানুষ। সতু খুব
একটা কাছ ঘেঁষত না। মামা এলেই এক ফাঁকে টুক করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসত। আমরা
জিজ্ঞেস করলে বলত, দূর, খালি পড়াশোনার কথা জিজ্ঞেস করে।
ক্লাস সিক্সে তৃতীয়বার ফেল করে সতু একটা মোটর গ্যারেজে ঢুকে যায় কাজ শিখতে।
তখন থেকে আর ওর সঙ্গে বেশী দেখা হত না। হঠাৎ কখনও সন্ধেবেলা দূর থেকে দেখেছি সতু
কালিঝুলি মাখা পোষাকে বাড়ি ফিরছে। মাথাটা ঝুঁকে আছে সামনের দিকে। পিছন থেকে ডাকতাম
না। কিন্তু ওর এই ময়লা পোশাক পরে মাথা নুইয়ে
হাঁটা যেন ঘনায়মান সন্ধ্যারই একটা অনুষঙ্গ বলে মনে হত। কখনও মুখোমুখি দেখা হলে
হেসেছে। ওর সেই পরিচিত চওড়া হাসি।
গত পনেরো কুড়ি বছরে বোধ হয় ওর সাথে একবারও দেখা হয় নি। আমি নিজেই চাকরি
পেয়ে চলে গেছি অন্য শহরে। সতুরা কবে আমাদের পাড়া ছেড়ে চলে গেছে জানতাম না। খুব যে
ওর কথা মনে পড়তো, তা ও নয়। আর কখনও মনে পড়লে সেই সন্ধ্যার অন্ধকার গায়ে মেখে ওর বাড়ি
ফেরার দৃশ্যটাই চোখে ভাসতো। ভাবতাম কোথাও একটা অভাবী অবিন্যস্ত জীবনে থিতু হয়েছে হয়তো। আজ
যদি সেই রকম কোনও অবস্থায় ওর সাথে দেখা হতো, আমি ওর বাড়ি যেতে চাইতাম। ওর
বৌ-বাচ্চার সঙ্গে দেখা করতাম। আনন্দ করতাম। যাতে ওরা ভাবে সতুর এই বন্ধুটি লোক বড়
ভাল। বড় চাকরি করে কিন্তু একটুও অহংকার নাই। আমার এই চাকরি আসলে বড় কিছু নয়,
কিন্তু একজন দরিদ্র মোটর মেকানিকের কাছে তা অনেক কিছু। কিন্তু আজ যে চেহারায় ওকে দেখলাম,
তাতে আমার ভেতরে কেমন জ্বালা পোড়া হচ্ছে। জানি না সতু কী করে, কেমন আছে, তবু
চেহারার চেকনাই দেখে বোঝা যায়, মোটামুটি সুখ-সম্পদের মধ্যেই আছে। কোন বিচারে এটা
হতে পারে? দাঁড়িপাল্লার কাঁটা কেন শেষ পর্যন্ত সব নিয়ম অগ্রাহ্য করে ওর দিকেই
ঝুঁকে যায়! ছোটবেলার নানা না মেলা হিসেবের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। চারজনে মিলে নিরঞ্জন
সাহার নারকেল গাছ থেকে ডাব চুরি করলাম, পরের দিনের ফুটবল ম্যাচে, হাফ টাইমে, অন্যরা
যখন নুন মাখানো লেবু খায়, আমরা প্রতিপক্ষের চোখ ট্যারা করে দিয়ে ডাবের জল খাবো। গাছে
সতুই উঠেছিল। ওসব কাজ ও-ই ভাল পারত। পরে যখন ধরা পড়ে গেলাম, নিরঞ্জন
সাহা আমাদের তিনজনের বাড়িতে নালিশ জানাল, গার্জেনের হাতে মার খাওয়াল। কিন্তু
সতুর বেলায় শুধু ডেকে বলল, ব্রাহ্মণের ছেলে, এরকম করতে হয়?
আমার বাবা যখন মারা যান, কাজকর্মের তদারকিতে ছিলেন আমার
কাকা। শ্রাদ্ধে পঞ্চ-ব্রাহ্মণকে ভোজন করাতে
হবে। এক ব্রাহ্মণ সতু। ব্রাহ্মণ-ভোজনের পর কাকা আমাকে ধরে ধরে একেক জনের কাছে নিয়ে
গিয়ে প্রণাম করাচ্ছেন, আর দক্ষিণার দু-টাকা তাদের পায়ের কাছে রেখে দিতে বলছেন। আমি
সেই মত করে যাচ্ছি, সতুর কাছে এসে থেমে গেলাম। সতুও যেন লজ্জা পেয়ে উঠে দাঁড়ালো,
একটু সরে গেল। আমি কাজ সারা হয়েছে ভেবে থেমে গেছি, কাকা ছাড়লেন না। আমাকে বাধ্য করালেন
আমার একবয়সী বন্ধু, ক্লাস সিক্সে উঠে পড়া ছেড়ে দেওয়া একটা হাফপ্যান্ট পরা বামুনকে
প্রণাম করতে। রাগটা কাকার ওপর যত হল, সতুর ওপর হল তার থেকে বেশী। এই ঘটনা অন্য
বন্ধুরাও দেখেছিল। দেখে হেসেছিল। ওখান থেকেই সতুর হরুঠাকুর নামকরণ। হরু মানে ছোট, আর
ঠাকুর বলতে পুরুত। বাচ্চা পুরুত।
সব চেয়ে রাগের এবং অপমানের ঘটনাটা ঘটেছিল তার দু বছর আগে। বন্যার সময়। প্রত্যেক
বছর বর্ষায় আমাদের পুরো পাড়াটা জলে ডুবে যেত। প্রত্যেক ঘরে জল ঢুকত। প্রায়
প্রত্যেকটি পরিবার বাড়ি ছেড়ে স্কুল কলেজে আশ্রয় নিত। আমরা ছোটরা এতে আপত্তির কিছু
দেখতাম না। কয়েকদিনের জন্য একটা পাকা বাড়িতে থাকব আর ইলেকট্রিকের আলো জ্বালব, পাখা
চালাব, তাতে খারাপ লাগবে কেন? কিন্তু বড়দের দেখতাম,
কেমন একটা অসহায় অপমানে মুখ থমথম করছে। বিশেষ করে মা-র খুব অপছন্দ ছিল আশ্রয়
শিবিরে গিয়ে দুটো তিনটে পরিবারের সঙ্গে ঘর ভাগাভাগি করে থাকা। বাবা
অবশ্য বলতেন, উদ্বাস্তু হয়ে এসেছ। মান অপমান ভাবলে ভাত জুটবে না!
সে বছর আমি একটু বড় হয়ে গেছি। বোধহয় ক্লাস সেভেন। কাছাকাছি যে স্কুল-বাড়িটাতে
আমাদের জন্য আশ্রয় শিবির খোলা হয় তার কোন ঘরটি কেমন আমার জানা। সেই বছর জল বাড়তে
শুরু করলে আমি খুব তক্কে তক্কে ছিলাম। এদিকে ঘরে জল ঢুকছে আর ওদিকে আমি খোঁজ রাখছি
স্কুল বাড়িতে শিবির কখন খোলা হয়। খুলতে না খুলতেই আমি দৌড়ে গিয়ে একটা ছোট রুম দখল
করে বেঞ্চগুলো জড়ো করে তার ওপর একখানা চাটাই পেতে ঘরটা দখল করে নিলাম। ওই ছোট রুমে
একটা পরিবারই থাকতে পারে। আমি জানি শিবিরে জায়গা দখল এভাবেই হয়, এর আর আলাদা নিয়ম
কিছু নেই। বাড়ি গিয়ে মহানন্দে সবাইকে বললাম, এবার আমরা আলাদা একটা রুমে থাকবো। মা
খুব খুশী হল। আমি কিছু চাদর-বালিশ, মা আর ভাই-বোনকে নিয়ে চলে এলাম স্কুলে। বাবা বাসন
কোসন নিয়ে ঘরে তালা দিয়ে পরে আসবে। স্কুলে এসে সেই ঘরে ঢুকে বিছানা সাজিয়েছি, একজন
কর্মকর্তা এসে বললেন, এই, তোমরা এ-ঘরে নয়, তোমরা অন্য জায়গায় যাও। সেই
একটুখানি বড় হওয়া আমি মিনমিন করে বললাম, আমি তো আগে এসেছি, আগে দখল নিয়েছি। দাদাটা
বিরক্ত হল। বলল, দখল নিয়েছিস মানে? এটা কি দখল নেওয়ার জিনিস? তাড়াতাড়ি যা নইলে সব
জায়গা বিলি হয়ে যাবে। বারান্দায় থাকবি তখন। আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। আমার
কান্না পাচ্ছিল। ঘোমটার আড়ালে মা-র মুখ দেখতে পাচ্ছি না। ভাই বোনেরা একবার আমার
দিকে আর একবার মা-র দিকে তাকাচ্ছে। অভিমানে ঠোঁট ভারী করে আমি আমার দখল ছেড়ে অন্য একটা
ঘরে জায়গা ভাগাভাগি করতে চলে যাই। কিন্তু একটু পরে যখন দেখলাম ওই ছোট ঘরখানা সতু
আর ওর মা’র জন্য বরাদ্ধ হয়েছে, তখন আমার মুখ হা হয়ে গেল।
বড় হয়ে বুঝতে পারতাম এই টুকটাক ব্যাপারগুলোর জন্য সতুকে দায়ী করা ঠিক নয়। কিন্তু
ছোট বয়সে এই সব কিছুর জন্য ওকেই দায়ী মনে হত। হারছি তো আমি সতুর কাছেই। এদিকে প্রত্যেকবার
স্কুলের পরীক্ষার পর আমরা যখন পাশের আনন্দে হট্টগোল করে বাড়ি ফিরছি, তখন সতুর মলিন
মুখখানা দেখে আমাদেরও মনখারাপ হত। কারণ, তখন ওর মুখে সেই চওড়া হাসিটা থাকতো না!
স্মৃতি থেকে মুছেই গিয়েছিল সতু। আজ তাকে অন্য চেহারায় দেখার পর পুরনো
স্মৃতিরা সব হুড়মুড় করে মনে আসছে। আর সেই সঙ্গে পুরনো ক্ষতর জ্বলুনিও।
[দুই]
অনেকে বলে, আমি মদ খাওয়ার কৌশল জানি না।
ঠিকই বলে। আমার মদ খাওয়া মানেই হচ্ছে মদের ওপর হামলে পড়া। একটু রয়ে সয়ে, একটু
তারিয়ে তারিয়ে যারা খেতে পারে তারা বেশ অনেকক্ষণ ধরে টেনে যায়। আর আমি তিন পেগেই
বেসামাল। আমার কি তিন পেগ হয়ে গেছে? না কি এটা দু নম্বর? আর, এই পেগ পেগ করছি কেন
আমি? গেলাস বললেই ঠিক হয়। খাচ্ছি তো দেশী মাল। হরুঠাকুর দেশী মাল খায় এটা জানতাম
না। খুব সার্টিফাই করল, এক নম্বর
খাঁটি। খেয়ে দেখ। খেতে অবশ্য খারাপ লাগছে না। তবু
কেমন ইজ্জতে লাগছে। আমার তো একটা স্ট্যাটাস আছে। ব্যাটা সতু
আমার স্ট্যাটাস ঘেঁটে দিল। হাত বাড়িয়ে স্টিলের প্লেট থেকে একটা
কাজু বাদামের দানা খুঁটে মুখে পুরলাম। এটা বেশ ভালো লাগছে। মদের বেলায় যাই হোক,
চাটের বেলায় সতু ঠাট-বাট বজায় রেখেছে। আলাদা আলাদা প্লেটে দু রকমের দামী চানাচুর
আর কাজুবাদাম সাজানো আছে টেবিলে। অন্য প্লেটে নুন মেশানো আদাকুচি, এটা দেশীর
সম্মানে।
কিন্তু গেল কোথায় সতুটা? টয়লেট থেকে আসছি, বলল। কতক্ষণ হল? নাকি বেশী ক্ষণ
হয় নি! আমারও ভীষণ পেচ্ছাপ পাচ্ছে। কিন্তু
কোথায় যাবো? আমি তো জানি না এই গ্যারেজের কোথায় সতুর টয়লেট। কোথায়
আর হবে? ভারী তো গ্যারেজ। সন্ধেবেলা ঢোকার সময় কারেন্ট ছিল না। সতুর অফিসে মোম
জ্বলছিল। সেই আলোর রেখা ধরে এগিয়ে ওর অফিসে ঢুকেছি। তখন যেন দেখলাম দাঁত বার করা কঙ্কালের
মত তিন চারটে গাড়ি একদিকে পড়ে আছে। আরেকদিকে কিছু মেশিন পত্র। আহামরি
কিছু নয়। পেচ্ছাপ করার জন্যে যে কোনও একদিকে গেলেই হল। সতু হয়তো তাই যায়। কিন্তু ওর
আর আমার স্ট্যাটাস তো এক নয়। ও কি আমার মত অফিসার? আমি বেরিয়ে এলাম এবং আন্দাজে এক
জায়গায় দাঁড়িয়ে কাজ সারলাম। কে আর দেখছে।
শহরের বাইরের দিকে এই জায়গাটা। রিকশা-ওলাকে রাস্তার নাম আর মোটর গ্যারেজের
কথা বলতে মাথা ঝাঁকিয়েছিল। তারপর যেখানে নামিয়ে দিল সেখানটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। আশপাশে
বাড়িঘর আছে কি না বোঝা যাচ্ছিল না। রিকশার এক চিমটে আলোয় গ্যারেজ গ্যারেজ চেহারাটা
চিনতে পারি। পেট্রল মোবিলের বিচিত্র গন্ধ নাকে লাগছিল। মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে আমি
ঢুকে পড়ি। দেখি একটা ঘরে মোমবাতি জ্বলছে। আলোর রেখা ধরে এগিয়ে সতুর
অফিস ঘরে পৌঁছে গেলাম। ঢুকতেই সতু চোখ তুলে তাকিয়েছিল। হেসেছিল। হাসিটা যেন
ছোটবেলার হাসির মত চওড়া হতে গিয়েও হঠাৎ আটকে গেল। যেন ছোটবেলাটা ঝিলিক দিয়েই
লুকিয়ে পড়ল। আয়, বোস। সতুর সামনে তেলকালি মাখা পোষাকে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। কিছু
একটা কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিল সতু। আমি চেয়ার টেনে বসে চারপাশে চোখ রাখি। বেশী আসবাব
নেই ঘরে। একটা আটপৌরে কাঠের টেবিল, কয়েকটা চেয়ার, স্টিলের একটা খাটো আলমারি। একটা
কাঠের শেলফ থেকে কাগজপত্র উপচে পড়ছে। এক কোনে কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার একটার উপর একটা
করে তুলে রাখা। সতু এবার লোকটিকে বলল, ঠিক আছে, তুই যা। গেটটা টেনে দিয়ে যাবি।
লোকটা বেরিয়ে গেল। সতুকে বললাম, বেশ গরম পড়েছে। সতু
একটা হাতপাখা এগিয়ে দিল।
আরও কিছুক্ষণ টুকটাক কাজ সারল সতু। সঙ্গে কথাও হচ্ছিল। এক সময় টেবিলের ওপর
থেকে কাগজ পত্র সরিয়ে আলমারিতে রাখল। তারপর আলমারি থেকেই মদের বোতল, গেলাস বের
করল। স্টিলের প্লেট এবং চানাচুর, কাজুর প্যাকেট বের করল। প্লেট সাজাল। আদার টুকরো
বের করে ছুরি দিয়ে কুচি কুচি করে কাটল। গ্লাসে মদ ঢালল। একটা গ্লাস আমার দিকে বাড়িয়ে
দিয়ে বলল, চিয়ার্স। জিজ্ঞেসও করলো না আমি মদ খাই কি না। দেশী মদ দেখে বোধ হয় আমার
চেহারায় একটু নাক সিটকানো ভাব ফুটেছিল। হতেই পারে। ও সাফাই গাইল, খুব ভালো জিনিস।
এক নম্বর। খেয়ে দেখ। আমিও নির্বিবাদে গ্লাস উঠিয়ে চুমুক দিলাম। প্রাথমিক ঝাঁঝটা কাটলে
মনে হল, খাওয়া যায়। প্রথম এক দু পেগে কথাবার্তা বিশেষ জমছিল না। এত বছরের ব্যবধান।
একজন আরেকজনের জীবনের গত কুড়ি পঁচিশ বছরের কিছুই জানি না। কী নিয়ে কথা বলব। কোনও
পুরনো সূত্র ধরে টুকটাক কথা উঠেছে। শেষ হলে আবার নতুন সূত্রের অপেক্ষায় নিঃশব্দে চুমুক
চলেছে গ্লাসে। আমার কথা জানতে চাইলো। আমি একটু জাঁক করেই বললাম, অফিসার পোস্টে আছি।
ছেলে মেয়ে পড়াশোনায় ভাল, ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড হয়। একটু জায়গা কিনেছি। তবে বউ
চাইছে, জায়গা বিক্রি করে ফ্ল্যাট কিনি। এটুকু বলে আমার মনে হল আমি বেশী বলে ফেলছি।
সতুর কথা আগে শুনি। তারপর দরকার মত খাপ খুলব। যতটুকু বললাম, সতু মন দিয়ে শুনেছে। খুঁটিয়ে
কিছু জিজ্ঞেস করে নি। ছেলেবেলার বন্ধুরা কে কোথায় আছে, কী করছে, সে সব খোঁজখবর হল।
পুরনো কিছু কথা মনে করে কয়েক চোট হাসাহাসিও হল। এক
সময় কারেন্ট চলে আসায় আলো জ্বলল এবং ফ্যানও ঘুরতে শুরু করল। ততক্ষণে সতুর এক নম্বর
খাঁটী মদ বোধহয় আমার মাথার দখল নিয়ে নিয়েছে। তাই শুধুমাত্র আলো আর পাখা চালু হয়েছে
বলেই আমার হঠাৎ মনে হল, সন্ধ্যাটা বেশ জমে গেছে। আমি অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম সতুর
বিষয়ে শুনবো বলে, আর সতু কেবল আমার কথার ছোট ছোট জবাব দিয়ে যাচ্ছিল। বিয়ে করেছে। দুটো
ছেলে। এই গ্যারেজটা ওর নিজের। শুধু বাড়তি জানালো, ওর ছেলেরা পড়াশোনায় ভালোই, আর
খুব স্মার্ট। মাস্টারমশাইরা খুব পছন্দ করেন। পড়াশোনা ওদের মা-ই দেখে। আরও জানালো,
ওর শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয় স্বজনরা বেশ নামী দামী। জানালো এই শহরের অনেক অফিসের
কর্তাদের সাথে ওর ভালোই দহরম মহরম। এসব শুনে আমার মনে হল সতুটা বেশ চালবাজি শিখে
গেছে। আমি যা জানতে চাই, ওর এই আগাপাশতলা বদলে যাবার ইতিহাস, সেটা বলছে না। আলফাল
বকে যাচ্ছে। দু একবার খুঁচিয়ে দেখলাম। তেমন কাজ হল না। তারমধ্যেই একবার বলল,
পেচ্ছাপ করে আসি। আর সেই যে গেছে, ফেরার নাম নেই। আমি অপেক্ষা করে করে হাতের
গেলাসটা শেষ করেছি। নতুন করে আর ঢালি নি। ও আসুক, একসঙ্গে ঢালবো। বুঝতে পারছি আমার
চোখের পাতা ভারি হয়ে এসেছে। কথা বললে নির্ঘাত কথা জড়াবে। জড়াক। মাথাটা চালু রাখতে
হবে। একসময় তো হরুঠাকুর শুরু করবে তার আত্মকথন, সেটা যেন পুরোপুরি মাথায় ঢোকাতে
পারি। কিন্তু গেলে কোথায় বাবা হরুঠাকুর? আমাকে একা ফেলে?
- এইতো এসে গেছি।
পেছন থেকে সতুর গলা। আশ্চর্য, মনে মনে একটা কথা বললাম। হরুঠাকুর কী করে তার
সাথে কথা মিলিয়ে জবাব দিল? কি জানি, আমার বোধ হয় নেশা হয়ে গেছে। হরু ঠাকুরের হাতে
একটা হট-কেস জাতীয় কিছু। সেটা খুলে টেবিলে রাখল। চিকেনের একটা মাখো-মাখো আইটেম।
সতু সেই পাত্রে দুটো কাঁটাচামচ গুঁজে দিয়ে বলল, খা, আমার বউ বানিয়েছে। তার মানে
বেটা পেচ্ছাপ করতে বেরিয়ে বাড়ি চলে গেছিল? আমি জিজ্ঞেস করলাম, যে কথাটা আগেই
জিজ্ঞেস করার ছিল, বাড়ি কোথায় করেছিস। দূরে নয়। এখান থেকে রিক্সায় পাঁচ সাত মিনিট।
তুই কিন্তু আজ আমার বাড়িতে খাবি। বউ বলেছে তোকে নিয়ে যেতে। আমি হাউ মাউ করে উঠলাম-
না না, ওসব ঝামেলা করিস না। আমার বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করবে। আরে দূর, কিচ্ছু হবে
না। ফোন করে বলে দে। ছোটবেলার বন্ধু শুনে বউ বলল না খাইয়ে ছাড়বে না। চল না দেখে
আসবি। আমি আরও দু একবার আপত্তি জানালাম। কিন্তু আসলে তো আমি যেতেই চাইছি, সতুকে
দেখতে চাইছি তার চালচিত্র সহ। তাই বোধহয় আমার
গলার স্বরে জোর ছিল না। কে জানে, নাকি আমার নেশা হয়ে গেছে। সতু তার নিজের চেয়ারে
আরাম করে বসল। গেলাসে নতুন করে মদ ঢালল। আমি হট কেস থেকে কাঁটাচামচে করে চিকেনের
একটা পিস একটু গ্রেভি সহ তুলে এনে মুখে পুরলাম। আর অমনি ঝোলের একটা থকথকে টোপা টুপ
করে আমার শার্টে পড়ে গেল। মনে মনে বলে উঠি, ধুস্শালা। নাকি, এটাও শব্দ করে বললাম?
কে জানে।
সতু একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বেশ খানিকটা মদ মুখে টেনে নিল, কিন্তু গিলল না।
ঠোঁট শক্ত করে আটকে রেখে অনেকক্ষণ এক দৃষ্টিতে টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর
পুরোটাই এক ঢোকে গিলে আমার দিকে তাকাল। চশমার ভেতরে সেই টুনি লাইট জ্বলছে। আমি ওর
এই মদ গেলার ভঙ্গি দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি। এই যে কিছুটা মদ মুখে টেনে নেওয়া,
কিছুক্ষণ ধরে রাখা, এক ঢোকে গিলে ফেলা, তারপর এ ভাবে তাকানো, আমি বুঝতে পারছি এ
ভাবেই ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়। কায়দাটা আমাকে শিখতে হবে। কিন্তু সতু এটা কোত্থেকে শিখল?
- খুব আশ্চর্য হয়েছিস! তাই না! আমাকে দেখে! সেটা আমি তোর চেহারায় পড়ে
নিয়েছি। অনেকদিন পর দেখছিস তো, তাই বদলটা চোখে লাগছে। যারা চোখের ওপর দেখেছে তাদের
চোখ সওয়া। তবে সবাই যে সব টুকু জানে তা নয়। বলব তোকে সব। বলব বলেই তো ডাকলাম।
ছোটবেলার বন্ধু। অনেক কিছু খুলে বলা যায়।
চেয়ারে হেলান দিয়ে সতু যেন কেমন দরাজ হচ্ছে। দৃষ্টি আমার মাথার উপর দিয়ে
কোথাও। আমি বুঝতে পারছি, এই যে এভাবে কারো মাথার ওপর দিয়ে তাকানো, বা অন্য দিকে
তাকিয়ে কথা বলা, এতে সামনে বসে থাকা লোকটি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। মনে মনে খাটো হয়ে
যায়। আমি খাটো হয়ে গেছি। সতু এখন আমার চেয়ে একটা উচ্চতর অবস্থানে পৌঁছে গেছে। এই
কায়দাটাও আমাকে- যা:। ঝুপ করে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। কারেন্ট চলে গেছে। ঈশ। সতুটা সবে
মুডে এসেছিল, তাল কেটে গেল। আমি বলে উঠলাম, কী যে যন্ত্রণা। অন্ধকারে সতুর গলা
পেলাম, আরে, এটাই করিমগঞ্জ। বুঝলি? এটাই হচ্ছে– বলে, কথা অসম্পূর্ণ রেখে উঠে গিয়ে
মোমবাতি জ্বালিয়ে আনল। এনে ঠক করে টেবিলের উপর রেখে তার বাক্য শেষ করল, -করিমগঞ্জ।
আমার তখন মনে হল সতুরও কথা জড়াচ্ছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের এ সব গা সহা।
মোমবাতির অস্পষ্ট আলো এখন আমাদের মুখে। আমাদের ছায়া পড়েছে চারদিকের দেয়ালে,
ঘরের মেঝেতে। সতুর পুরু চশমার কাচে মোমবাতির শিখা কাঁপছে। ঘরে
ফ্যানের শব্দও নেই। আমি সতুর দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছি। একটা দেয়ালঘড়ির টিকটিক
শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু সেটা চোখে পড়ে নি। সতুর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে সেটা খুঁজতেও
ইচ্ছে করছে না। আরও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সতু। তারপর আমার দিকে তাকাল। আমার মনে হল
আমার সমগ্র মনোযোগ ও মুঠোয় পুরে নিয়েছে। এভাবেই তো শুরু হয় কথকতার আসর। না কি, আমার
নেশা হয়ে গেছে? কে জানে। হরু ঠাকুর শুরু
করল। থেমে থেমে। মাঝে মাঝেই অনেকটা সময় চুপ করে থেকে। চুপ করে এদিক ওদিক তাকিয়ে
থেকে। কিন্তু কথা বলার সময় একেবারে সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখে।
[তিন]
- সেই গ্যারেজ দিয়েই শুরু করি। মালিকটা, শালা খাটাতো খুব। একেক ঘাড়ে পিঠে
ব্যথা করত। কিছু বলতে পারতাম না। ছোটবেলা থেকেই আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। কথা
বলতামই বা কার সঙ্গে? বাড়িতে ছিল একমাত্র মা। মা নিজেও কম কথা বলত। কাজের কথার
বাইরে কোনও কথা হত না আমাদের। আত্মীয় স্বজন কেউ আসতো না আমাদের ঘরে। এক শুধু মামা
আসত। মামাও তেমন কাছে ডেকে কথা বলার মানুষ নয়। মাসীদের কথা শুনেছি কেবল, দেখিনি
চোখে। ওদেরও অবস্থা ভাল নয়। বাবার দিকের আত্মীয়রা কেন জানি না, মাকে অপছন্দ করতেন।
বাবা মারা যেতে ওরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কোনও যোগাযোগ ছিল না। কথা বলার লোক ছিলি
তোরা। আমার বন্ধুরা। তোদের সাথেও কথা আর তেমন বলতাম কই। বলার কিছু থাকলে এক শ্বাসে
বলে শেষ করতাম। আর এখন কী রকম কথা বলছি?
আমি সতুর দিকে নিবিষ্ট-ভাবে তাকিয়ে ছিলাম। প্রশ্নটা যে আমাকেই করা হয়েছে, বুঝতে
আমার একটু সময় লাগল। ও তাকিয়ে আছে দেখে বুঝতে পারি উত্তরটা আমাকেই দিতে হবে। তখন
হঠাৎ সচেতন হয়ে বলে উঠি, আরে সকাল থেকে তো সেটাই ভাবছি। এ সতু কি আমাদের সেই সতু! আমার
কথায় সতু হাসল না। আবার সেই এক অন্যমনস্কতায় হারিয়ে গিয়ে শুরু করল,
- এটাই হল ব্রাহ্মণত্ব। এটা নাকি স্রেফ ভেতরে থাকলেই হয় না। এটাকে নাকি
ভেতরে টের পেতে হয়। তখন কি আর এসব জানতাম? ওই সময় গ্যারেজের মালিক তো মালিক, অন্য
মেকানিকরাও আমাকে দিয়ে যেমন পারে খাটিয়ে নিত। মালিককে কিছু বলতে ভয় পেতাম। যদি
ছাড়িয়ে দেয়। কাজ শিখতে গিয়ে দেখলাম, কলকব্জার কারিগরিতে আমার বেশ মন বসে। তাই
কাজটা মন দিয়ে শিখতে আরম্ভ করি। পয়সা কড়ি বলতে বছর খানেক শুধু হাত খরচ দিত। বিড়ি
খাওয়া শিখেছি। কিন্তু যে হাতখরচা পাই, তাতে বিড়ি খেতেও টানাটানি হয়। একটু
আধটু কাজ শেখার পর মাইনে দিত। সেটা এতই সামান্য যে বাড়িতে বিশেষ
কিছু দিতে পারি না। ওদিকে মামার সংসার বড় হয়েছে। আগের মত সাহায্য করতে পারেন না।
কষ্টে সৃষ্টে আমাদের চলছে। তিন চার বছরের মধ্যে মেকানিক হিসেবে আমি বেশ নাম করে
ফেলি। বেতন যদিও অল্প বেড়েছে, ওদিকে জুটেছে মদ খাওয়া। গ্যারেজের মালিক সন্ধ্যা হলেই
মদ নিয়ে বসতো। এই যেমন এখন আমি বসি। একটু পুরনো হবার পর আমাকেই পাঠাতো মদ আনতে। প্রসাদ
জুটত। এভাবেই শুরু। তারপরে আস্তে আস্তে শুরু হল পকেটের পয়সায় কেনা। আমার বখে যাবার
তখন শুরুয়াৎ। পালায় পার্বণে একটু বেহেড হয়ে বাড়ি ফিরলে মা আমাকে দেখে কেমন ভয় পেয়ে
যেত। নিঃশব্দে কাঁদত। মা তো বকতেও পারত না। এই রকম সময়, একদিন আমার এক দূর
সম্পর্কের জ্যাঠা এসে আমাদের ঘরে উঠলেন।
সতু গ্লাস হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিল। যন্ত্রচালিতের মত আমিও। আমার চাবি এখন
সতুর হাতে।
- আগে কোনও দিন দেখিনি, এমন কি শুনিও নি ওঁর কথা। বাংলাদেশে বাড়ি। সচ্ছল
সংসার। কাজকর্ম বিশেষ কিছু করতে হয় না। নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান। ঘুরতে ঘুরতে কোথায়
আমাদের খবর পেয়ে এসেছেন দেখা করতে। বয়স অনেক, কিন্তু শক্ত পোক্ত শরীর। চেহারাখানা
দেখার মত। টকটকে ফর্সা রঙ, চুল প্রায় সবই শাদা। মাঝারি হাইট। কপালে আবার একটা লাল ফোঁটা।
অচেনা লোকও ওকে দেখলে মাথা নোয়াবে। উনি
এসেছিলেন দিনের বেলা। আমি দেখতে পাই সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পর। সেদিনও মদ খেয়েই বাড়ি
ফিরেছিলাম। ঘরে ঢুকে ওকে দেখে কেমন থতমত খেয়ে যাই। আমাদের এই ভাঙ্গা ঘরে এমন গুরুদেব
মার্কা কে রে বাবা! মা পরিচয় করিয়ে দিতে কোনও মতে দূরত্ব বজায় রেখে প্রণাম করে উঠে
দাঁড়ালাম। উনি ফোকাস মারা চোখে আমাকে দেখছিলেন। ভয় পাচ্ছিলাম, হয়তো এখুনি পৈতা বের
করে অনন্ত নরকবাসের অভিশাপ দিয়ে দেবেন। উনি সেরকম কিছু করলেন না। বললেন, যাও স্নান
সেরে এসো। আমি আড়ালে মা-কে জিজ্ঞেস করলাম, খাওয়া দাওয়ার কি করেছো। মা জানালেন,
বসন্ত বৈরাগীর ঘর থেকে চাল ডাল তেল সব্জীর সিধে পাঠিয়েছে। বসন্ত বৈরাগীর বৌ ডালায়
করে এনে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে আশীর্বাদ নিয়ে গেছে। চেহারার গুণ। যাই হোক, সেই রাতে
আর বিশেষ কথা বার্তা হল না। বসন্ত বৈরাগী ওর একটি ঘর খালি করে দিয়েছে উনি শোবেন
বলে। খাওয়া দাওয়া করে উনি শুয়ে পড়লেন। রাতে আমার ভালো ঘুম হয় নি। ওই ধারালো
চেহারাটা মনে পড়ছিল। আর জীবনে এই প্রথম আমার মনে হল যে আমার জীবনেও ভাল কিছু আছে। এমন
একজন জ্যাঠা আছেন আমার, এটা তো বেশ জাঁক করে বলার মত। আর জ্যাঠা বলতে জ্যাঠা? মা বললেন,
এক রক্তের। আমার যে সব সময় মনে হত বড়মুখ করে কাউকে বলার মত কিছুই আমার নেই, এবার
মনে হল আছে তো। এমন একজন জ্যাঠা আছেন, এটা কি কম কিছু? ব্রাহ্মণ বলে এমনিতেই কিছু
খাতির আমাদের জুটে যেত। তবে সেগুলো আমার মনে হত কেমন যেন দয়া দাক্ষিণ্য। অনুকম্পা
না কী যেন বলে না? কী রে, শব্দটা ঠিক বললাম তো?
সতু আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল। আমি উত্তর দেবো কি! আমি তো নিজেই নিজেকে
প্রশ্ন করছিলাম, শব্দটা ঠিক শুনলাম তো!
- সকালে উঠতে দেরী হল আমার। উঠে দেখলাম সমস্ত ঘর খুব সুন্দর করে নিকানো
হয়েছে। মা যেন সেদিন একটু বেশী নিষ্ঠা-বতী। আমি মুখ ধুয়ে বিছানায় বসে স্টিলের
গ্লাসে চা খাচ্ছিলাম। উনি এসে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর স্নান শেষ। আহ্নিক টাহ্নিকের কথা
বলতে পারবো না। তবে কপালে টাটকা সিঁদুরের ফোঁটা টকটক করছে। মা যে বিছানা পরিপাটি
করে গুছিয়ে পরিষ্কার চাদর পেতে রেখেছিল,
তার উপর আসন পিড়ি হয়ে বসলেন। ওঁকে ঢুকতে দেখে আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। উনি বললেন,
বস। আমি বসলাম। নানা কথা জিজ্ঞেস করলেন উনি। পড়াশোনার কথা, গ্যারেজের কাজকর্মের
কথা। কেমন মাইনে পাই, উন্নতির সম্ভাবনা কী, এই সব। আমি তো গুছিয়ে কিছুই বলতে পারি
না, যেমন তেমন ভাবে উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম। উনি বললেন, ভাল কাজ শিখেছ তো অন্য
গ্যারেজে চলে যাও না কেন? সে রকম তো কয়েক জন টোপ দিয়েই রেখেছে আমাকে। কিন্তু যার
হাতে কাজ শিখলাম, ওকে ছেড়ে যাওয়াটা কেমন গদ্দারি মনে হত। আত্মীয় স্বজন কে কোথায়
আছেন জানি কি না জিজ্ঞেস করায় আমি দুদিকে মাথা নাড়লাম। সন্ধ্যা আহ্নিক নিয়মিত করি
কি না, আমি দুদিকে মাথা নাড়লাম। তারপর একসময়, একটু ফাঁক পেয়ে উঠে পড়লাম। আমার
গ্যারেজে যাবার সময় হয়ে গেছে।
- সে রাতে আর মদ খেয়ে আসি নি। এসে দেখলাম উনি সেই সকালের জায়গাটিতে একই
ভঙ্গীতে বসে। আমি স্নান করে এসে বসলাম। উনি আমার দিকে তাকালেন। তারপর বিনা ভূমিকায়
বললেন, তোমার বিয়ে দেব। আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাই। বলে কি বুড়োটা? আমি করবো
বিয়ে? উনি কি আমাকে পরীক্ষা করছেন? বুঝতে না পেরে আমি বোকার মত হেসে বলেছিলাম, আমি
আবার বিয়ে করব কি? কেন? তুমি বিয়ে করবে না কেন? আমার মুখে উত্তর যোগাচ্ছিল না।
বললাম, আমার সঙ্গের ছেলেরা কেউ বিয়ে করে নি এখনও। উনি জবাব দিলেন, কে করেছে আর কে
করে নি সেটা বিচার্য নয়। তোমার প্রয়োজন, তাই তুমি বিয়ে করবে। এ কথায় আমি লজ্জা
পেয়ে গেলাম। মেয়েদের ব্যাপারে তখন আমার ভেতরে একটু খাই খাই আছে। উনি কি সেটা টের
পেলেন? তাই কি বলছেন, আমার বিয়ের প্রয়োজন হয়েছে? আমি মাথা তুলতে পারছিলাম না। উনি
আবার বললেন, বিয়ের বয়স তোমার হয়েছে। তোমার প্রয়োজনে তুমি বিয়ে করবে। এতে অন্যদের
কথা আসে কি করে? কী উত্তর দেব ভেবে না পেয়ে বললাম, যা মাইনে পাই, মা ছেলেরই চলে
না। উনি বললেন, রোজগার বাড়ালে বাড়ে। বাড়ানোর তাগিদ চাই। বিয়ে করলে সেই তাগিদ আসবে।
- আমি আর জুতসই জবাব পাচ্ছিলাম না। মা-কেও দেখতে পাচ্ছি না। মা কি জানে এই
পরিকল্পনার কথা? নাকি মা-ও এই ষড়যন্ত্রের শরীক? একবার ভাবলাম, মিছিমিছি দুশ্চিন্তা
করে লাভ নেই। উনি যা-ই ভাবুন, আমাকে মেয়ে কে দেবে? আবার ভাবলাম, বলা যায় না। কোথায়
কোন গরীব বামুন মেয়ের বিয়ে দিতে পারছে না, হয়তো জেনে বুঝেই উনি আমার ঘাড়ে ফেলতে
চাইছেন। ব্যাপারটা আটকাতে হবে। কিন্তু ওর সামনে মুখ খুলতে পারছি কই? আমতা আমতা করে
বললাম, চাল নেই, চুলো নেই, শিক্ষাদীক্ষা নেই, আমার কি বিয়ে করা উচিত? উনি বললেন,
এসব কোনও কথা নয়। আসল কথা রক্ত।
- কথাটা ঠিকঠাক বুঝতে না পেরে আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। উনি কণ্ঠস্বর একটু
নরম করে বললেন, তুমি ব্রাহ্মণ সন্তান। তোমার রক্তে ব্রাহ্মণত্ব আছে। আর এই রক্তই আসল।
তবে তুমি সংস্কার পাও নি। ভাগ্যদোষে তুমি জন্ম থেকে এমন পরিবেশ পাও নি যা তোমাকে
ব্রাহ্মণ্য সংস্কার দিতে পারত। তুমি উপবীত-ধারী, তার বাইরে তোমার চলাফেরা
কথাবার্তায় ব্রাহ্মণত্বের পরিচয় নাই। এমন কি তুমি যে বর্ণশ্রেষ্ঠ, সেই উপলব্ধিও
তোমার নাই। তোমার উচ্চারণ অস্পষ্ট, অসংস্কৃত। চণ্ডালের সঙ্গে ফারাক নাই। এমন
উচ্চারণ আর এমন লালিত্য-হীন বাচনভঙ্গিতে তোমার বক্তব্যে মানুষের প্রত্যয় জন্মাবে না।
তুমি মস্তিষ্কচালনা কর না। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ভুলে গিয়ে নিজেকে সব সময় ছোট করে রাখ।
এ রকম ভাবে তোমার কথার সুরে প্রত্যয় থাকে না। মনে রেখো, রক্ত অবশ্যই প্রধান।
কিন্তু রক্ত শুধুই অধিকার দেয়। সেই অধিকারকে প্রতিষ্ঠা দিতে হয় ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করে।
এই অর্জন তোমার জন্ম ও প্রতিপালন সূত্রে এমনিতে হওয়ার কথা ছিল। ভাগ্যদোষে তুমি
প্রয়োজনীয় পরিবেশ পাওনি। বিবাহ তোমাকে সেই পরিবেশ পরিজন দেবে। একটা আত্মীয়তার
বৃত্ত দেবে। তোমাকে সংস্কার জানতে দেবে। তোমাকে সেই সংস্কার আয়ত্ত করতে হবে। বিলম্ব
হয়েছে। আরও যত বিলম্ব হবে, কঠিন হবে তোমার কাজ। অনেক ভেবেই আমার এই সিদ্ধান্ত।
- কথাগুলো আমার মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু এটা বুঝতে পারছিলাম যে
কথাগুলো বেশ বাম্পার। কিন্তু যত ভাবছি তত আমি ভেতরে ভেতরে আঁতকে উঠছি। বিয়ে করতে
হবে? আমাকে? কিন্তু আটকাব কি করে? যে যুক্তিই সাজাচ্ছি, উনি যেন ধারালো তরোয়ালের
একেকটা কোপে ঘ্যাচাং করে কেটে দিচ্ছেন। শেষে প্রায় মরিয়া হয়েই আমি মগজ হাতড়ে যা যা
বলার মত পাই সব জড়ো করে এক তোড়ে বের করলাম। মোটামুটি এ রকম বলেছিলাম, - আমার অনেক বদভ্যাস।
আমার চেহারা, পোশাক-আশাক নিচু ক্লাসের। আমি সভ্য ভদ্র নই। ভদ্র মানুষের সাথে আমি
একপাতে বসি না। আমার বাড়ি ফিরতে দেরী হয়। কেউ জোর গলায় কিছু বললে আমার তোতলামি এসে
যায়...। আর কথা খুঁজে না পেয়ে ওঁর দিকে তাকাই, দেখি উনি স্থির দৃষ্টিতে আমাকে
দেখছেন। উনি আরও ক’ সেকেন্ড সময় দিলেন, যদি আমার ঝুলিতে আরও কিছু বোমা বারুদ থাকে।
তারপর ধীর স্বরে বললেন, এসব কোনও কথাই নয়। আসল কথা রক্ত।
- সেদিন বিকেলে উনি বিদায় নিলেন। আর তার কয়েকমাস পরে, তারই উদ্যোগে, রক্তের
সাথে রক্তের বিয়ে হয়ে গেল।
সতু বোতল খুলে গ্লাসে ঢালছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, কি রে, নিবি তো? আমি ওর
দিক থেকে চোখ না সরিয়ে পুতুলের মত উপরে নীচে মাথা নাড়লাম। সতু হাসল, সরু একটা
হাসি। তারপর আমার গ্লাসেও ঢালল। চুমুক দিলাম। মনে হল লোড শেডিংটা বেশ জমে গেছে।
সতুকে তাড়া দিলাম, তারপর? সতু সেই আগের মতই সময় নিয়ে একটা লম্বা চুমুক দিল।
তারপর বলল, যা বলার তা তো বললাম। আর সবই তো গল্পের ল্যাজা। এবার আমিও সতুর কায়দায়
একটা লম্বা চুমুক দিলাম। তারপর ওর মুখের দিকে পাওনাদারের মত তাকিয়ে বসে রইলাম।
- আর কি বলব। বিয়ে হয়ে গেল। বউ এল। আমার বউ, আজ তো নিজের চোখেই দেখবি, গরীব
বাপের মেয়ে ছিল। চেহারায় গরিবানার ছাপ ছিল। মুখে আবার বসন্তের দাগ। কিন্তু হাতে গুণ
ছিল। দারুণ সব সেলাই ফোঁড়াই জানত। সংসার
চালাতে জানত। আর, জানিস, পড়াশোনাতেও নাকি ভালো ছিল। মেট্রিক পাশের পর গরীব বাপ আর
পড়ায় নি। আমার মত একজন ক্লাস সিক্স, ইন্টু থ্রী, ইন্টু তেল মোবিলের সাথে বিয়ে দিয়ে
দিল। আর তার পরে পরেই কয়েকটা ঘটনা ঘটতে থাকল। এক, বসন্ত বৈরাগী একদিন ডেকে বলল,
বাবা, বিয়ে করেছো। বুঝতে পারি তোমাদের জায়গার অসুবিধা হচ্ছে। আমি একটা ঘর বাড়িয়ে
দেবো। তবে বাবা, ভাড়াটা একটু বাড়াতে হবে। আমি বললাম, কাকা, ঘর বাড়িয়ে দিন। আর ছটা
মাস আমাকে সময় দিন। তারপর ভাড়া বাড়ান। উনি রাজি হলেন। ওদিকে আমার গ্যারেজের মালিক
না চাইতেই আমার বেতন একসাথে বেশ কিছুটা বাড়িয়ে দিল। ভয় পাচ্ছিল, কে না কে বুদ্ধি
দেবে আর আমি অন্য ডালে উড়ে যাব। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পাড়ায় আমার গুণী বউয়ের সুনাম
ছড়িয়ে গেল। একে বালিশের ঢাকনা বানিয়ে দেয়, ওকে বিছানার চাদরে এমব্রয়ডারি করে দেয়।
ইনস্টলমেন্টে একটা হাত মেশিন কিনে নিল আর সায়া ব্লাউজ সেলাই করে দিব্যি সংসারের আয়
বাড়িয়ে ফেলল। আমি শুধু তাকিয়ে দেখলাম সংসারে বেশ একটা শ্রী ফিরে আসছে। আমাদের ছিল
মা-ছেলের পৃথিবী। এখন শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয় স্বজন নিয়ে আমারও অনেক নিজের লোক
হয়ে গেল। সবাই মিলে পরামর্শ দিল আলাদা গ্যারেজ করার। একদিনে হয় নি সেটা। প্রথম
একজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে, ওর পুঁজি আর আমার মেকানিক-গিরি। চলল কিছু দিন। তারপর
এই জায়গাটা নিলাম ভাড়ায়। এমনি পড়ে ছিল। একটু বাইরের দিকে। কয়েকজনের কাছ থেকে টাকা
ধার নিয়ে কিছু মেশিন পত্র কিনে বানিয়ে ফেললাম আমার নিজের গ্যারেজ। এর মধ্যে আমার বউয়ের
এক মেসো এলেন এখানকার এক সরকারী অফিসের ছোটকর্তা হয়ে। উনি ওদের অফিসের কাজকর্ম আমাকে
দিতে শুরু করলেন। কাজ বাড়ল। তারপর আমাকে সরকারী অফিসের দস্তুরটা ধরিয়ে দিলেন। কাজ
হবে না। বিল হবে। তারপর বাঁটাবাঁটি। অন্য কয়েকটা অফিসে নিজেই ঘোরাঘুরি করে লাইন
বানিয়ে নিলাম। ততদিনে আমি বেশ গুছিয়ে কথা বলতে শিখে গেছি। আমার সেই ধূলোরঙের পোশাক
পাল্টিয়ে পাজামা পাঞ্জাবি পরেছি। ব্যাস। আর কি। এরপর বাড়ি ঘর, টিভি, ফ্রিজ। হয়ে
গেলাম ভদ্রলোক। এখন আসুক তো কে আমাকে ছতর বতর বলবে! আমি এখন চক্রবর্তী এন্ড সন্স।
টেবিলে কনুই রেখে দু হাতের ঠেকায় থুতনি গুঁজে দিয়ে আমি সতুর দিকে তাকিয়ে
ছিলাম, তাকিয়েই রইলাম।
নিবি আর?
না:। আমি উঠে দাঁড়ালাম। এবং টাল সামলাতে টেবিলেই ভর দিলাম। সতু তাকিয়ে দেখল
একবার। আমি কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। আমার মনে হচ্ছে আমি কেমন একটা ঘোরের
মধ্যে আছি। নেশা চড়ে গেছে আমার। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, মোমবাতির ম্লান আলোয় সতু
টেবিল গোছাচ্ছে। আমি ওর জন্য অপেক্ষা না করে অন্ধকারে পা ফেলি। বুঝতে পারছি আমার
পা টলছে। পাশের অন্য একটা ঘরে মোমবাতি জ্বলছে। হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে কে একজন
দরজায় এসে দাঁড়াল। গ্যারেজের সামনের দিকটা এখন লম্বা টানা বাঁশের বেড়া দিয়ে
আটকানো। আমি অন্ধকারে সেই বেড়া হাতড়াই, খোলার চেষ্টা করি। ছেলেটা এগিয়ে এসে দুটো
বেড়া একটু ফাঁক করে ধরল, আমি বেরিয়ে রাস্তায়। এক চিমটে আলো নিয়ে একটা রিকশা
দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে রিকশা-ওলা নেমে দাঁড়াল হ্যান্ডেলে হাত রেখে। আমি ওর দিকে
মনোযোগ না দিয়ে অন্ধকারে এগোতে থাকি। সোজা হয়ে হাঁটা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন
টলে টলে যাচ্ছি। পেছন থেকে সতুর গলা শুনতে পাচ্ছি। কী যেন বলছে। কাকে বলছে? আমাকে কি?
আমি শোনার চেষ্টা করি না। হাঁটতে থাকি। চারদিকের অন্ধকারকে হঠাৎ মনে হল যেন রক্ত শুকিয়ে
কালো হয়ে আছে। রক্তের ভীষণ উচ্ছ্বাস চারদিকে। রক্তের ভীষণ উল্লাস চারদিকে। পিছনে রিকশার
টুং টাং, সতুর গলা, কি করছিস তুই? আমার বউ অপেক্ষা করছে। হ্যাঁ, মনে পড়ছে, আমি
চালচিত্র সহ সতুকে দেখব ভেবেছিলাম। কিন্তু তার দরকার আছে কিছু? আমি তো জেনেই গেছি,
আসল কথা রক্ত। এবং রক্তই প্রধান। অন্তত
রিকশাটা নিয়ে যা। অন্ধকারে অত দূর যাবি কী করে? কাদায় আমার পা আটকে যাচ্ছে। কাদা, নাকি
ডেলা পাকানো রক্ত, কে জানে। আমার তো নেশা হয়ে গেছে। রক্তের প্রবল কোলাহল কানে সয়ে
নিতে নিতে আমি পা বাড়াই। রক্ত যতই প্রধান হোক, আমি কি শালা আটকে পড়ে থাকব না কি
এখানে?
( ঈশান, বদরপুর, ২০১৫)
No comments:
Post a Comment