Monday 10 October 2016

হে রক্ষক (সাহিত্য ১৩৩) অক্টোবর, ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিতব্য



হে রক্ষক
-       মলয়কান্তি দে
হাজারটা নামের মধ্যে কালা-বাচ্চু এমন একটি নাম, ঐ নামটা শুনলে বকুল মাসীর হাতে পায়ে কাঁপুনি ধরে। ধমনীতে রক্তের স্রোত আচমকা ঠাণ্ডা হয়ে থেমে যায় যেন। চোখ বন্ধ হয়ে আসে। নিঃশ্বাস আটকে থাকে। পেচ্ছাপ, পায়খানা একসঙ্গে পায়। কাটা কবুতরের মত ছটফট করতে থাকে বকুল মাসী তখন
কালা-বাচ্চুর নাম শুনলে বকুল মাসীর মাথার তালুর পাতলা হয়ে আসা চুলের ভেতর দিয়ে গরম হাওয়ার হল্কা বেরোতে থাকে। কান দুটো ফাঁত ফাঁত করে। কপালের দুপাশের রগ দপ দপ করে। চোখ দুটো বড় হয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়। বুকে হাপরের মত শব্দ ওঠে। হাত পা অস্থির অস্থির করে। বুক ঠাস ঠাস করে। কেমন একটা গোঙানির মত শব্দ বেরোতে চায় মুখ দিয়ে। মুখে কাপড় ঠেসে দিয়ে নিজেকে তখন কোনও মতে সামলায় বকুল মাসী।
কালা-বাচ্চুর নামে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের ওপর ফোঁটা ফোঁটা টাটকা রক্তের এক লম্বা লাইন আঁকা হয়ে যায়। অটোর সীট বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে জমা হয় তলার ধাতব পাতের ওপর। হাসপাতালের কঠিন মেঝেতে রক্ত জমা হতে হতে এক অজানা মহাদেশের মানচিত্র তৈরি হয়। তেরো বছরের শরীরটাকে সবাই মিলে তুলে স্ট্রেচারে শুইয়ে দিতে সামান্য যেন চোখ মেলেছিল। কিছু একটা শব্দ বেরিয়েছিল মুখ দিয়ে। স্ট্রেচারের সাথে সাথে ছুটতে থাকা অন্যরা কেউ টের পায় নি, বকুল মাসীই কেবল জানে, সে শব্দটা ছিল, মা গো।  কালা-বাচ্চু নামে সেই ডাক কানে ভেসে আসে। এত বছর পরেও।
কালা-বাচ্চু! এই নামে তেরো বছরের একটি নিথর শরীর আপাদমস্তক ঢেকে যায় শাদা কাপড়ে, আর বকুল মাসীর নিজস্ব পৃথিবী এক ঠাণ্ডা, কঠিন, শাদা বরফের আস্তরণে ঢাকা পড়ে যায়।     
সেই কালা-বাচ্চুর নামটাই আজ আবার শুনল বকুল মাসী, এই বাড়িতে, এই বিভাস চক্রবর্তী প্রফেসরের ড্রয়িং রুমে, আজ এই এক কারফিউর সন্ধ্যায়।
  •  
বিভাস চক্রবর্তীর বাড়িতে সারাদিনের কাজের মানুষ বকুল মাসী। সকালে আসে, সারা দিন থাকে। বিকেলে কর্তা গিন্নির কেউ একজন ফিরলে সে বাড়ি যায়। বিভাস চক্রবর্তী কলেজে পড়ান। তার স্ত্রী কল্যাণী  পড়ান একটা স্কুলে। দশটা সাড়ে দশটায় বেরিয়ে যান ওরা। একমাত্র মেয়েটি মাঝে মাঝে ঘরে থাকে, কখনও স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি ফেরে, কখনও এক সঙ্গে টুইশান সেরে আসে। কখনও স্কুল ছুটি। বাড়িতে মেয়েটাকে একা থাকতে হবে, আর কাজের মানুষ একজন সারাদিন থাকলে ঘর খানাও অনেক ঝকঝকে দেখায়, তাই সারা দিনের জন্য বকুল মাসী।
আজ শহরে একটা গণ্ডগোল হয়েছে। দুপুরে খবর পাওয়া গেল, বাজারের মুখে দাঙ্গা বেঁধে গিয়েছে। বিকেলে কারফিউ জারী হয়েছে। বিভাস, কল্যাণী দুজনেই তাড়াতাড়ি ফিরেছেন। ওরাই বললেন, আজ আর বাড়ি যেতে পারবে না মাসী। আজ রাতটা এখানেই থেকে যাও। বকুল মাসীর বাড়ি বলতে রেলের জমিতে শুধু একটা আস্তানা। সেখানেই ফিরে যায় রাতে। গেলে যা, না গেলেও তা। তবে বাড়ি গেলে মাঝে মাঝে মেয়ে আসে। দেখা হয়। সুখ দুঃখের খবর লেনা দেনা হয়। থেকে যাওয়ার প্রস্তাবে বকুল মাসীর আপত্তির কারণ ছিল না। আর ফেরার রাস্তাও তো খোলা নেই। তাই থেকে গেছে।
সন্ধ্যার পর দু একজন লোক এসে জড়ো হলেন বিভাস প্রফেসারের বাড়িতে। কল্যাণী বললেন, একটু চা বসাও মাসী।
একটা ট্রে-তে চারটে চায়ের কাপ সাজিয়ে রান্নাঘর থেকে ধীর পায়ে হেঁটে এসে বকুল মাসী কনুই দিয়ে পরদা সরিয়ে ঢুকেছিল ড্রয়িং রুমে। ড্রয়িং রুমে তখন বিভাস পবেছার, প্রফেসর শব্দটিকে বকুল মাসী ঐ রকমই উচ্চারণ করে, তার স্ত্রী কল্যাণী, যাকে বকুল মাসী ডাকে মাস্টারনীদিদি, নবগোপাল কন্ট্রাক্টার আর আরেক জনও ছিল, বড় গোঁফ ওয়ালা, যাকে বকুল মাসী ঠিক চিনতে পারল না। নিশ্চয়ই আশ-পাশের কেউ হবে। বকুল মাসী জানে, কারফিউ জারী হয়ে গেছে শহরে। এই গোঁফো লোকটা দূরের কেউ হলে কারফিউ ভেঙ্গে এখন আসতে পারত না। নব কন্ট্রাক্টর কার সঙ্গে যেন কথা বলছে মোবাইলে। সেন্টার টেবিলে ট্রে-টা নামাতে নামাতে বকুল মাসী শুনল, নব কন্ট্রাকটার কাকে যেন বলছে, ...... আরে, তাতে কী? কারফিউ হল তো কী হল, ......... একটু চেষ্টা করলেই পারবে। এসে পড়। আসাটা দরকার। ...... আমি বাচ্চুকে আসতে বলেছি। ...... আরে, আমাদের কালা বাচ্চু!    
বকুল মাসীর পৃথিবীটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে এল। মুখ দিয়ে গোঙানির শব্দ বেরোল। ওর মনে হল এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। কোনও মতে সেন্টার টেবিলে ভর দিয়ে নিজেকে সামলালো, আর তার সমস্ত শরীর এক অস্থির তাড়নায় কেঁপে কেঁপে উঠল। কল্যাণী তাড়াতাড়ি উঠে এসে বকুল মাসীকে ধরেন পেছন থেকে, কী হয়েছে গো মাসী? শরীর খারাপ লাগছে? ওঠো, ওঠো। কল্যাণীর কথার উত্তরে কিছু বলতে চেয়ে বকুল মাসীর মুখ থেকে নানা দুর্বোধ্য শব্দ বেরোতে থাকে, যা আসলে গোঙানিরই রকম ফের। উপস্থিত বাকীরা সবাই হতভম্ব। নব কন্ট্রাক্টার মোবাইলে বলল, ‘এই, দাঁড়াও, আমি একটু পরে ফোন করছি’। বলে মোবাইল নামিয়ে তাকিয়ে দেখল, কল্যাণী বকুল মাসীকে ধরে দাঁড় করাচ্ছেন। ততক্ষণে বকুল মাসীর গোঙানি বন্ধ হয়েছে, শুধু ফোঁপানোর মত একটা শব্দ বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। কল্যাণী তাকে ধরে আস্তে আস্তে ড্রয়িং রুম থেকে বের করে নিয়ে আসেন। রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে আবার জিজ্ঞেস করেন, কী হল গো তোমার?
বকুল মাসী ফুঁপিয়েই চলেছে। কল্যাণী ওকে রান্না ঘরে নিয়ে মোড়ায় বসিয়ে দেন। জিজ্ঞেস করেন, পারবে তো বসে থাকতে?
বকুল মাথা নেড়ে জানায়, পারবে।
কল্যাণী দ্রুত পায়ে চলে আসেন ড্রয়িং রুমে। বিভাস জিজ্ঞেস করেন, কী হল ওর? জানি না। এখনও বুঝতে পারি নি। তোমরা চা নাও। বলে, ট্রে থেকে চায়ের কাপগুলো এগিয়ে দেন সবাইকে। নব কন্ট্রাক্টার একবার বলে, উনার কি অসুখ টসুখ আছে কিছু? বিরাজ উত্তর দেন, শুনি নি তো কখনও, তিন বছর ধরে আছে এ বাড়িতে। খুবই, যাকে বলে, ট্রাস্টওয়ার্দি মহিলা।   
কল্যাণী সবাইকে চা দিয়ে নিজের কাপ হাতে নিয়ে চলে আসেন রান্না ঘরে। বকুল মাসী মোড়াতেই বসে, চোখ বন্ধ। ফোঁপানি থেমেছে। কিন্তু শরীরে তখনও কাঁপ উঠছে থেকে থেকে। সকলের জন্যে চা বানানোর সময় বকুল মাসী নিজের জন্যেও বানিয়েছিল এক কাপ। সেই চা পড়ে আছে গ্যাসের উনুনের পাশে।
এ কি, তোমার চা তো ঠাণ্ডা হয়ে গেল। গরম করে দেব?
চোখ খুল বকুল মাসী। মাথা নেড়ে জানাল, খাবে না। কল্যাণী জোর করলেন না। হয়তো ভাল লাগছে না খেতে। 
কী হয়েছিল তোমার?
বকুল মাসী এবার কান্না-ভেজা চোখে তাকায় কল্যাণীর দিকে। কিছু বলতে পারে না।
কী গো? শরীর খারাপ লেগেছিল?
দু পাশে মাথা নাড়ায় বকুল
তা হলে?
আমার ছেলেটাকে ...
শুধু এই দুটো শব্দ ঠিকঠাক বেরোয় গলা থেকে। আর তারপরই ডুকরে কেঁদে ওঠার মত একটা আওয়াজ বেরিয়ে যেতে বকুল মাসী নিজেই তার শাড়ির আঁচল গুঁজে দিল মুখে। ভয়ার্ত চোখে তাকাল, একবার কল্যাণীর দিকে, একবার ড্রয়িং রুমের দিকে। কল্যাণীও সেদিকে তাকান। ড্রয়িং রুম আর রান্নাঘরের মাঝখানে অনেক খানি স্পেস আছে। খাবার জায়গা, ফ্রিজ, একটা কাঠের আলমারি, আর এ ছাড়াও বেশ কিছু ফাঁকা জায়গা। তবু দরজাটা ভেজিয়ে দেন। এখন তার চোখে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বকুল মাসী একটু ধাতস্থ হলে জিজ্ঞেস করেন, তোমার ছেলে? তুমি না বললে তোমার ছেলে মরে গেছে!  
বকুল মাসী কান্না জড়ানো গলায় এবার একটু স্পষ্ট করে বলে, ও ই তো মেরেছে গো। মদের বোতল ভেঙ্গে পেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। বকুল মাসীর গলা থেকে এবার বাঁধন না মানা কান্না বেরোয়, হয়তো ভেজানো দরজার আশ্বাসে। কল্যাণীর দু চোখ এখন বিস্ফারিত।  
এই সময় আস্তে করে রান্নাঘরের দরজা ঠেলে মুখ বাড়াল শিঞ্জিনী, বিভাস ও কল্যাণীর মেয়ে, এবারই হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। শিঞ্জিনীর চোখে বিস্ময়, কী হয়েছে মা?
কল্যাণী মেয়েকে বলেন, তুই এখন যা। ঘর থেকে বেরোবি না একদম। পরে বলছি সব। শিঞ্জিনী একবার বকুল মাসীকে, একবার মাকে দেখে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে চলে যায়। কল্যাণী আস্তে করে বকুল মাসীর পিঠে হাত রাখেন। তারপর গলা নামিয়ে বলেন, কেঁদো না। সবাই শুনতে পাবে তো। কে মেরেছে? ওই নব কন্ট্রাক্টার?
না, না। ওই যে আরেকটা নাম বলল, যে আসবে এখন তোমাদের বাসায়।
কে? ওই বাচ্চু না কি যে বলল, ও?
বকুল মাসী এবার পাগলের মত মাথা ঝাঁকায়, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ।
কল্যাণী এবার সোজা হয়ে দাঁড়ান। স্থির চোখে তাকিয়ে থাকেন বকুল মাসীর দিকে। কী বলবেন ভেবে পান না। এক সময় বকুল মাসী নিজেই বলে, বলতে থাকে, গুছিয়ে বলা নয়, ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাক্যে, ঘটনাক্রম ভেঙ্গে দিয়ে, যখন যে টুকরো মনে আসে।  কল্যাণী এর থেকে যা মানে করেন তা এরকম।  
তেরো বছরের ছেলেটা। পড়াশোনা হয় নি। কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল বকুল মাসী। দুটো পয়সা যদি আনতে পারে। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ভূষণের চা পকোড়ার দোকানে। স্টেশনের পাশেই একটা ঘুপচি মতো অন্ধকার জায়গায় সন্ধ্যার পর মদের আসর বসাত ওই গুণ্ডা ছেলেগুলো। পকোড়া চেয়ে পাঠিয়েছিল। দোকানের মালিক জানে, ওরা পয়সা দেবে কি দেবে না কিছু ঠিক নেই। ছেলেটার হাতে পকোড়ার ঠোঙ্গা ধরিয়ে দিয়ে কথার কথা হিসেবে বলে দিল, পয়সা না নিয়ে আসবি না কিন্তু। আনকোরা বাচ্চা ছেলে, তখনও ঠিক জানে না কোন কথা কতখানি রাখতে হয় আর কখন রণে ভঙ্গ দিয়ে মানে মানে চলে আসতে হয়। ও ঠোঙ্গা বাড়িয়ে দিয়ে পয়সা চাইল। ওরা বলল, যা, পরে পাবি। বাচ্চা ছেলে গোঁয়ারের মত বলতে থাকল, না, না, মালিক বলেছে পয়সা নিয়ে যেতে। না হলে বকবে আমাকে। আর কী। মদের মাথায় আগুন জ্বলল। খালি বোতল পাথরে ঠুকে ভেঙ্গে ঢুকিয়ে দিল পেটে। তারপর তো রক্তপাত। কারা যেন সেখান থেকে বয়ে এনেছিল ভূষণের দোকানে। রেলের পুলিশ ছুটে এল খবর পেয়ে। দোকান-মালিক তাড়াতাড়ি বকুলকে খবর পাঠাল। বকুল থাকত স্টেশনের পাশেই, ঝুপড়িতে। খবর পেয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখে প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে শোয়ানো শরীর। রক্ত বেরোচ্ছে সেই শরীর থেকে। বয়ে আনার রাস্তা জুড়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের রেখা, স্টেশনের বাইরে থাকা অটোগুলোর একটাতে বসিয়ে নিয়ে যায় হাসপাতালে। সঙ্গে ভূষণ ছিল না, অন্য কেউ ছিল। স্ট্র্যাচারে শুইয়ে ইমার্জেন্সীতে নিয়ে যাবার সময় একবার চোখ মেলেছিল ছেলে। কেমন ঘোর লাগা চোখ। কিছু একটা বলল। বকুলই কেবল শুনল, ছেলে বলেছিল ‘মা গো’।  
কথা শেষ করে বকুল মাসী কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। মোড়াতে বসেই দু হাঁটুর ভেতর মাথাটাকে গুঁজে দিয়েছে। দু দিক থেকে দু হাতে চেপে ধরেছে মাথাটাকে। ওকে আর বিরক্ত না করে কল্যাণী এবার ড্রয়িং রুমের দিকে পা বাড়ান। এর মধ্যে পাড়ার শঙ্কর বাবুও এসে জুটেছেন। জোর আলোচনা চলছে। বিভাস একবার তাকালেন কল্যাণীর দিকে। কল্যাণীর চোখে মুখে চাপা উদ্বেগ তার নজর এড়ালো না। ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে। কল্যাণী ইশারায় উত্তর দিলেন, পরে বলছি। বিভাস বসেছিলেন বিছানায়। সোফা সেটের একটা চেয়ার কারও জন্যে খালি রাখা। কল্যাণী তার পাশেই গিয়ে বসলেন। অন্যদের কথা বার্তা শোনার ফাঁকে ফাঁকে বিভাস দু একবার চোরা চাউনিতে কল্যাণীকে দেখলেন। উনি বুঝতে পারছিলেন, কিছু একটা গুরুতর ব্যাপার চেপে আছেন কল্যাণী।  
নব কন্ট্রাক্টার তখন বলছিল, আজ রাতে ওরা শিওর বদলা নিতে আসবে। নদীর ওপারে তো সব গ্রাম ওদের। একবার নদী পেরিয়ে এলে আমাদের এই পাড়াটাকেই পাবে হাতের মুঠোয়। সেই জন্যেই আজ আমাদের একটু সতর্ক থাকতে হবে। এই জন্যেই কালা-বাচ্চুকে ডেকে পাঠিয়েছি।
কালা-বাচ্চুর নাম শুনে একটা নাড়া খেলেন কল্যাণী। গুঁফো লোকটা বলল, তোমাদের ওই কালা-বাচ্চু না কি, ও পারবে আমাদের বাঁচাতে? তার চেয়ে পুলিশের ওপর ভরসা রাখাই তো ভাল। নব কন্ট্রাক্টার গুঁফো  লোকটার পিঠে হাত দিয়ে বলল, পুলিশ আছে গোটা শহরের জন্য। আলাদা করে আমাদের দেখবে কি? হয়তো কয়েকটা বাড়িতে আগুন লাগলে আর কয়েকটা লাশ পড়ে গেলে খবর পেয়ে ছুটে আসবে। ততক্ষণে ওরা নৌকা নিয়ে হাওয়া। আর কালা-বাচ্চুকে তো তুমি জানো না। প্রত্যেকটা রায়টে গোটা শহরের বল ভরসা এই কালা-বাচ্চু আর তার দলবল। নেহাত আমার সঙ্গে ভাল খাতির, তাই আজ রাতটা এ পাড়ায় থাকতে রাজী হয়েছে।
কল্যাণীর মনে হল তার গা গুলোচ্ছে। বিভাসকে হাতের খোঁচায় ইশারা করে উঠে পড়লেন। বেরিয়ে গেলেন ড্রয়িং রুম ছেড়ে। বিভাস একবার অন্যদের দিকে তাকালেন। তারপর উঠে পড়লেন। পর্দা সরিয়ে খাবার জায়গাটাতে এসে দেখলেন কল্যাণী বেডরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। ইশারায় বিভাসকে ডেকে ঢুকে পড়লেন বেড রুমে। পেছন পেছন ঢুকলেন বিভাস।  
কল্যাণী ঘুরে দাঁড়ালেন বিভাসের মুখোমুখি। বললেন, এই কালা-বাচ্চু ছেলেটা আমাদের বাড়িতে আসবে কেন?
বিরাজ একটু কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, আমাকে তো আর আগে বলে নি কিছু। এখানেই ডেকেছে। কিন্তু কি হল তাতে, সামান্য সময়েরই তো ব্যাপার! আমাদের ঘরে তো আর রাত কাটাতে আসছে না।
কিন্তু অন্য জায়গাতেও তো ডাকতে পারত। আমরা দু জনে কাজে বেরিয়ে যাই, মেয়েটা একা থাকে ঘরে। ঐ এক বকুল মাসীর ভরসায়। ও রকম ছেলেকে প্রশ্রয় দিলে কখন কী ঘটবে বলা যায় কিছু? জানো ও কী করেছে?
কী করেছে?
বকুল মাসীর তেরো বছরের ছেলেকে ভাঙ্গা মদের বোতল পেটে ঢুকিয়ে মেরে ফেলেছে। ঈস, ভাবতেই আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। কত বড় ক্রিমিনাল। সে কি না আসছে আমাদের রক্ষক হয়ে? বাঁচাবে আমাদের?  
বিভাস হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন কল্যাণীর দিকে। তার মুখে কথা ফোটে না। কয়েক সেকেন্ড এভাবে তাকিয়ে থেকে বললেন, কে বলল?
বকুল মাসীই তো বলল। তখন ড্রয়িং রুমে ঢুকে ওই কালা-বাচ্চুর নামটা শুনেই তো ওর ও রকম ফিটের মত অবস্থা হল।  
বিভাসের কপালে হিজিবিজি রেখা ফোটে। কোমরে হাত দিয়ে উনি মাটির দিকে তাকিয়ে থাকেন। যেন কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারছেন না। তারপর কল্যাণীর দিকে একবার তাকিয়ে মাথায় একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে পা বাড়ালেন ড্রয়িং রুমের দিকে।
পর্দা সরিয়ে ঢুকতেই নব কন্ট্রাক্টারের কথা শুনতে পেলেন, মোবাইলে কাকে বলছে, ও, আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা অপেক্ষা করছি। এসো তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো।
কথা শেষ করে বিভাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, বাচ্চু ফোন করেছিল, অন্য পাড়ায় একটা মিটিং হচ্ছে, সেখানে আটকে গেছে। একটু দেরী হবে আসতে। এই ধরো আধঘণ্টা।
বিভাসের মাথায় তখন অনেক কথা ঠেলাঠেলি করছে। তার মধ্যে যে বাক্যটি আগে বেরোল, তা হল, আচ্ছা নব, এই কালা-বাচ্চুকে এখানে না ডাকলে হত না? হাজার হোক একটা ক্রিমিনাল ছেলে, ভদ্রলোকের বাসায় ওকে ডাকা টা...
সবাই বিভাসের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কথাটা শুনে নেবার পর গুঁফো লোকটি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন নব কন্ট্রাক্টারের দিকে। আর শঙ্কর বাবু মাথা নামিয়ে তাকালেন মেঝের দিকে। নব কন্ট্রাক্টার একটু হিসেবি চোখে বিভাসকে এক পলক জরিপ করল। তারপর বলল, এতক্ষণ পরে এই কথা বলছ বিভাসদা। তোমরা কি ক্রাইসিসটা বুঝতে পারছ না? আর কাকে ক্রিমিনাল বলছ, জানো কালা-বাচ্চুকে আর ক’দিন পরে সবাই বাচ্চু-বাবু বলে ডাকবে। জানো, ওর পেছনে পলিটিকাল সাপোর্ট কত? সব দল ওকে হাতে রাখতে চায়। ভাগ্যিস আমি পুরনো খাতিরে ওকে আমাদের দলে পেয়েছি। এ রকম সিচ্যুয়েশনে একটা শো অফ স্ট্রেংথ দেখাতে পারলে তবেই সবাইকে একজোট করা যায়। আর কালা-বাচ্চুর মত লোক ছাড়া এসব হয়?  
নব কন্ট্রাক্টারের চোখে মুখে বিরক্তি ফুটল। তারপর একটু যেন সতর্ক হয়ে প্রসঙ্গ পাল্টানোর মত বলল, তা ছাড়া সন্ধ্যা থেকে আমরা এই বিষয় নিয়ে কথা বলে যাচ্ছি, তোমার আপত্তি থাকলে আগে বলতে, আমরা অন্য খানে ডাকতাম। হঠাৎ করে কী হল তোমার?
বিভাস অপরাধীর গলায় বললেন, আসলে আমিও তো সব জানতাম না। এই একটু আগেই একটা কথা জানলাম। ও না কি আমাদের যে কাজের মাসী, ওই বকুল মাসীর ছেলেকে পেটে ভাঙ্গা বোতল ঢুকিয়ে মেরে ফেলেছিল? তোমার বউদি তো এ কথা শুনে প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
নব কন্ট্রাক্টার এবার পিঠ সোজা করে বসল। তারপর পুরনো কথা মনে করার ভঙ্গীতে বলল, ও,  আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। সেই ছেলেটার মা নাকি এই মহিলা?
বিভাস যেন একটু ভরসা পেলেন, প্রয়োজনের চেয়ে বেশী জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, হ্যাঁ তো।
বুঝলাম। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল, কিন্তু সে তো কোন কালের কথা। দশ বারো বছর আগের কথা হবে।
সেই জন্যেই আমার একটু কেমন লাগছে।
নব কন্ট্রাক্টার এবার যেন বেশ গভীর ভাবনায় ডুবে গেল। কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলছিল না। শঙ্কর বাবু হঠাৎ বলে উঠলেন, একটা বড় সমস্যা সামলাতে গেলে এই সব ছোট খাটো ব্যাপার ইগনোর করতে হয় বিভাস বাবু। এখন আমদের জান নিয়ে টানাটানি। এখন এসব খুচরো ব্যাপার...
গুঁফো লোকটা বলল, বুঝলাম। কিন্তু একটা ইমেজের ব্যাপারও তো আছে।
নব কন্ট্রাক্টার এবার মুখ তোলে। চশমা খুলে রুমালে মুছে নেয় একবার। তারপর বলে,
দেখো বিভাসদা, এই যে আমদের আর্মিরা আছে, কখনও তারা হাটে বাজারে হুজ্জতি করে, কখনও মেয়েছেলেদের ওপর চড়াও হয়। অনেক বদনাম আছে ওদের। কিন্তু ফ্লাডের সময় দেখেছো, কী রকম কাজ করে? সীমান্তে টেররিস্টদের সঙ্গে লড়াই করে কত জন প্রাণও দেয়। তখন তো ওদের আমরা শহীদের সম্মান দিই। কি, দিই না?
তা দিই। বিভাস দুর্বল গলায় বলেন।
ধরে নাও এটাও তাই। আরে আমাদের জান মালের প্রশ্ন যেখানে, সেখানে কি আর ওই এক চায়ের  দোকানের কর্মচারীকে কে মারল আর কেন মারল, এসব ভাবলে চলে?
বিভাস চুপ করে রইলেন। তার মনে হল, কল্যাণীর সামনে গিয়ে দাঁড়াবার, চোখে চোখ রেখে তাকাবার সাহস তার হারিয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই উনি তার যুক্তি বুদ্ধিকে জড়ো করে তুলতে পারছেন না।
নব কন্ট্রাক্টার এবার একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বলল, তা ছাড়া ওই মামলায় কালা-বাচ্চুর বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষী দেয় নি কিন্তু। বেকসুর খালাস পেয়েছে। তার মানে, জেল খাটা আসামী বলতে যা বোঝায়, সে কিন্তু তা নয়। তুমি তো এক তরফের কথা শুনেছো। আসল ঘটনা কী, তা তুমিও জানো না, আমিও জানি না।
বিভাস এবারও কোনও উত্তর দিতে পারলেন না।  
নব কন্ট্রাক্টার একটু মোলায়েম গলায় বলল, ঠিক আছে, বিভাসদা। তোমার সমস্যা আমি বুঝতে পারছি। আমরা বরং একটা কাজ করি। কালা-বাচ্চু এলে আমরাই বাইরে গিয়েই ওর সঙ্গে কথা বলে নেব। তোমার ঘরে ডাকব না। এতে তো আপত্তি নেই তোমার?   
বিভাস পুতুলের মত মাথা নাড়ালেন কেবল।
*
            রাত প্রায় নটা। কল্যাণী বিছানায় বসে বালিশে মাথা গুঁজে রেখেছিলেন। সাত পাঁচ ভাবতে এক সময় তার চোখ লেগে গিয়েছিল। হঠাৎ ঘুমের চটকা ভাঙ্গতে খেয়াল করলেন, ড্রয়িং রুম থেকে অনেকক্ষণ কোনও কথা বার্তার আওয়াজ আসছে না। কৌতূহলে আস্তে আস্তে উঠে উনি ড্রয়িং রুমের পর্দার ফাঁকে চোখ রাখলেন। বিছানায় কেমন ধ্বস্ত ভঙ্গীতে বসে আছেন বিভাস। সোফায় সেই আগের মত, তিন জন। একটা সোফা খালি পড়ে আছে। যেন একটা আমন্ত্রণ সাজানো। কেউ কোনও কথা বলছে না। নব কন্ট্রাক্টার একবার ঘড়ি দেখছে আর একবার মোবাইলে চোখ রাখছে।
            পর্দা না সরিয়ে ফিরে আসেন কল্যাণী। বাথরুমে ঢুকে চোখে মুখে একটু জল দেবার সময় তার মনে হল বকুল মাসীর ছেলের রক্ত তার হাতেও এসে লেগেছে। এখন তাকে রান্না ঘরে যেতে হবে। বকুল মাসীর মুখোমুখি হতে হবে। মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করেন কল্যাণী।
---------------------------

No comments:

Post a Comment