Monday 10 October 2016

তাক্কত



তাক্কত
-মলয়কান্তি দে
ইলিয়াসের চায়ের দোকানে বাঁশের বেঞ্চে বসে ফজল আলি বলছিল, ইবার দেখতায় মজা।
বড় রাস্তাটা সটান শুয়ে আছে পূবে পশ্চিমে। হুস হুস করে চলে যাচ্ছে ছোট গাড়ি, বাইক। দূর থেকে গম্ভীর গরগর শব্দ তুলে বাস আসছে, ট্রাক আসছে। চলে যাচ্ছে রাস্তা কাঁপিয়ে। হঠাৎ কোনও বাস একটু গতি কমায়। ইলিয়াসের দোকানে যারা বসে বসে গুলতানি মারে, তারা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, দেখে নেয় কে নামছে বাস থেকে। কোনও দরকারে নয়, অলস কৌতূহলে। অথবা অভ্যাসে। বাস থামার শব্দে ঘাড়গুলো ঘুরবেই। রাস্তার এপাশে ইলিয়াসের চায়ের দোকান এবং সেই দোকানের ওপর বিশাল ছাতার মত ছড়ানো শিরীষ-গাছটার পাশ দিয়েই একটা মাটির রাস্তা নেমে গেছে এদিককার গ্রামগুলোতে যাবার জন্য। উল্টোদিকেও ঠিক তেমনি রাস্তা নেমেছে ওইদিকের গ্রামগুলোতে যাবার জন্য। ওদিকের গ্রামগুলো হিন্দুদের। আর এদিকে, এই ইলিয়াসের দোকানের পাশ দিয়ে নেমে যাওয়া রাস্তাটা গেছে মুসলমান গ্রামগুলোর দিকে। এদিকের জন্য একটা বাড়তি পাওয়া এই শিরীষ গাছ। রাস্তার এপারে আগে থেকেই ছিল গাছটা। প্রখর গ্রীষ্মের দিনে ঝাঁকড়া মাথার শিরীষ তার ঝিরিঝিরি ছায়া বিছিয়ে রাখত। হু হু করে ছুটে আসত মাঠ-ভাঙ্গা হাওয়া। যতই তেতে থাকুক রাস্তার অ্যাসফল্ট, শিরীষের তলায় দাঁড়ানো মানুষজনেরা খুব আরাম পেত। বুদ্ধি করে ইলিয়াস এই গাছের তলায় বাঁশের খুঁটি গেড়ে, বাঁশের তরজা আর প্লাস্টিক শিটের চালা বানিয়ে, দোকান পেতে বসল, বাঁশের বেঞ্চ বানিয়ে দিল বসার জন্য। চলতি ফিরতি মানুষের খুব সুবিধা হল। তবে বেশী সুবিধা হল গ্রামের সেই যাদের হাতে অনেক সময় আছে। গ্রামে এমন একটা আড্ডার জায়গার বড় অভাব। কম বয়সীরা খুব পছন্দ করল এই চালা আর বেঞ্চের ব্যবস্থা। দোকান তাই জমে গেল। উল্টোদিকের ভাগ্যে তেমন কিছু ছিল না। না শিরীষ, না চায়ের দোকান। ছায়া পেতে বা চা খেতে ওদের এপারেই আসতে হয়। তবে গাছটা রাস্তার এধারে পড়েছে বলে, আর ইলিয়াস নিজেও যেহেতু মুসলমান, দোকানটাতে তাই প্রধানত মুসলমান ছেলেদেরই আড্ডা জমে। হিন্দু ছেলেরা এই দোকানে নিজের থেকে এসে ঢুকতে একটু কিন্তু কিন্তু করে।
আড্ডা জমে সকালে এক প্রস্থ, আবার বিকেলে এক প্রস্থ। মাঝখানে ভরদুপুরের বিরতি।
এমনি এক সকালের আড্ডায়, বাঁশের বেঞ্চে বসে ফজল আলি উপস্থিত সবাইকে শুনিয়ে খুব বহুদর্শী মানুষের মত বলল, ইবার দেখতায় মজা।   
উপস্থিত সকলকে বলতে এই মুহূর্ত্যে দোকানে আছে ইলিয়াস, ফজল, আলাউদ্দিন আর একলাস। ফজল আলির একবার মনে হল, কথাটা আরেকটু জমজমাট আসরের জন্য তুলে রাখা দরকার ছিল। এখানে তো হাতে গোণা শ্রোতা। কিন্তু মনে কথা এলে সেটা বাসি করতে ইচ্ছে করে না। ফজল শুধু চেষ্টা করেছিল কথাটা যেন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ শোনায়। তাই বড়শী ফেলার আগে চার ছড়িয়ে মাছ টেনে আনার মত একটা সামান্য ভূমিকা করেছিল। ইবার দেখতায় মজা, বলে থেমে গিয়েছিল। ঔৎসুক্যে তিনখানা মুখই ফজলের দিকে ঘুরে ছিল। কিন্তু ফজল কথাটা বলতে যাবে, তার মধ্যেই একটা বাস গতি কমিয়ে এসে থামল উল্টোদিকে। চারখানা মাথাই আবার ঘুরে গেল রাস্তার দিকে। কেউ নামছে বাস থেকে। উল্টোদিকে এসে থামা বাসে কে উঠল, কে নামল, এখান থেকে দেখা যায় না। বাস চলে যাবার পর দেখা গেল, নেমেছে বিজয় পাল। বাসের চাকায় যেটুকু ধুলো উড়েছিল, বিজয় পাল নাকের সামনে হাত নেড়ে তা সরাবার চেষ্টা করছে এবং এদিকে, অর্থাৎ ইলিয়াসের দোকানের দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখের ওপর পড়া রোদ আড়াল করতে ডান হাতখানা তুলে ধরেছে কপালের উপর। দোকানের চালার ভেতরটা তেমন অন্ধকার নয়, কিন্তু রোদে দাঁড়িয়ে বিজয় পাল বোধ হয় ভাল দেখতে পেল না । সে জানে, চেনা কেউ থাকলে একটা হাঁক দেবে, কিতা বা পালবাবু, কানো গেছলায়। আর তাতে বিজয় পাল এসে দোকানে ঢোকার একটা অছিলা পাবে।
দু দিকের গ্রামগুলোর প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। দুদিক মিলিয়ে হাইস্কুল আছে একটাই। তাই পাশাপাশি সময়ের ছাত্রদের সবাই স্কুলের চেনা। একই হাটে হাট করতে যাওয়া। তাতেও নিত্যদিন দেখা হয়। কথাবার্তা আছে। ইয়ার্কি, ফাজলামি আছে। বিজয় পাল এদিকেই তাকিয়ে আছে দেখে ইলিয়াস বুঝতে পারে, বিজয়দা দোকানে এসে একটু বসে যেতে চাইছে। হয়তো চায়ের তেষ্টা, বা হয়তো এই সকাল এগারোটাতেই বাড়ি ঢুকে যাওয়ার ইচ্ছে নেই, ভাবছে কোথাও একটু সময় কাটালে ভাল হয়। তাই ইলিয়াস নিজেই হাঁক দেয়, কিতা অইল বিজয় দা, আও না। চা এক কাপ খাইয়া গিয়া বাড়িত ঢুকো।
এই ডাকটারই অপেক্ষা থাকে। বিজয় পাল খুব সাবলীল ভঙ্গীতে রাস্তা পার করে এপারে চলে এল, মাথা নুইয়ে ঢুকে পড়ল ইলিয়াসের চালার তলায়। রসিকতা করে ইলিয়াসকে বলল, কিতা বেটা, চা খাইবার লাগি ডাকিয়া আনছস, মাগনা খাওয়াইবে নি।
ইলিয়াস চায় তার দোকানে সবাই আসুক। কেবল ব্যবসায়িক কারণেই নয়,  সে জানে শুধু মুসলমান ছেলেদের আড্ডা হলে দোকানটা কেমন ছাপ্পামারা হয়ে যাবে। ইলিয়াস চায় না সেটা। তাই ওপাশের গ্রামগুলোর খদ্দের পেলে সে একটু বাড়তি খাতির করে। সে তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে জবাব দিল, খাও না। আইজ মাগনা খাইবায়, কাইল ডাবল দাম দিলাইবায়। তেউত্তো হিসাব মিলি যাইব। আও, বও অবায়দি।
ইলিয়াসের নির্দেশিত বেঞ্চে বসার আগে বিজয় পাল ফু দিয়ে ধুলো ঝাড়লো। তাকিয়ে দেখল আর কে কে আছে। চেনা মুখ সব। আলাউদ্দিন, ফজল আলি আর একলাস মিঞা। বিজয় একবার ফজল আলির দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল, যার অর্থ, কিতা বা, কেমন চলের। ফজল আলি সামান্য হেসে বোঝাল, ঠিকই চলছে। তারপর পাল্টা জিজ্ঞেস করে, আইজ দেখি বড় তাড়াতাড়ি ঘরো ঢুকি যাইরায়। বিজয় পাল রুমাল বের করে ঘাড়ের ঘাম মুছে। ধুর, গেলাম ডিসি অফিসো, কাম আছিল একটু, এর মাঝে এক দলে আইয়া লাগাই দিলা হাঙ্গামা।  
কিওর হাঙ্গামা বা? ফজল আলি উৎসুক হয়।
ওউ কারে বুলে ডিটেনশন ক্যাম্পো নিয়া ঢুকাই দিছে, বেটি আইজ বত্রিশ বছর ধরি ইন্ডিয়াত। অখন বুলে তাই বিদেশী।
ফজল আলি খুব চারদিকের খবর রাখে। নানা অফিসে তার যাওয়া আসা। রাজনীতির কারবারিদের আশে পাশেও ওকে ঘুরতে দেখা যায়। সে বলল, বুঝছি, বুঝছি। ওউ কিতা সুলেখা দাস না কিতা বেটির নাম। বেটির জামাই গরমেন্টর চাকরিয়ান আছিল। মরছে আইজ তিন চাইর বছর অইল। কাইল রাইত হুনিয়া আইছি টাউনো।
বিজয় পাল এত সব জানত না। অজ্ঞতা প্রকাশ না করে সে মনোযোগ দিয়ে ঘাম মোছে। তার মেজাজ বিগড়ে আছে, এই রোদের মধ্যে বেরিয়ে তার কাজটা হল না। ক্লান্তি ও বিরক্তি ঝরিয়ে সে বলে, ই যে কি এক ফাইজলামি আরম্ভ অইছে।  একবায় তুমরা এনারসির কাম আরম্ভ করছ। তে ওটা শেষ অউক! তার আগে ই বিদেশী সাজাইয়া নিয়া ডিটেনশন ক্যাম্পো ভরাই দিতরায় কেনে? ইতা কিতা খালি মাইনষরে ডর দেখানি নি? একবায় মাইনষর মাথা গরম এনারসির কাগজ পত্র জোগাড় করাত, তার মাঝে আবার মাথার উফরে আরক ডর, অউ নি ভরাই দেয় ডিটেনশন ক্যাম্পো। খামকা থাকি আমার কাম ইখান আটকি গেল। অখন কাইল আবার যাও।
 চা বানাতে বানাতে ইলিয়াস জিজ্ঞেস করে, তোমারতান গাউর হকলর এনারসির কাগজ পত্র জমা দেওয়া শেষ নি বিজয়দা?
বিজয় পাল যেন নিজেকেই উত্তরটা দিচ্ছে, সেরকম ভঙ্গীতে বলল, চলের। বউতে দিছইন, বউতর অখনও বাকী। ই আরক না-কামর কাম লাগছে। তারপর যোগ দিল, অত বছর পরে অখন কই পাইতায় পুরানা ভোটার লিস্ট, কই পাইতায় কিতা।
ফজল আলি সবজান্তার মত বলে ওঠে, হকলতা পাইবায়। পাঞ্চাইতো গেলে ভোটার লিস্ট পাইবায়। আর নায় যেছা খান থাকি ইন্টেরনেটোও দেখিলাইতায় পারবায়। আর নাইলে কুন্তা না কুন্তা কাগজ অইলেউ অইব। জেগা জমির দলিল, আরও কিতা কিতি, পেপারো লিস্টি দিছে, দেখিলাইও। দেওয়া যখন লাগব, তে আর একটু মে’নত করিয়া দিলাইতায় আর কি।
এনারসি নামক একটি জটিল প্রক্রিয়াকে ফজল আলির এভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা বিজয় পালের পছন্দ হল না। তার প্রত্যাশিত ছিল একবাক্যে সমর্থন। সবাই তাই করে। এনারসির কথা উঠলে সবাই হৈ হৈ করে মনের ক্ষোভ ঝাড়ে। এটাকে ভাবে যেন এক সরকারী জবরদস্তি। অথচ ফজল আলি একেবারে সরকারী কর্মকর্তার মত গড়গড় করে নির্দেশাবলী আওড়ে গেল। সে একটু গলা তুলেই বলল, আমার লাগি নায় রেবো। আমার তো হকল কাগজওউ আছে। কিন্তু গরীব মাইনষর কথা চিন্তা কর। তারা না পড়া শুনা জানে, না ঘরো কোনও কাগজ পত্র ঘর রাখে। রাখলেও ইন্দুরে কাটব না উলিয়ে খাইব তার ঠিক নাই। তার মাঝে কত জন বিদেশ-বাড়িত আছে, চায়-চাকরি করের। হকলে কুনু আর ছুটি লইয়া আইতো পারব নি। তারা কিতা করত?
ফজল আলি অবশ্য পিছু হটে না। বলে ইতা কুনোটাউ কুনো সমস্যা নায় বিজয়দা। অনলাইনে জমা দিবার ব্যবস্থাও তো আছে।
এবার একটু বিরক্ত হয় বিজয় পাল। তুমি তাইন কোন হাগো থাকো বা। অনলাইন! তোমার গাউর কয়জনে পারবা অতা অনলাইন জমা দিতা। যে করিয়া দিব তারেও পয়সা দেওয়া লাগব। আর যেইন যেইন পারবা, তান তান লাগিয়াও ইটা একটা ফালতু কাম অইল না নি! ইটার কী দরকার আছিল? ভোটার লিস্টো নাম আছে, তার পরে আবার ই এনারসি কেনে?
আকলাস বসে বিড়ি টানছিল একপাশে। এবার বলে, ইতা কিতা বা হকলর দেওয়া লাগের নি। না খালি আমরার বাঙ্গালি হকলর। ফজল আলী উত্তর দেয়, না না, ইনো আর বাঙ্গালি, আসামি, নেপালি, কারবি নাই। যেইন যেইন আসামো আছইন, তান তান হকলর দেওয়া লাগব।
আকলাস যেন একটু আশ্বস্ত হয়। ঝামেলা তাহলে সবাইকেই পোয়াতে হচ্ছে। ফজল আলির মনে হয় এ ব্যাপারে বিজয় পালকে সে যথেষ্ট কাবু করতে পারে নি। সে আবারও প্রসঙ্গটা ওঠায়। বোঝাবার চেষ্টা করে, এনারসির কাজটা করতে সরকার কেন দায়বদ্ধ। আসাম চুক্তির কথা বলে। আর একবার এই কাজ শেষ হয়ে গেলে কত রকমের ঝামেলা থেকে মুক্তি ঘটবে তাও জানায়।
একবার কাম অখান শেষ অইতে দেও, তারপরে কইও, ভালা অইলো না খারাপ অইলো।
বিজয় পাল যুক্তি হিসেবে কিছু বলার না পেলেও কথাগুলোকে বড় সহজে নিতে পারে না। বড় বেশী সহজ সরল গল্প। যেন সরকারি বিজ্ঞাপনের ভাষা। তার সন্দেহ হয়, ফজল আলি কিছু একটা খেলা খেলছে। জেনে শুনেই সমস্যাটাকে খাটো করে দেখাতে চাইছে। নইলে সেও সমস্যাগুলো ভালই জানে। একটু রাগ দেখিয়েই সে বলে, তুমি আশা কররায় একবার এনারসি অই গেলে হকল ঝামেলা শেষ। আর আমি কইয়ার, লেখিয়া রাখিও আমার কথা, আমরারে, আমরার বাঙ্গালী মাইনষরে তারা কুনো দিন শান্তিতে থাকতে দিত নায়। একতা নাইলে আরেকতাত নিয়া পেচাইবো। আসল কথা হখান। চায়ের গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে বিজয় পাল এমন ভাবে হাত নামিয়ে আনছিল যেন গ্লাসটা খট করে সামনের টেবিলে রাখবে। কিন্তু সামনে কোনও টেবিলই নেই, এটা খেয়াল হতে ওর নেমে আসা হাতখানা আনাড়ি ভঙ্গীতে শূন্যে আটকে থাকল। ইলিয়াস এগিয়ে এসে কাপটা নিয়ে নেয়। বিজয় পাল এবার উঠে দাঁড়ায়। ইলিয়াসের দিকে পয়সা এগিয়ে দিয়ে চালা থেকে বেরোবার মুখে ফজল আলির দিকে তির্যক তাকিয়ে শেষ তাসটা মাঠে ফেলে।
অখন তো যেতা হুনা যার, হিন্দু হকলরে যদি শরণার্থী হিসাবে মানি লায় সরকারে, তে আর আমরার কুনো ঝামেলাউ থাকতো নায়। তখন তুমি ফজল আলি বইয়া বইয়া লিগেসির ডেটা বাছবায় আর আমরা কীর্তন গাইমু।
বিজয় পাল আর কোনও প্রত্যুত্তরের সুযোগ রাখল না দেখে ফজল আলির মনে হল আলোচনাটা মাঝপথে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। খুব কিছু যায় আসে না, কারণ এসব আলোচনা বলতে গেলে রোজ ওঠে। তবু একটু হতাশ লাগল তার। কিন্তু কিছুই করার  নেই। কারণ বিজয় পাল ততক্ষণে পা বাড়িয়ে দিয়েছে। ফজল আলি কেবল একটা সবজান্তা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বিজ্ঞের মত মাথা নাড়তে নাড়তে বিজয় পালকে যেতে দিল। বিজয় পালও নিজের হাসি অম্লান রেখে দুদিক দেখে সাবধানে রাস্তা পার হল। তারপর ওপাশের মাটির রাস্তা ধরে নামতে লাগল।
বিজয় পালের চলে যাওয়ার দিকে চোখ রেখে একটু অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিল ফজল আলি। আলাউদ্দিনও তাকিয়েছিল সে দিকে। এবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফজল আলিকে জিজ্ঞেস করে, হাছাউ কিতা বা হিন্দু হকলর এনারসি লাগত নায় নি। ফজল আলি হেসে বলল, আরে দেখ না সরকারে কোন খেল খেলায়। অত সহজ নায়। বুঝছো নি। সরকারোর খেল সরকারে খেলের। সরকারে নাচাইত আর তুমি আমি নাচিতাম। তুমার আমার হাতো আছে নি কিচ্ছু? আলাউদ্দিন ফজলের দিকে তাকিয়েই ছিল। যদি ফজল আরেকটু  খুলে বলে। ফজল আর খুলে বলল না কিছু। একলাস তাকে মনে করাতে চাইল, তুমি নু কিতা মজার কথা কইতায় আসলায় বা ফজল ভাই। কইলায় না দেখি। ফজল আলী উত্তর দেয়, আর কইতাম কিলা বা। আই গেলো নু বিজয় পাল। হকলর সামনে হকলতা মাতা যায় নি? কথাটা সবাই মানে। সবার সামনে সব কথা বলা চলে না। তাই একলাস এখন একটু তোয়াজের সুরেই বলে, আইচ্চাতে, অখন কইলাও। অখন তো আর বিজয় পাল নাই। সবউ আমরার।
ফজল আলী তার কথাটা যে ভাবে বলবে বলে মনে মনে সাজিয়ে রেখেছিল, বিজয় পাল এসে পড়ায় তার সাজগোজ অবিন্যস্ত হয়ে গেছে। কিছুটা অগোছালো পরিবেশনার মতই সে বলতে শুরু করে, অউ এনারসির কথাউ কইতাম আছলাম। এমনে তো কথায় কথায় হকলে খালি আমরারেউ বিদেশী কইন, কথায় কথায় বাংলাদেশেদি ঠেলি দিতা চাইন। রাস্তায় ঘাটে দেখবায় মোছলমান অইলায় তে তোমারে আইয়া পইঞ্চাশ কথা জিগাইব। কথাত থুড়া বেরা লাগি গেলেউ কইব কাগজ দেখাইতায়। দেখাইতায় পারলায় না, তেউ ধরিয়া লইয়া যাইবগি থানাত। তারপরে যাউক্কা তুমার বাফ-চাচা-আরি-পরি, কাগজ দেখাইয়া, উকিল মেজিস্ট্রেইট পুলিশ দারোগা হকল দেফতারে খুশ করিয়া তেউ ছাড়া পাইলে পাইতায়। আর অখন অইছে মজা। এনারসির ডর কুনু আমরার নি। আমরা কিতা পাকিস্তান থাকি ভাগিয়া আইসি নি? আমরা হকল তো নিজর নিজর মাটিত আছি। ভাগিয়া আইছইন তো হিন্দু হকল। অখন এনারসির ডেটা খুজিয়া তান-তানউ বাশ ঢুকের। এল্লাগিউ কইসলাম। সবুর কর। মজা দেখবায়।  
এটা যদি ফজলের মজার কথা হয়ে থাকে, কেউ যে বিশেষ মজা পেয়েছে, অভিব্যক্তিতে কারো সেটা ধরা পড়ল না। শুধু পেছন থেকে শোনা গেল আম্মদ আলির গলা, হে হে, বাচ ধুকেল বুলে, হে হে হে, বাচ ধুকেল বুলে। উচ্চারণ আর গলার আওয়াজে সবাই বুঝতে পারে, আম্মদ আলি এসেছে। সবাই পিছনে তাকালো। ছেঁড়া লুঙ্গির ওপর ছেঁড়া গেঞ্জি, মাথায় বাঁশের ছাতা দড়ি দিয়ে থুতনিতে আটকানো। আম্মদ আলি ইলিয়াসের ভাগনে। হাবাগোবা অল্পবুদ্ধি ছেলে। কাজ কর্ম বিশেষ কিছু জানে না। গরু রাখালি করত। তাতেও লোকেরা ওকে তেমন ভরসা করতে পারে না। গরু কোথায় আর ও কোথায় কিছুই ঠিক থাকে না। তবু নানা লোকের নানা ফাই ফরমাস খাটে, সামান্য কিছু আয় হয়। টাকায় না হলেও ধানে চালে। ওর মা এবাড়ি ওবাড়ি টুকটাক কাজ করে। এতেই দু জনের সংসার চলে। সারা দিন ঘুরে ঘুরে একসময় ও ইলিয়াসের দোকানে এসে হাজির হয়। আম্মদ আলি সকলের কথা খুব শুনতে খুব ভালবাসে। যে কেউ কথা বলুক, ও একেবারে মুখের সামনে গিয়ে সেই কথা শুনতে থাকে। কি বোঝে, ওই জানে। কথার তালে তালে খুব সমঝদার মুখ বানিয়ে মাথা নাড়ে। কখনও কখনও ওর ঠোঁট নড়ে, যেন কথাগুলোর পুনরুক্তি করছে। একজনের কথা শেষ হলে যখন অন্য কেউ কথা বলছে, আম্মদ আলী তখন জায়গা পালটিয়ে চলে যায় নতুন বক্তাটির একেবারে মুখের সামনে। ওর এভাবে দাঁড়ানোতে পরিচিত লোকেরা বিরক্ত হয় না, সরে যেতেও বলে না। যদি কখনও ওর দাঁড়ানোতে কারও উদ্দিষ্ট শ্রোতা আড়ালে পড়ে যায় তাহলে হাত দিয়ে ঠেলে ওকে সরিয়ে দেয় শুধু। আম্মদ আলি কখন এসে চালায় ঢুকেছে, ইলিয়াসও খেয়াল করে নি।
আম্মদ আলির হে হে হাসি শুনে কেউ হাসল না। সবাই কেমন গম্ভীর আর চিন্তামগ্ন হয়ে বসে আছে। এমন পরিস্থিতি আম্মদের পছন্দ নয়। সে চায় সবাই হেসে হেসে কথা বলুক। না হয় তাকে নিয়েই হাসাহাসি করুক। সবাই চুপচাপ বসে থাকলে ওর বোধ হয় কিছু একটা মানসিক চাপ তৈরি হয়। আম্মদ আলি সকলের মুখের সামনে গিয়ে অকারণে হাসতে থাকল হে হে করে। পালা করে একেক জনের সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে আর হে হে করে হাসছে। আলাউদ্দিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে আলাউদ্দিন বলে উঠল, তোর লিগ্যাসি ডেটা কই রে, দেখা চাই। আম্মদ বোকার মত তাকায় আলাউদ্দিনের দিকে, তারপর তাকায় মামা ইলিয়াসের দিকে। তার মনে হয় এই কথাটায় কিছু একটা অসভ্য ইঙ্গিত আছে। অতীত অভিজ্ঞতায় সে জানে যে এরকম সময় সবাই ওর লুঙ্গি খুলে ফেলতে চায়। সে দু হাতে লুঙ্গির গিঁট শক্ত করে ধরে ভীত সন্ত্রস্ত ভঙ্গীতে সকলের নাগালের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর ভয় পাওয়া চোখে সবাইকে দেখতে লাগল। সবাই হেসে উঠল হা হা করে। হাসি দেখে একটু ভরসা পায় আম্মদ, তারপর নিজে অন্যদের থেকে জোরে হে হে করে হাসতে শুরু করল। ওকে বেশ তৃপ্ত দেখাল। সে এটাই চাইছিল, পরিবেশটা হাসিখুশি হয়ে উঠুক।
ফজল আলি তার মজার কথাটা বলে যেমন প্রতিক্রিয়া আশা করেছিল তেমনটা না পেলেও, বুঝতে পারছিল যে কথাটা সকলেরই ভেতরে গেছে। দমে না গিয়ে সে আবারও শুরু করে, ওউ হুনলায় নানি বিজয় পালে যে কইল, আমরার, মানে বাঙালি হকলর। তারা আসামীর ধেক্কা খাইলেউ আইওয় আমরার কাছে বাঙালি অইয়া। আর চান্স পাইলেউ দেখবায় তারা হিন্দু অই যায়, তখন আর তারা বাঙালি নায়। যখন যেবায় সুবিধা। আসল কথা হকলে খালি সুবিধা খুজে। বিজয় পালে যে কইল, এনারসি অইলেউ কুনু হকল ঝামেলা মিটি যাইব নি, কথা হাচা। সরকারর আইন একবায়, আর মাইনষর চলা একবায়। যে যেখানো মেজরিটি, হে হখানোর রাজা। থানা পুলিশ হকলতাউ তার। হে যেখান চাইব, অখানউ আইন। তুমি যাও না গৌহাটি ডিব্রুগড় তেজপুর। গিয়া কও তুমি গণতান্ত্রিক দেশর নাগরিক। তুমার সবর লগে সমান অধিকার আছে। দেখবায় নে, কই যায় তুমার অধিকার, আর কই যায় আইন। তাক্কত একটা লাগে। অউ তাক্কত থাকলে হকল আইন তুমার, না থাকলে কুনো আইনে তুমারে বাচায় না। এল্লাগিউ আমরা কেউ কেউ যখন খুশী আখতা হিন্দু অই যাই, আখতা মুসলিম অই যাই, ঠেকাত পড়লে আখতা আবার বাঙালি অই যাই। আসলে তাক্কত কই আছে, আমরা কেউ খুঁজিয়া পাইছি না।  
একলাস একটু তলিয়ে ভাবার মানুষ। বলল, ইতাতো ঠিক। একবায় তুমি কইরায় তুমার হকলতা আছে। তুমি ভাগিয়া আইছ না। হিবায় সরকারে কর, হিন্দু হকল শরণার্থী, তারা আর বিদেশী নায়। আর তারার ডরাইবার কুন্তা নাই। তে তো কেউর আর কুনো সমস্যা নাই। কিন্তু আসল কথা কুনু অটা নি?
ফজল আলি চট করে কিছু বলতে পারে না। আম্মদ এসে এবার ফজলের মুখের সামনে দাঁড়িয়েছে। যেন একলাসের কথার জবাবে ফজল আলি কী বলে সেটা জানা তার খুব জরুরি। ওর হা করে থাকা মুখ খানার দিকে অন্যমনস্ক ভঙ্গীতে তাকিয়ে ফজল কিছু বলতে যাবে, তখন একলাসই আবার বলে, যেতাউ মাতো না কেনে, আমরা যতউ নানার নানার থাকি ইখানো থাকি না কেনে, কাগজ পত্র বার করা সহজ নায়। বউত পেচ আছে। হাচাউ তো কইছে বিজয় পালে, ইতা তো না কামর কাম।
ফজল বলে, আমি হি কথা কইরাম না বা। ইতা হকলতা যুগাড় করা, ফর্ম ভরা, অফিসো গিয়া জমা করা, ইতা হকলতাউ বউত ঝামেলার। আমরারউ ঝামেলা লাগে আর গরীব-গুর্বার কথা কইয়া কিতা অইত। অউ ইলিয়াসে জানে, আমরার আম্মদর মার কাগজ পত্র জমা দিতে কি ঝামেলা অইছিল। তাই তো খালি কান্দে আর কয় আমার ই আম্মখ পুয়া ইগুর কি দশা অইব। তুমরা জানো নি, তাই সুইসাইড করিলাইত আছিল, যখন দেখছে তাইর কাগজ পত্র ঠিক নায়। আমরা হকলে কত বুঝাইয়া তেউ আটকাইছি।
সবাই ইলিয়াসের দিকে তাকায়। ইলিয়াসের মুখ ব্যথাতুর হয়। তার মনে পড়ছে তার দিদি, এই আম্মদের মা, সকালবেলা ইলিয়াসের ঘরে এসে হাউ মাউ করে কান্না জুড়েছিল আর বলছিল, আমারে অউ অতা কাগজর বেবস্থা করিয়া দে রে ইলিয়াস। আমার লাগি নায়, তোর ওউ ভাইগ্না ইগুর একটা বেবস্থা করিয়া দে। ই দেশ থাকি খেদাই দিলে ইগু যাইব কই? ইগুতো বেনালে মরব রে ইলিয়াস। ইলিয়াসের দিদি সালেহা বিবির সমস্যা হয়েছিল লিগ্যাসি ডাটায়। যাই হোক ফজল আলি অনেক হাটাহাটি করে ঝামেলা মিটিয়েছে। ফর্ম জমা হয়েছে। এখন বাকিটা দেখা যাইব।
রোদ বেশ চড়ে গেছে আকাশে। পিচ রাস্তার দিকে আর তাকানো যাচ্ছে না। চোখ ঝিম ঝিম করে। একলাস উঠে দাঁড়াল। না বা, বাড়িত যাওয়ার সময় অইগেছে। দেখাদেখি আলাউদ্দিন আর সবশেষে ফজল আলি উঠল। জটলা এবার ভাঙ্গবে। সবাই নিজের নিজের ঘরে যাবে দুপুরের স্নান খাওয়া সারতে। বিকেলে আবার যার হাতে সময় আছে, হয়তো অন্য দু চারজন, এসে আড্ডা জমাবে। হয়তো এই এনারসি, বা অন্য কোনও বিষয় নিয়ে কথা উঠবে। এখন বেশ কিছুক্ষণের জন্য ইলিয়াসের খদ্দের থাকবে না কেউ। সেই রোদ পড়ে যাওয়া অবধি। ইলিয়াস অবশ্য যাবে না কোথাও। এখানেই কিছু রান্না বান্না করে খাবে। তার পর দোকানের ওই সামান্য পরিসরেই শরীর টান করে একটু ঘুমিয়ে নেবে। বাড়ি ফেরার টান ওর কিছু নেই। জমি বেচে বউয়ের চিকিৎসা করিয়েছিল। বউ বাঁচে নি। জমি বেচে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। মেয়ে এখন গিন্নি। বাদবাকি যে এক টুকরো জমি পড়ে ছিল, বেচে ছেলেকে দিয়েছে। ছেলে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করেছিল, বেঙ্গালুরু যাবে। ওখানে গেলে নাকি কিছু না কিছু রোজগারের পথ পাওয়া যাবেই। আশপাশের গ্রামের কয়েকটি ছেলে গেছে। রোজগারও করছে। গ্রামে পড়ে থেকে হবে টা কি। না খেত আছে, না চাকরি। জমি বেঁচে ছেলেকে টাকা দিয়েছে ইলিয়াস। ছেলে গেছে আজ প্রায় ছ মাস হল। কাজ পায়নি কিছু এখনও, তবে পেয়ে যাবে, আশা করছে। বাপকে আর পয়সা পাঠাতে বলে নি, এটাই অনেক। এখন এই একার সংসারে ইলিয়াস রাতেই শুধু বাড়ি যায়। বাড়িতে ঘুমায়। দিনটা কাটাবার জন্য তার এই দোকান আছে। দোকানে একটা জটলা জমেই থাকে। ইলিয়াসেরও সময় কাটে। সামান্য রোজগারও হয়। যখন কেউ থাকে না দোকানে, তখন ইলিয়াস একা বসে বসে এই সামনের রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইলিয়াসেরও অনেক কথা মনে আসে। কাউকে বলতে পারে না। সে পড়ালেখা জানে না। গুছিয়ে কথা বলতে পারে না অন্যদের মত। কিন্তু মাথায় ভাবনা আসে ঠিকই। এখন এই দুপুরের রান্নার আয়োজন করতে করতে সে হঠাৎ আম্মদকে ডাকল, বুঝছস নিরে ও আম্মদ আলি, অবায় হুন। এমন খাতিরের ডাক শুনে কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় আম্মদ, কিতা মামু? ইলিয়াস বেশ কায়দা করে তাকে বোঝায়, কুশিয়ারা গাঙ্গর বান্ধ ভাঙ্গলে, বুঝছস নি, হিন্দুরেও যেলা ঠেলা দিব, মুসলমানরেও ওলাউ ঠেলা দিবো। বাছইনতে একলগে বাচতা, আর নায় এক লগে মরতা।  আম্মদ আলি তার স্বভাব অনুযায়ী একেবারে ইলিয়াসের মুখের ওপর এসে দাঁড়ায়, শুনতে চায়, বুঝতে চায় কি বলছে ওর মামু। কিন্তু সে আবার কি বুঝতে কি বুঝবে কে জানে। ইলিয়াস রান্নায় মন দেয়।

No comments:

Post a Comment