বাসি ফুল
- মলয়কান্তি দে
গন্ধরাজ ঘুম থেকে উঠেছিল, রোজ যেমন
ওঠে, কাক-ডাকা ভোরে। ওই সময় আকাশে আলো তেমন ফোটে না। কেবল ঘরবাড়ি, গাছপালা, মাঠ,
পুকুর ইত্যাদি চাপড়া চাপড়া ঠাহর করা যায়। কিন্তু আজ ক’দিন ধরে আকাশের চেহারা
অন্যরকম। মোষের মত কালো রঙের মেঘে সারাক্ষণ ছেয়ে আছে আকাশ। দিনরাত শুধু বৃষ্টি আর
বৃষ্টি। বৃষ্টি পড়ে পড়ে পচিয়ে দিচ্ছে চারদিক। বাঁশের দরজা সরিয়ে গন্ধরাজ বাইরে এল।
আকাশ আজও মেঘে ঢাকা। বৃষ্টি পড়ছে, তবে একটু ঝিমিয়ে। তেজ কমেছে যেন। বৃষ্টির ফোঁটা মাথায়
নিয়ে উঠানে নামল সে, তারপর চলে গেল বাঁশঝাড়ের দিকটায়। ফিরে এসে চোখে মুখে জল দিল।
গামছা দিয়ে গা-মাথা মুছে নিল। ভেজা হাওয়ায় একটা ঠাণ্ডা শিরশিরানি লাগছে গায়ে। ঘরে
ঢুকে এক টুকরো থান কাপড় গায়ে জড়িয়ে আবার বারান্দায় এল। বারান্দা বলতে মাত্র দেড়
হাত বাড়তি ভিটে। খড়ের চালাটাও সেই হিসেবে বাড়ানো। একটু সময় দাঁড়িয়ে থেকে কী করবে
ভেবে না পেয়ে গন্ধরাজ পিড়ি পেতে বারান্দায় বসল। রোজ যেরকম বসে। ঠাণ্ডা লাগছে, তাই
একটু কুচিমুচি লেগে বসেছে গন্ধরাজ। এই মুহূর্ত্যে কিছু করার নেই তার।
বৃষ্টি বাদলা না হলে এই সময় গন্ধরাজ
পায়ে পায়ে সারা বাড়ির আনাচ কানাচ হেঁটে বেড়ায়। ঘুরে ঘুরে দেখে, কোথায় আমগাছের একটা ডাল নুয়ে আছে, পুকুরে
যেতে আসতে মাথায় লাগছে, কাটতে হবে। ঘাটার খুঁটিগুলো নাড়া দিয়ে দেখে, একটার বোধ হয়
গুড়ি পচে গেছে, পাল্টাতে হবে। জবা গাছের একটা ডাল হয়তো কোনও কারণে মাজা ভেঙ্গে কাত
হয়ে আছে, তুলে ধরে বাঁশের কঞ্চির ঠেকা লাগিয়ে সোজা করে দেয়। মাঝে মাঝে বাড়ির
বাইরেও বেরোয়। মাটির রাস্তা ধরে এমনি এদিক ওদিক হাঁটে। কখনও কোথাও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে
থেকে চারপাশ খুব মন দিয়ে নিরীক্ষণ করে। ধানের চারার বাড় থেকে নালার জলের স্রোত, পুকুরে
মাছের ঘাই থেকে কারো ঘরের চালে চালকুমড়ো, যা কিছু চোখে পড়ে তার সবই অনেক সময়
লাগিয়ে দেখে। তার এই দেখার মধ্যে একটা প্রশান্ত, নির্লিপ্ত ভঙ্গী আছে। তার এই মুখ
জোড়া প্রশান্তির সঙ্গে তার ঈষৎ ছড়ানো, এবং একটু ফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁট দুটো এমন এক
সঙ্গতি তৈরি করেছে, যার জন্য ওকে সব সময়ই মনে হয় যেন হাসছে। যেন তার ভেতরটা সব সময়
ভরা পুকুরের মত টই টম্বুর। জাগতিক কোনও আনন্দের ব্যাপার যখন ঘটে, তখন সেই পুকুরে
রোদ পড়ে। আর যখন কোনও দুঃখ বেদনার কিছু ঘটে, তখন সেখানে ছায়া পড়ে, মেঘের ছায়া। পাঁচ
বছর আগে যেদিন তার বউ শৈলবালা মারা গেল,
দাহকার্য শেষ করে এসে এই একলা ঘরখানার বারান্দায় বসে ছিল গন্ধরাজ। সেদিনও
তার ঠোঁট-দুটো একই রকম, একটু ফাঁক আর দু পাশে একটু ছড়ানো ছিল। তার সেদিনকার মুখভঙ্গিকেও
হাসি হাসি মনে হতে পারে, তবে তা ছিল কেমন অন্যমনস্ক। এ ছাড়া অন্য সব সময়ই সে
হাস্যমুখ, আনন্দিত।
এই কাকভোরেও, কখনও কারও সাথে তার দেখা
হয়ে যায়। বরদাকান্ত কিম্বা অধীর কিম্বা অন্য কেউ। তারা কথা বলে, ভালা আছ নি বা,
কাকা। গন্ধরাজ তার হাসি মাখানো মুখে উত্তর দেয়, অয়, আছি। টাউনো গেসলায় নি এর মাঝে।
না-বা। কিতা করতাম গিয়া। আইজ কাইল আর শরীরে দেয় না। যদি কেউ মন খারাপের কথা কিছু
বলে, যেমন, -পুয়া ইগুরে আর বাচাইতাম পারতাম নায় বা। কুন্তা খায় না, খালি বিছ্নাত
পড়ি থাকে..., তখনও গন্ধরাজের মুখের ভঙ্গী একই থাকে, শুধু হাসিটা মনে হয় যেন বর্ষা-দিনের
রোদের মত ঝপ করে মরে গেল। গন্ধরাজের মুখের একটাই অভিব্যক্তি। একটা জীবন কাটাতে এর
বেশী অভিব্যক্তির তার দরকার হয় নি।
ভোরবেলার এই সব দেখাদেখি আর এই কদাচিৎ
আলাপচারিতার মধ্যেই এক সময় চারদিক ফর্সা হয়। তখন ঘরে ফিরে আসে গন্ধরাজ। এসে তার
চালাঘরের বারান্দায় পিঁড়ি পেতে বসে থাকে। বৃষ্টি না থাকলে, সে জানে, একটু পরেই বাঁশঝাড়ের
মাথায় সকালের করমচা রঙের রোদ এসে পড়বে।
গন্ধরাজের বয়স হয়েছে। দু বছর আগে হলে
এই ভোরবেলাই গন্ধরাজ বাড়ির নানান কাজে ব্যস্ত হয়ে যেত। কোথায় ঘরের একটা খুঁটি পাল্টাতে
হবে, কোথায় ভিটেতে আগাছা জন্মে গেছে, সাফ করতে হবে, জল নেমে গেছে বলে পুকুরের ধাপটা
একটু নামিয়ে বাঁধতে হবে, এই সব কাজে সকালটা কাটিয়ে, স্নান করে, পেট পুরে পান্তা খেয়ে
বেরিয়ে পড়ত সাড়ে আটটার ট্রেনের উদ্দেশ্যে। ট্রেন ধরতে পারলে ভাল। মামার গাড়ি। বিনা
পয়সায় পৌঁছে দেবে শহরে। তা নইলে বাস। বাসের কন্ডাক্টর মোটেও রেয়াত করে না। পুরো
ভাড়া উসুল করে। গাঁটের পয়সা গচ্চা যায়। তারপর শহরে পৌঁছে হয়তো কোথাও কাজ ধরা আছে, গামছা
পরে কাজে লেগে যাওয়া। আর নইলে দা হাতে এ-বাড়ি ও-বাড়ি কাজের খোঁজ করা। কাজ ধরা
থাকলে দা-খানা রেখে আসতে হয় গৃহস্থের বাড়ি, জামিন হিসেবে। যাতে পরের দিন এক
গৃহস্থকে লটকে রেখে অন্য গৃহস্থের কাজে লেগে যেতে না পারে। আর কাজ ধরা না থাকলে তখন
হাতে থাকে গামছা পেঁচানো দা। যে কয়েকটা বাঁধা ঘর ছিল, সেই কবে থেকে যাদের ঘর
সারানোর কাজ করে আসছে গন্ধরাজ, তারা সবাই একে একে ইট কাঠের দালান বানিয়ে ফেলেছে। ইসপল্টুর
টিন লাগিয়েছে। গন্ধরাজের কাজ কমে গেছে। এখন কেবল কারও বাড়ির সীমানার বেড়া সারানো, শিম
বা লাউ গাছের মাচা বানানো, - এই সব ছোট ছোট কাজ টিকে আছে। আজকাল আর শরীর দিয়ে পারে
না গন্ধরাজ। তার বয়স হয়েছে। ঠিক কত বয়স হয়েছে সে জানে না। শুধু টের পায়, আজকাল
বেশীক্ষণ রোদে কাজ করলে মাথা ঘোরে। তাই আস্তে আস্তে ঘর-বন্দি হয়ে গেছে সে। তার ছেলে
বাপের রাস্তা ধরে নি। সে রিকসা চালায়। রিকসা চালানোতে তনাই থাকলে রোজগার আছে। গন্ধরাজের
তনাই পড়ে গেছে। তা ছাড়া, তার রোজগারের রাস্তায় তনাই থাকলেও কাজ নেই। বাতিল মানুষের
মত সে এখন বাড়িতে বসে থাকে। বাড়ির কাজকর্ম করে, হাত-দা খানা যত্ন করে ধার দেয়। শরীরটাকে
খাটিয়ে চালু রাখে। বাকী সময় বারান্দায় পিড়ি পেতে বসে চারদিকে তাকায় শুধু। উঠানে
চড়ুই নামলেও তাকায়, ঘরের চালে কাক বসলেও তাকায়, কোনও বাড়ির ছাগল এসে ঘাটার আগল
ঠেলছে দেখলেও তাকায়। ওর হাসি হাসি মুখটা দেখলে তখন মনে হবে ও যেন খুব আমোদ পাচ্ছে
এ সব দেখে।
কিন্তু এই ক’দিন ধরে এত বৃষ্টি পড়ছে,
গন্ধরাজের নড়া চড়া বন্ধ। হাত পা ডাট্টা হয়ে যাচ্ছে। দা খানাতে জংকার না পড়ে যায়। বৃষ্টি
মাথায় করে কাজে নামার বয়স আর তার নেই। তাই এই বৃষ্টির সকালে গন্ধরাজের কাজ শুধু
বসে থাকা। বসে থাকতে থাকতে এক সময় পূবের ভিটার বাঁশের দরজায় ক্যাঁচকোঁচ শব্দ উঠতে গন্ধরাজ
সেদিকে তাকাল। আরতি দরজা খুলে বেরিয়েছে। গন্ধরাজের পুত্রবধূ। গন্ধরাজকে দেখে গায়ের
কাপড়টা একটু টেনে দিল। ঘোমটাও টানার চেষ্টা করল, খাটো কাপড়ে সেই চেষ্টা ফলবতী হল
না। হাল্কা বৃষ্টির পরোয়া না করে বউ চলে গেল বাড়ির পিছন দিকে, সুপুরি গাছের শুকনো
ছই দিয়ে বানানো আড়ালের আড়ালে। নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে বউটির থেকে চোখ সরালো গন্ধরাজ।
একটু পরে বউ ফিরে এল। এবার গন্ধরাজের বসে থাকার মধ্যে একটা অপেক্ষা এসে যোগ হয়।
একটা সরল, শান্ত, নিশ্চিত প্রাপ্তির অপেক্ষা। একটু পরেই দেখা গেল আরতি গ্লাসে করে
চা নিয়ে আসছে। বৃষ্টির উঠান পার হয়ে আরতি, বাবা, চা নেইন, -বলে চায়ের গ্লাস এগিয়ে
দিলে গন্ধরাজ আগ্রহের সঙ্গে দু-হাত বাড়িয়ে তা নিল। সঙ্গে এনামেলের বাটিতে অল্প
মুড়ি। ঠাণ্ডার মধ্যে এই নুন দেওয়া ফিকা চা বড় তৃপ্তি দেয়। তারিয়ে তারিয়ে চা-টা খেল
গন্ধরাজ। আরও কিছু পরে ছেলে অনন্ত বেরোল। এখন বৃষ্টি মাথায় করে শহরে যাবে। বিধান
মজুমদারের কাছ থেকে ভাড়ার রিক্সাখানা নিয়ে ট্রিপ মারতে লেগে যাবে। বৃষ্টি বাদলায় সওয়ারি
কম হয়, কিন্তু আমদানি ভাল। দেরি করার সময় নেই তার। আরও পরে, ঘুমের চোখ কচলাতে
কচলাতে ঘর থেকে বেরোল উদোম ন্যাংটা, আরতির চার বছরের ছেলে, গন্ধরাজের নাতি, বাদল।
মুখে ঘুম ভাঙ্গার বিরক্তি। গন্ধরাজ একটু জোরে চেঁচিয়ে বলল, কিতা বা লেংটা গদা। উঠি
গেলায় নি। আজকের দিনের এটা তার প্রথম শব্দোচ্চারণ। নাতি একবার ঘাড় ঘুরিয়ে গন্ধরাজকে
দেখল রাগ রাগ মুখ করে। তারপর যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকেই পেচ্ছাপের একটা সরু ধারা
ছুঁড়ে দিল উঠানে। সেদিকে তাকিয়ে গন্ধরাজের মুখের হাসিটি প্রাণ পায়, যদিও সে আলাদা
করে হাসে নি। নাতি গিয়ে ঘরে ঢুকল। এখন প্রত্যেকটি ব্যাপারেই একপ্রস্ত ঘ্যান ঘ্যান
করবে। মা ওর পিঠে কিল বসাবে দু একটা। চেঁচিয়ে কাঁদবে তারপর। অর্থাৎ, শুরু হয়ে গেছে
আরেকটা হাসি কান্নার দিন।
বৃষ্টি একটু ধরেছে। যদিও খড়ের চালা
থেকে মাঝে মাঝে টুপটাপ জলের ফোঁটা পড়ছে ছাচের পোতায়। উৎসুক চোখ তুলে আকাশ দেখল
গন্ধরাজ, ছাই রঙ হালকা হচ্ছে ক্রমশ:, ধীরে ধীরে ফরসা হচ্ছে আকাশ। ঠাকুর যদি আজ একটু
দিন দেয়। মনে মনে ভাবল গন্ধরাজ। রোদ না পেয়ে উঠানের এখানে ওখানে শ্যাওলার সর পড়ে
গেছে। অসাবধানে পা পড়লেই হড়কাবে। গন্ধরাজ এবার ওঠে। গায়ের কাপড় খুলে রেখে গামছা
খানা পরে নেয়। ঘরের বেড়ার খাপে ঢোকানো হাত-দা খানা টেনে বের করে উঠানে নেমে পড়ে।
সারা বাড়িতে যেখানে যা খুচ খাচ কাজ চোখে পড়ে, একে একে সারতে থাকে। কোদাল এনে মাটি
চেঁচে শ্যাওলা সরায়। বাঁশ ঝাড় থেকে একটা পোক্ত বাঁশ বেছে নিয়ে সেটা কেটে এনে উঠানে
শুইয়ে রাখে, ঘরের খুঁটি বানাবে। আমগাছে পিঁপড়ের ঢোল হয়েছে একটা। কেটে দেয়। এই রকম
করতে করতে এক সময় একটু রোদ ঝিলিক দিয়ে উঠল আকাশে। মনটা ভাল লাগল গন্ধরাজের। পুকুরে
গিয়ে হাত পা পরিষ্কার করে স্নান করে নিল। ফিরে এসে খাটো ধুতিটা পরতে পরতে আরতিকে
ডাকল, - কই গেলে গো মাই।
ঘর থেকে ত্রস্তপায়ে
বেরিয়ে এল আরতি।
- ডাকিতরা নি বাবা?
- অয়। কুন্তা খাইবার দে। আমি টাউনো যাইতাম।
- টাউনো গিয়া কিতা করতা? শরীল ভালা নায়। আরতির গলায়
উদ্বেগ।
- কত দিন গেছি না বেটি। ভাল্লাগের না। দিন দিছে তে একবারতা
যাই। ওউ যাইমু আর আইমু।
- তে ভাত এক
দলা মুখো দিয়া যাইন।
ভাত খেয়ে গন্ধরাজ একটা রংচটা সিনথেটিক
হাফ শার্ট গায়ে দেয়। টায়ারের চপ্পল জোড়া বের করে ধুলো ঝেড়ে তাতে পা গলায়। তারপর বড়
রাস্তা অবধি হেঁটে এসে বাসের জন্য অপেক্ষা করে।
* * *
কপালে ঠাণ্ডা
হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুমের লাগ কাটল আশালতার। চোখ না খুলেও টের পেলেন, কয়েকটি সরু
সরু আঙ্গুল তার কপাল ছুঁয়ে আছে। ভাল লাগছিল আশালতার। কয়েকটা বাড়তি সেকেন্ড এই ভাল
লাগাকে ধরে রেখে তারপর চোখ খুললেন। ঝাপসা চোখে একটুক্ষণ তাকিয়ে বুঝলেন, বিছানার
পাশে তার বউমা এসে দাঁড়িয়েছে। শরীর কি রকম গো আইজ? কথাটা বুঝতে একটু সময় নিলেন
আশালতা, তারপর মাথা নাড়লেন। ভাল। ভাল লাগছে তার। এই যে চোখ খুলে তাকিয়েছেন, চোখ
ভারী হয়ে বন্ধ হয়ে আসছে না। শরীরে তেমন জ্বালা-পোড়া নেই। কেমন যেন সব কিছু ভাল
লাগতে ইচ্ছে করছে। এই কয়েকটা দিন বড় খারাপ লাগছিল সবকিছু। এক নাগাড়ে বৃষ্টি
হচ্ছিল। ঘরের ভেতর চাপ চাপ অন্ধকার জমে
থাকত। সেই অন্ধকারে কারা আসছে, কারা যাচ্ছে ঠিক বুঝতে পারতেন না। মনে হত অচেনা
মানুষজন এসে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। তারা কি সব বলাবলি করছে, কিছুই বুঝতে পারছেন
না উনি। দিন না রাত, তা-ও বোঝা যেত না। কেমন যেন ভয় করত আশালতার। ভয়ে কাঁটা কাঁটা
হয়ে থাকতেন। মাঝে মাঝে খাবার ভেবে হাঁ করলে মুখে পড়ত তেতো ওষুধ। খাবারের গ্রাস মুখে
নিলে গিলতে পারতেন না। ঘুমে ঢলে পড়তেন। আসলে ঘুম নয়, একটা আচ্ছন্নতা। আজ চারদিক
তাকিয়ে দেখলেন আশালতা, ঘর খানা বেশ আলো আলো। চেনা আসবাবগুলো চোখে পড়ছে। এই যে
সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার পুত্রবধূ, যার নাম প্রায়ই ভুলে যান তিনি, এখন ঠিক মনে পড়ছে
ওর নাম সুনন্দা, ওকেও দেখতে বড় ভাল লাগছে। সুনন্দা বলল, জ্বরতো কমছে মনে অয়। প্রণতি
আউক, কইমু আইজ একটু গা মুছাইয়া দিত আপনারে। ই কয়দিন তো গা মুছানি অইছে না। ভালা
লাগব। বাধ্য শিশুর মত ঘাড় কাত করলেন আশালতা।
আজ রোদ উঠেছে। আশালতার পায়ের দিকে
একটা কাঠের পাল্লার জানালা আছে। সকালে খুলে দেওয়া হয় আর বিকেলে, সন্ধ্যা নামার
আগেই টেনে বন্ধ করা হয়। নইলে মশা ঢোকে। বৃষ্টি পড়লে দিনেও পাল্লা টেনে দেওয়া হয়,
নইলে বৃষ্টির ছাট ঢোকে। একটা পাতলা সুতি কাপড়ের টুকরো পর্দা হয়ে আহ্লাদে দোল খায় সেই
জানালায়। কাপড়টা মাঝে মাঝে হাওয়ায় সরে যায়। বেশী হাওয়ায় কখনও পেঁচিয়ে যায় জানালার শিকের
সাথে। কারো চোখে পড়লে প্যাঁচ খুলে দেয়। এই অকুলীন পর্দাটি মাঝে মাঝে সরে গিয়ে যতখানি
ফোকর তৈরি করে, ঠিক সেই মাপের পৃথিবী উঁকি দেয় আশালতার ঘরে। ঘরের অন্য জানালাটির সামনে
অনেক বাক্স প্যাটরা রাখা, তাই সেটা খোলা হয় না। জানালা দুটির ওপাশে অন্য লোকের বাড়ি।
সে বাড়িতে নানা বয়সের অনেক মানুষ। সেই বাড়ি থেকে বাচ্চাদের ঝগড়া, কারও কান্না, কারও
শাসানি, একটু বড় হওয়া কারও মুখে এক-আধটা চালু হিন্দি গানের কলি, বড়দের ভারী গলায় সংসারী
কথাবার্তা - ইত্যাদি এসে আশালতার ঘরে ঢোকে। এই সব শব্দে আশালতা সঙ্গ-সুখ পান। একটা
চলমান জীবনে জুড়ে থাকার সুখ। এ ছাড়া তার ঘরে আছে একটা সিলিং ফ্যানের শব্দ, আর
প্রতি ঘণ্টায় একবার টুং করে বেজে ওঠা একটা দেয়াল ঘড়ির শব্দ।
এক বছর আগেও এমন শয্যাশায়ী ছিলেন না
আশালতা। কারো সাহায্য ছাড়াই বিছানা থেকে নামতে পারতেন। লাঠি হাতে সামান্য হাঁটতেও
পারতেন। বেডপ্যান ব্যবহার করতে পারতেন। একবছর হল তিনি সেই ক্ষমতা হারিয়েছেন। এক
বছর ধরে বিছানাতেই তার মল-মূত্র ত্যাগ। শারীরিক ক্ষমতা কমে গিয়ে মানুষ যত অন্যের
উপর নির্ভরশীল হয়, ততই তার অধিকার-বোধ কমতে থাকে। আশালতা এখন তার নিজের কোনও চাহিদার
কথা এমনকি ছেলেকেও বলতে দ্বিধা করেন। এক বছর আগেও তার নাতিটা দুপুর বেলা তার পাশে
এসে শুয়ে পড়ে বলত, ঠাম্মা আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। আশালতার আলাদা ঘুমপাড়ানি গান ছিল,
যা শুরু হত মাসি-পিসি দিয়ে। আর তার পর ওই একই ছন্দে এসে জুড়ে যেত চেয়ার টেবিল ঘুনু
রে, সেলেট পেন্সিল ঘুনু, বুড়া বুড়ি ঘুনু রে, ময়না পাখি ঘুনু, এরকম যা মনে আসে তা-ই।
কবে একদিন আল্পনা আর কল্পনা নামে দুটি বাচ্চা মেয়ের নামও ঢুকে গিয়েছিল, আর তারপর
থেকে ওই দুটো নাম উচ্চারিত না হলে নাতির মন ভরত না। খালি বায়না ধরত, আলবল কালবল ঘুনু
বল। আলবল কালবল ঘুনু। সেই নাতি আর কাছে আসে না। কখনও মা বাবার পেছনে পেছনে এসেও দরজায়
দাঁড়িয়ে পড়ে। ঘরে ঢোকে না। আশালতা দেখেন শুধু। কাছে ডাকার সাহস পান না।
ছেলে দিবাকর, বউ সুনন্দা আর নাতি
দীপ্তকে নিয়ে আশালতার সংসার। এরকম ভাবতে ভাল লাগে। আসলে দিবাকর, সুনন্দা আর দীপ্তর
সংসারের এক অধিকন্তু অংশ আশালতা। অবহেলিত নন। একটি কাজের মহিলা রোজ এ বাড়ির অন্য
ঘরগুলোর সঙ্গে তার ঘরও ঝাড়ু দেয়, মোছে। তা ছাড়া প্রণতি নামের বউটি আছে তার সকালবেলার
পরিচর্যার জন্য। রোজ এসে তাকে স্নান করিয়ে বাসি কাপড় পালটিয়ে দেয়, নোংরা বিছানা
পরিষ্কার করে, কাপড়চোপড় কেচে দেয়। বউটির মাত-বোল ভাল। এসেই বলবে, কিতা গো মাসী,
আইজ কিলান আছ। কিন্তু রুটিনের হাতে কাজ সারতে গিয়ে খেয়াল রাখে না আশালতা কোথায় চোট
পান, কোথায় ব্যথা লাগে। আশালতা উঃ করে উঠলে প্রণতি সতর্ক হয়, বউদি শুনতে পেল কি?
শুনলে খামোখা বকা ঝকা করবে। সুস্থ থাকলে আশালতা খুব সহযোগিতা করেন। তাতে তার
নিজেরই কষ্ট কমে, প্রণতিরও সুবিধা হয়। কিন্তু জ্বর-জারি হলে তখন আর পারেন না।
শরীরের লাশ ছেড়ে দেন একেবারে। তখন এই হাড়ে হাড় লাগা শরীরখানা সামলাতে গেলে এক আধটু
চোট তো লাগতেই পারে। কিন্তু সামান্য উঃ শব্দ বউদির কানে গেলেই হয়েছে। প্রণতি চাপা
গলায় গজ গজ করে, অত যদি মায়া লাগে, তে নিজে আইয়া আত লাগাও না কেনে? মনো করো পয়সা
দিতরায় তে আর নিজে গু-মুত ছানতায় কেনে। হড়ি কার, তুমার না আমার? নিজেকে অসহায়ের মত
প্রণতির হাতে সঁপে দিয়ে বিরক্ত আশালতা অপেক্ষা করেন, কখন এই স্নান-পর্ব শেষ হয়। স্নানের
পর অবশ্য তাকে বেশ তরতাজা দেখায়।
পুত্রবধূ সুনন্দা দিনে রাতে অনেকবার এ
ঘরে আসে। সকালে চোখ মুখ ধুয়ে মুছিয়ে দেয়। বসে চামচে করে চা খাওয়ায়। গ্লাসে করে
একটু একটু দুধ ঢেলে দেয় গলায়। যত্ন করে তিন-বেলার খাবার খাইয়ে দেয়। সন্ধ্যার পর
মশারী খাটিয়ে দেয়। কাজের কথা বলে, কিন্তু গল্প গাছার তার সময় হয় না। আশালতার
দেখভাল ছাড়াও এ ঘরে ওর নানা কাজ থাকে। কখনও বাক্স-আলমারি খোলে, কিছু বের করে অথবা কিছু
ঢুকিয়ে রাখে। আশালতা ঘাড় কাত করে ওর চলা ফেরা দেখেন। কাজ শেষ করে আশালতার চেয়ে
থাকা চোখের ওপর দিয়ে সুনন্দা চলে যায়।
সকালে ছেলে অফিসে আর নাতি স্কুলে চলে
গেলে এ বাড়ি ভীষণ চুপচাপ। একা হাতে বাকী রান্নাবান্নার কাজ সারে সুনন্দা। টুকিটাকি
অনেক কাজ থাকে তার। তারপর স্নান সেরে বেলা দেড়টা নাগাদ বেরিয়ে যায় ছেলেকে স্কুল
থেকে আনতে। ফিরে আসার পর কচি গলার কলকল কথায় বাড়িটা অল্প সময় প্রাণ পায়। আশালতা
কান পেতে রাখেন, যদি একটা দুটো শব্দ বোঝা যায়। খাওয়া দাওয়া সেরে দীপ্ত ঘুমিয়ে পড়ে।
সুনন্দার তখন একটুকরো অবকাশ। সে তখন টিভি চালায়। টিভি চালিয়ে কখনও ঘুমিয়েও পড়ে।
টিভির পর্দায় হাসি কান্নার এতে বিরাম ঘটে না। এভাবেই বিকেল কাটে, সন্ধ্যা হয়। সন্ধ্যায়
নিয়ম করে সন্ধ্যা-বাতি দেয় সুনন্দা। সে জোকার দিয়ে উঠলেই আশালতা দুটো হাত এনে
কপালে ঠেকান। রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ তার ছেলে ফেরে। টুকটাক কথা শোনা যায়। ছেলের গলা,
বউয়ের গলা, নাতির কলকলানি থেকে একটি সুখী সুখী চিত্রনাট্য তৈরি হয়। প্রতিটি
উচ্চারণ থেকে আলো ছড়ায়, উত্তাপ ছড়ায়। উচ্ছলতা ছড়ায়। পাশের ঘরে শুয়ে থেকে আশালতা এই
চিত্রনাট্যে নিজেকে খুঁজতে থাকেন। মাঝে মাঝে কোনও আত্মীয় স্বজন, বা
ছেলের বন্ধুদের কেউ আশালতার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ওরা তাকে এ ঘরে নিয়ে আসে। পায়ের
শব্দে চোখ খুলে তাকান আশালতা। মাসীমা কেমন আছইন? ছেলে কিম্বা বউমা কেউ মশারিটা
তুলে ধরে। চোখ ছোট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মানুষটিকে চেনার চেষ্টা করেন আশালতা। তারপর
গলায় স্বর ফুটলে স্পষ্ট করে বলেন, ভালা আছি। নইলে মাথা নেড়ে বোঝান, ভাল। কখনও শুধু
কোঁচকানো চোখে তাকিয়ে থাকেন অনেকক্ষণ।
সুনন্দার মত দিবাকরও মাঝে মাঝে তার
নিজের কাজে এ ঘরে আসে। আলমারি খুলে ফাইল পত্র বের করে। দিবাকরের পায়ের শব্দে চোখ
খোলেন আশালতা। পুত্রের প্রতিটি নড়া চড়াকে দৃষ্টি দিয়ে লাগাতার অনুসরণ করেন। কখনও
দিবাকরের চোখে পড়ে সেই তাকিয়া থাকা। সময় থাকে না একটু বসার। হয়তো কাউকে বসিয়ে রেখে
এসেছে, বা কোনও জরুরী কাজ সারতে হবে। অথবা অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে শেষ ওভার, মিস করা
যাবে না। হঠাৎ কোনও দিন, যদি সময়ের হিসেব মিলে যায়, দিবাকর এসে আশালতার পাশে বসে।
মশারিটা উঠিয়ে দেয়। গলার স্বর একটু বাড়তি তরল করে দিয়ে, অনেক দিনের জমে থাকা ঘাটতি
একসঙ্গে পুরিয়ে দেবার মত বাড়তি অন্তরঙ্গতায় কথা বলে। কিতা বুড়ী। কিতা কর। ছেলের এ
জাতীয় বাক্যালাপে আশালতা আনন্দ পান। তার চোখে মুখে কৌতুক ফোটে। একটা ভালোলাগা ছড়ায়
মুখে। কোঁচকানো চোখে অনেকক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে
থাকেন। কখনও দিবাকর বলে, বুড়ি আর কয়দিন আছো আমরার বাড়ি? এই প্রশ্নেও মজা পান আশালতা।
মুখের প্রশান্ত ভাব বজায় রেখে ডান হাত সামান্য উঠিয়ে হাত-ঘুরানো মুদ্রায় বুঝিয়ে
দেন, জবাব জানা নেই। দিবাকর বলে, মরবার সময় আইলে, তিন দিন আগে আমারে কইবায়। আগে না
কইয়া মরবায় না। বুঝছ? ঘাড় কাত করে সম্মতি জানান আশালতা। ভালোলাগায় আপ্লুত হন তিনি।
কিন্তু ছেলের হাতে সময় বেশী থাকে না। মশারি নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। বলে যায়, ঘুমাই
থাকো অখন। আশালতা মাথা নাড়েন, হ্যাঁ।
অনেক
দিন পর আজ রোদ উঠেছে। সুনন্দার তাই অনেক ব্যস্ততা। যত ভেজা কাপড় জমেছে এ ক’দিনে,
সব শুকিয়ে নিতে হবে। আকাশের কোনও ভরসা নেই। একটু আগে রোদের মধ্যেই তড়বড়িয়ে বৃষ্টি পড়ছিল।
বৃষ্টির ধারায় রোদ পড়ে রুপোর জরির মত ঝলমল করছিল চার দিক। গত কয়েকদিন ধরে ঘরের
ভেতর চারদিকে দড়ি টাঙিয়ে ভেজা কাপড় শুকোনো হচ্ছিল। চলতে ফিরতে গায়ে লাগত। কেমন
চাপা দুর্গন্ধ ভাসত ঘরের মধ্যে। আজ সব জানালা খুলে দিয়েছে সুনন্দা। একটু রোদ, একটু
হাওয়া ঢুকুক, ভ্যাপসা গন্ধ কাটুক। আশালতার জ্বরটা সামান্য কমেছে দেখে আশ্বস্ত হয়ে সে
চলে গেল নিজের কাজে। আশালতা শুয়েই থাকলেন।
একটু পরেই প্রণতি এসে গেল।
গা হাত
পা ভালো করে উম-গরম জলে মুছিয়ে দিয়ে আশালতাকে ভাল জামা কাপড় পরিয়ে দিয়েছে প্রণতি।
তারপর সুনন্দাকে ডেকে বলল, ও বউদি, মাসীমারে আইজ বারিন্দাত নিতায় নি? মাঝে মাঝে
আশালতাকে ওরা ধরে ধরে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বেতের চেয়ারে বসিয়ে রাখে। এতে মনটা ভাল
হয় আশালতার। সুনন্দা ঘরে ঢুকল, বলল, নিতাম তো, কিন্তু শরীরর যে অবস্থা, পরে নি
আনতাম পারমু। প্রণতি বলে, ঠিক আছে, আমি ফিরার সময় একবার মুখইর দিমু নে। প্রণতি আরও
দুটো বাড়ির কাজ সেরে এ পথেই বাড়ি ফেরে। তে আইচ্চা, ধর। দুজনে মিলে আশালতাকে আস্তে
আস্তে হাঁটিয়ে নিয়ে আসে বারান্দায়। বেতের চেয়ারে ভাল করে কুশন ঠেস দিয়ে জুত করে
বসিয়ে দেয়। অনেক দিন পর আশালতার মনটা খুব উৎফুল্ল আজ। বেশ দেখতে পাচ্ছেন সামনের
রাস্তা দিয়ে লোক আসছে যাচ্ছে। উঠানের গাছ পালা গুলো দেখলেন, নারকেল গাছ, সুপুরি
গাছ। বৃষ্টির জল জমে আছে উঠানের এখানে ওখানে। সব চোখে পড়ল। সত্যি মন ভাল হয়ে গেছে আশালতার।
প্রণতি চলে গেল। সুনন্দাও ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের কাজে। আশালতা বসে রইলেন। বসে বসে
একসময় ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। তন্দ্রার মধ্যেই শুনলেন, কে যেন ডাকল, মাসীমা ভালা নি
গো?
আশালতা
কষ্টে চোখ খুললেন। ঘুমের চটকা কাটিয়ে অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চেহারা আর কণ্ঠস্বর
মেলাতে মেলাতে মনে পড়ল, এ তো গন্ধরাজ! কত দিন পরে এল। অয় বা, ভালা আছি। তুমি ভালা
নি। বউত দিন পরে দেখলাম। আও না নি ইবায়। মাঝে মাঝে আইও। ওউ দেখ চাইন, টাট্টির বেড়া
ইখান কাইত অই রইছে। আমার পুয়ারে কত কই, গন্ধরাজরে একটা খবর দে। তারা ইতা হুনাত
নায়। দেখো চাইন, পারলে ওখানতা একটু ঠিক করিয়া দিয়া যাও। বউ কই গেলায় গো, গন্ধরাজরে
একটু চা দিও। গন্ধরাজ, চা খাইয়া যাইও।
গন্ধরাজ
দেখে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আশালতা। সে-ও তার হাসি হাসি মুখখানা নিয়ে
তাকিয়ে থাকে আশালতার দিকে। আশালতার চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারে, চিনতে পেরেছেন। নিজেই
বলতে থাকে, বড় মনে টানের গো কয়দিন ধরি। আইজ দিন দিছে তে মনো করলাম যাই, একবার
মাসীমারে দেখিয়া আই। আখতা কুন দিন যাইবায়গি, তেউ আর দেখতাম নায়। কথা শেষ করে আশালতার
দিকে তাকিয়ে ছিল গন্ধরাজ। আশালতার চোখে ভাষা ফুটেছে, ঠোঁট দুটোও একটু ফাঁক হয়েছে,
সামান্য কাঁপছে। কিছু বুঝি বলবেন আশালতা। মনে হচ্ছে যেন অনেক কিছু বলতে চান। কিন্তু
কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে কোনও বাক্য স্ফুরিত হয় না। আবেগ-রুদ্ধ গলায় শুধু ঘড়ঘড় শব্দ ওঠে।
বারান্দার মেঝেতে বসেছে গন্ধরাজ। আশালতার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে এক সময় দৃষ্টি
ফিরিয়ে নিল। তারপর উঠে পড়ল। হাসি লটকানো মুখখানা নিয়ে এগিয়ে গেল উঠানের দিকে। বউদি
কই, ভালা আছইন নি? ভেতর থেকে সুনন্দা তার ডাক শুনতে পায়। বেরিয়ে এসে বলে, গন্ধরাজ
নি, ভালা আছো নি। গন্ধরাজ বলে, অয়, ভালাউ আছি। এর পরের কথাটা সুনন্দা বলতে গিয়েও
নিজেকে থামিয়ে দিল। বলল না, বইও গন্ধরাজ। চা খাইয়া যাইও। এখন তার ব্যস্ততার শেষ
নেই। এখন আবার আলাদা করে গন্ধরাজের জন্য রান্নাঘরে গিয়ে চা বসাতে পারবে না। গন্ধরাজ
বসে না। এমনি এদিক ওদিক হাঁটে। নিজের অভ্যাসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, কোথায় কী
মেরামতির দরকার আছে। সে আজ কাজ করতে আসে নি। হাত-দা খানাও সঙ্গে আনে নি। তবু সুপুরি
গাছের নীচে পড়ে থাকা ভেজা সুপুরির ছইগুলো একপাশে সরিয়ে রাখে। কাঁঠাল গাছের নিচে
পাতা পড়ে পড়ে কাদা মেখে জঞ্জাল হয়ে আছে, একটা ঝাড়ু খুঁজে এনে সেগুলো এক জায়গায় জড়ো
করে। তারপর সামনের বারান্দায় এসে আশালতার দিকে তাকায়। আশালতা তখন চোখ বন্ধ করে
মাথা এলিয়ে দিয়েছেন এক পাশে।
স্নান টান
সেরে সুনন্দা যখন সামনের বারন্দায় এল, গন্ধরাজকে দেখতে পেল না। মনটা একটু খচখচ
করল। এখন এক কাপ চা দিতে পারত সুনন্দা। পুরনো লোক। এইটুকু খাতির সে পায় এ বাড়িতে।
এবার আশালতার দিকে দৃষ্টি ফেরায় সুনন্দা। ঘুমোচ্ছেন। এভাবে ঘুমোলে ঘাড়ে ব্যথা হবে।
সুনন্দা তাই আস্তে আস্তে ডাকে, মা, উঠইন। বিছ্নাত চলইন। ভাত দিমু, খাইয়া ঘুমাই থাকবা। ঘোর লাগা
চোখে তাকালেন আশালতা। সুনন্দাকে চিনতে পেরেছেন বলে মনে হল না। একটা দুর্গন্ধ নাকে
লাগতে সুনন্দার সন্দেহ হল। নাক দিয়ে জোরে শ্বাস নিতে গিয়ে বুঝতে পারল, কি কাণ্ডটা ঘটে
গেছে। মাথায় আগুন জ্বলে উঠল তার। এখন, এই
অবেলায় এই সব নোংরা সাফ করতে হবে? প্রণতি বলেছিল আসবে। সেও কি এখন আবার নোংরা
ঘাটতে রাজী হবে? নিজেকেই দোষ দেয় সুনন্দা। মরতে কেন আজ উনাকে ভাল কাপড় পরিয়ে
বারান্দায় এনে বসিয়েছিল! এর পর বেশ কিছুক্ষণ চলল নিজের ভাগ্যকে গালাগাল। সমস্ত
ঝামেলা তার ঘাড়ে ফেলে ছেলে দিব্যি অফিস করছে। কোন পাপ করে সে এসেছিল এই সংসারে। অর্দ্ধচেতন
অবস্থায় আশালতা বুঝতে পারেন, উনি গোলমাল করে ফেলেছেন। মরমে মরে থেকে সব বাক্যবাণ
হজম করেন। একটু পরে নিজের কথা রাখতে প্রণতি আসে। আশালতার দায়িত্ব নেয়। সুনন্দার
রাগারাগি দেখে বলে, আইচ্চা গো বউদি, আর গাইল্লাইও না, বুড়া মানুষ। আশালতাকে
পরিচ্ছন্ন করে বিছানায় শুইয়ে দেয় প্রণতি। গা ঘিন ঘিন করছিল বলে সুনন্দা আবার স্নানে
যায়। ফিরে এসে রাগে গজগজ করতে করতে থালায় খাবার বেড়ে এনে আশালতাকে বলে, নেইন,
খাইয়া আমারে উদ্ধার করইন। আশালতা তখন চোখ খুলতে পারছেন না। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তার।
অথচ সুনন্দাকে বেরোতেই হবে। দীপ্তর ফেরার সময় হয়ে গেছে। আবারও মনটা খচ খচ করে তার।
হাল্কা সাজ করে দরজা খুলে বেরোয়।
* * *
রাতে
দিবাকর বাড়ি ফেরার পর সুনন্দা তার সমস্ত অভিযোগ, উষ্মা, হতাশা উজাড় করে দিল
দিবাকরের উপর। আর সম্ভব নয় একজন বৃদ্ধাকে এভাবে দিনরাত টানা। এক অসুস্থ শাশুড়িকে
সামলাতে বছরের পর বছর তার কোথাও যাওয়া হয় না। বসে আছে এখানে নোংরা ঘাটার জন্য। দিবাকর
যেন দিনরাতের জন্য লোক রাখে। আর নইলে নিজে অফিস কামাই করে এসে মা-র সেবা যত্ন করুক।
দিদিরা সব দূর থেকে উপদেশ দেবে শুধু। হাত লাগানোর জন্যে কেউ নেই। চুপচাপ সব শুনল
দিবাকর। মা-র বকাবকি শুনে ছেলে দীপ্ত এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে। দিবাকর অফিসের পোশাক
পাল্টে মা-র ঘরে গেল। পেছন পেছন এসেও দীপ্ত দরজায় আটকে রইল। মশারি খাটানো রয়েছে। কম
আলোর একটা সি এফ এল জ্বলছে ঘরে। দিবাকরের খেয়াল হল, বেশ ক’দিন এ ঘরে আসা হয় নি
তার। বিছানাপত্র থেকে কেমন একটা কটু গন্ধ বেরোচ্ছে। দিবাকর মশারি উঠিয়ে আশালতার
কপালে হাত রাখে। গা বেশ গরম। সুনন্দাকে জিজ্ঞেস করে, ওষুধ দিয়েছ কিছু? যেটা চলছিল
সেটাই দিয়েছি। সুনন্দা জানায়। দিবাকরের হাতের স্পর্শে চোখ খুলেও বেশীক্ষণ তাকাতে
পারলেন না আশালতা। চোখ বন্ধ হয়ে গেল। দিবাকরের খুব অসহায় লাগে। সুনন্দার অভিযোগ
নিয়ে কিছু বলার নেই। কারই বা ভাল লাগে এই রকম একজন রোগী ঘাটতে। কিন্তু সারাক্ষণের
লোক রাখার খরচের দিক বাদ দিলেও, সেই বাড়তি লোকটি কি খাবে, কোথায় শোবে, এসব ঝামেলার
দিকও আছে। চট করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। দিবাকর হাত বাড়িয়ে আশালতার হাতখানা
ছুঁলো। জলের বোতল থেকে একটু জল হাতে নিয়ে আলতো করে কপাল ভিজিয়ে দিল। আশালতা আবার
চোখ খোলেন। তারপর দিবাকরের দিকে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে থাকেন। আশালতাকে তাকাতে দেখে
দিবাকর জিজ্ঞেস করে, কিতা গো। আবার জ্বর উঠিগেছে নি? আশালতার কথা ভাল বোঝা যাচ্ছে
না। গলায় কফ ঘড়ঘড় করছে। দিবাকর আবার জিজ্ঞেস করে, কিতা কও? আশালতা আরেকবারের
চেষ্টায় একটু স্পষ্ট করে বললেন, গন্ধরাজ! দিবাকর সুনন্দার দিকে তাকায়। গন্ধরাজ
আইছিল নি? আইছিল দুপরে। দিবাকর জিজ্ঞেস করে, কিতা অইছে গন্ধরাজর? এবার অনেকটাই
স্পষ্ট উচ্চারণে আশালতা থেমে থেমে বলেন, গন্ধরাজরে, একটু চা দেও। আশালতার চোখের
দিকে তাকিয়ে দিবাকর বলে, আইচ্চা, দিব নে। তুমি ঘুমাও অখন। আশালতা সন্তুষ্ট হয়ে
মাথা নাড়লেন। তারপর চোখ বন্ধ করলেন।
-----------------
(সেবা, করিমগঞ্জ, মে ২০১৬?)
দারুণ কাজ করলেন মলয় দা। সামান্য সাজিয়ে তুলুন, দরকারে আমার সঙ্গে কথা বলুন।
ReplyDeleteহ্যাঁ। সাজাবো। দরকারে তোমার সঙ্গে কথাও বলব।
ReplyDelete