Tuesday 12 January 2016

মেডেল



মেডেল
-      মলয়কান্তি দে
আমাদের রাধানাথপুর বাগানের বাঘুয়া সর্দারের আসল নাম কিন্তু বাঘুয়া নয়। আসল নাম তার সোমরা ভূমিজবাঘুয়া নামটা সে পেয়েছিল বাঘ মেরে। বাঘুয়া, বাঘু, বাঘা - যার যেরকম মুখে আসে ডাকতএখন অবশ্য কেউ আর সেরকম ডাকে না, সকলের মনেও নেই কথাটাএখন কেবল সোমরা নিজেই মাঝে মাঝে মাতলামির ঝোঁকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথাটা বলে। শুনে কেউ কেউ মাথা নাড়ে। হ্যাঁ। কথাটা ঠিক বটেঅনেকেই জানে যে শুধুমাত্র একটা পাকা বাঁশের লাঠি সম্বল করে সোমরা বাঘ মেরেছিল সেদিন   
কি করে কী হয়েছিল সেটা অবশ্য কারো কাছেই তেমন পরিষ্কার নয়। এমনকি সোমরার কাছেও নয়। তার তো তখন মাথা মগজ ছিল মদে চোবানো। আর সময়টাও তখন ছিল সোমরার মাথার মতই, আলোয় অন্ধকারে ছানামাখাশীতকালের শেষরাত। আকাশে গোল্লা সাবানের সরু ফালির মত এক ফালি চাঁদ কুয়াশার চাদরে জ্যোৎস্না ঢালছেকিন্তু মাটিতে হামাগুড়ি দিচ্ছে অন্ধকারঝোপ  ঝাড় গাছপালায় লেপটে আছে অন্ধকারএমনই এক আধখ্যাঁচড়া সময়সোমরা তো তেমন কোনও হাটে গঞ্জে নাম থাকা  মহাশক্তিধর ছোকরা ছিল না যে লোকেরা ওর বাঘ মারার গল্প শুনে এক কথায় ঘাড় নেড়ে মেনে নেবেউঠতি বয়সের ছেলে, গায়ে জোর আছেফুটবলের শট দেখলে সেটা বোঝা যায়। আবার সমবয়সীদের সাথে হুটোপাটি কিংবা কুস্তি-কাবাডিতেও মালুম পড়ে। রংবাজী আছে, দাদাগিরিও আছে। তা বলে শুধু গায়ের তাকতে, স্রেফ একটা লাঠি হাতে, বাঘ মেরে ফেলবে? অথচ বাঘটা মরেছে, সবাই দেখেছে। আর সোমরার কাছে তখন শুধুমাত্র একটা পাকা বাঁশের লাঠি ছাড়া কিছুই ছিল না, সেটাও সবাই দেখেছে। চোখের দেখা বিশ্বাস করতেই হয়। সবাই তাই ঢোক গেলার সাথে কথাটা গিলে নিয়েছে।
সে রাতে যাত্রাপালার আসর বসেছিল বাগানে। কাছের শহর থেকে হায়ার করে আনা যাত্রাপার্টি সোমরা আর তার সঙ্গীরা ছড়ি হাতে গণ্ডগোল সামলাতে ব্যস্ত ছিলপালা শুরু হয় রাত করে, তবে লোকের ভিড় পড়ে যায় সন্ধ্যা থেকেই। মেয়েরা তেরপলে বসে ইদিক উদিক তাকায়; হ্যাজাক বাতির আলো ঝলকায় তাদের চোখে বাচ্চারা ক্যাচর ম্যাচর করে বড়রা এদিক সেদিক হাঁটে আর তলবের টাকা যদি সামান্য বেঁচে আছে পকেটে, তো চলে যায় ঝোপের আড়ালেসেখানে চোলাই মদের আসর বসেছেঝান্ডিমুন্ডাও জমে উঠেছে। মাঝে মাঝে সোমরা বা তার সঙ্গীরাও দু এক ঢোক ঢালে গলায়। কিন্তু তাদের দায়িত্ব আছে। ছড়ি ঘোরাতে হবে। কোথাও কোনও হল্লা হতে দেওয়া চলবে না। হল্লা হলেই যাত্রাপার্টির লোকেরা সিন কেটে নেবে। পয়সা দিয়ে হায়ার করা যাত্রাপার্টি। সিন কেটে নিলে চলবে? কী করে বুঝবে সিন কাটা পড়ল কিনা? কে-ই বা মন দিয়ে পালা শুনছে যে গল্পের ফাঁক দেখেই বুঝে নেবে সিন কাটা গেছে! উপায় আছেবায়না করার সময় জেনে নিয়েছে যুদ্ধ ক’টা হবে। যে পালায় যুদ্ধ যত বেশী, সেই পালার তত চাহিদাসোমরা আর তার সঙ্গীরা তাই ছড়ি ঘোরায়, সবাইকে শান্ত রাখে, আর আঙুলে গুনে হিসেব রাখে, কটা যুদ্ধ গেল, কটা এখনও বাকিরাত এগোয়, পালা এগোয়, তালে তালে এগোয় সোমরাদের ঢোকে ঢোকে মদ গেলা। পালা শেষ হতে হতে দু একজন এদিকে ওদিকে এলিয়ে পড়ে। পালা শেষ হলে অন্ধকার নাটমন্দিরে শতরঞ্চি মুড়ি দিয়ে ঘুমোয়।  
পালা যখন প্রায় শেষের দিকে, মদের নেশা চড়ে গিয়ে শান্তিরক্ষকদের মধ্যেই কাজিয়া লেগে গেল। সবাই দেখল সোমরা আর তার এক গলায় গলায় বন্ধুর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে চিৎকার-গলাবাজি সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে এই যুটির আস্ফালন দেখছে পালার লোকেরা পালা থামিয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে সোমরা কোত্থেকে জোগাড় করেছে একটা পাকা বাঁশের লাঠি। তা দেখে ওর প্রতিপক্ষটিও এদিক ওদিক তাকিয়ে আর কিছু না পেয়ে প্যান্ডেলের একটা খুঁটিই টেনে তুলতে যায়। বাকিরা হা হা করে ওঠেএই খুঁটি  তুলে ফেললে পুরো প্যান্ডেলটাই হুড়মুড়িয়ে পড়বে। সঙ্গীরা দুই যুযুধান বন্ধুকে টেনে সরিয়ে নিল দুদিকে। আবহ একটু শান্ত হয়ে এলে থেমে থাকা পালা আবার বাজনার ঝনৎকারের সঙ্গে চালু হল। সোমরাকে তার সঙ্গীরা টেনে সরিয়ে নিয়ে বসিয়ে রেখেছিল অন্ধকার চা-ঘরের পাকা বারান্দায়। সেখানে বসে বসে সোমরা ঝিমোতে থাকে, তারপর কাঠের খুঁটিতে হেলান দেয়, এবং একসময় শুয়েই পড়ে।  
এই অবধি ঘটনার সাক্ষী আছে। আর এর পরের যে দৃশ্যটির কথা সবাই জানে তা হল, সকালের আলো ফুটলে দেখা গেছে, নিস্তলের ছড়াটার উপর কাঠের কালভার্টের এক প্রান্তে ধুলোয় রক্তে মাখামাখি অবস্থায় অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে সোমরাএকটু পরেই কারও নজরে পড়ল, তলায় ঝর্নার কিনার ঘেঁষে নুড়ি পাথরের মাঝখানে পায়ের পাতা ডোবা জলে একটা বাঘও মরে পড়ে আছেখুব বড় নয়, কিন্তু সত্যিকারের বাঘ। মাথার থ্যাঁতলানো ক্ষত থেকে চুইয়ে পড়া রক্ত পাথরের উপর জমে থকথকে যারা দেখতে পেয়েছিল, তারাই সোমরাকে পাঁজকোলা করে উঠিয়ে আনে, বাগানের গাড়ি করে নিয়ে যায় কাছাকাছি হেলথ সেন্টারে মরা বাঘটাকেও নিয়ে আসে বাগানের অফিস ঘরের সামনে। সোমরার গায়ে বেশ কিছু কাটা ছেঁড়ার চিহ্ন ছিল। হেলথ সেন্টার থেকে ওকে আবার কাছাকাছি ব্লক হাসপাতালে পাঠায়বিকেলের দিকে ওর জ্ঞান ফিরে এলেও সে কথা বলার মত অবস্থায় আসে পরদিন দুপুরের দিকে। আর তারপর যে ভাষ্য শোনা যায় ওর মুখে, ধরে নেওয়া যায় তাতে রঙ মাখানো নেই। কারণ সেই ব্যান্ডেজ বাঁধা শরীরে হাসপাতালের খাটে শুয়ে ঘটনাটিতে রঙ মাখানোর মত কেরামতিওলা মাথা তার নয়। বরং যা ঘটেছিল তাতে নিজেই সে হতভম্ব। তার মুখে শোনা ঘটনাক্রম হচ্ছে এই-  
চা-ঘরের বারান্দায় শুয়ে তার ঘুম এসে গিয়েছিল। ঘুম যখন ভাঙলো, চারদিক তখন শান্ত, স্তব্ধ। মরা জ্যোৎস্নার ফিকে আলোয় দেখা যাচ্ছে ফাঁকা নাটঘর মাথার ভিতরটা মনে হচ্ছিল আলকাতরার মত জমাট আর নিরেট। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকার পর অস্পষ্টভাবে তার মনে পড়েছিল পালার কথা, বন্ধুর সাথে রাগারাগির কথা রাগের ঝাল পুরোপুরি মেটাবার আগেই অন্য বন্ধুরা ওকে সরিয়ে এনেছিল। আটকে  থাকা সেই রাগটা যেন হঠাৎ তার মস্তিষ্কের অলিগলিতে ছড়িয়ে যায়। উঠে দাঁড়ায় সেবাঁশের লাঠিটা, যেটাকে সে কিছুতেই হাতছাড়া করে নি এতক্ষণ, সেটাকে শক্ত হাতে ধরে একবার বেশ জোরে চেঁচিয়ে উঠলো, আয়, কোন শালা আসবি। কোনও প্রতিপক্ষ এগিয়ে না আসায় অকারণেই হাতের লাঠিটা বাঁই বাঁই করে ঘুরালো দু’বার। লাঠিটাকে তার হাতে বড় মাপসই মনে হয়েছিলএরপর সে কুলি-লাইনের দিকে হাঁটা দেয়রাস্তা কিংবা আশপাশ, কিছুই তার চোখে স্পষ্ট ছিল না। ঘটনার বর্ণনা দেবার সময় ভাবতে চেষ্টা করলে কোনও দৃশ্যই তার চোখে পুরোপুরি ফুটে উঠছিল না, অস্পষ্ট ঠেকছিলএসব সে নিজেই স্বীকার করেছিল বলার সময়দু বার বেশ জোরে হুঁচোট খাওয়ার কথাও তার মনে আছেসামলে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করে নিস্তলের ঝর্নাটার কাছে এসে একটু দাঁড়ালো শীতের ঝর্না প্রায় শুকনো হলেও পাথরের ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ কোথাও কোমর জল। দিনের বেলা হলে, আর এমন টালমাটাল অবস্থা না হলে, পাথরে পাথরে পা ফেলে সহজেই পার হওয়া যেত। পথ কমাতে এভাবেই যাওয়া আসা করে সবাই। মাতাল অবস্থায়  বিবেচনা শক্তি ঠিকঠাক কাজ না করায় সোমরা এই শর্টকাটের পথে এসে গিয়েছিল। এখন খেয়াল হয় যে এভাবে পার হওয়ায় ঝুঁকি আছে, তাই আবার অনেকটা উজিয়ে গিয়ে কালভার্টে ওঠে। কালভার্ট পার হলে কিছু ঝোপ ঝাড়, আর তার পরেই সোমরাদের বস্তি, কুলি লাইন
কালভার্টে উঠতে যাবে, ঠিক তখনই সোমরা শুনতে পেয়েছিল, কুলি-লাইনের দিকে একটা সোরগোল উঠেছেহল্লা চিৎকার আর টিন পেটানোর আওয়াজ। এই আওয়াজের মর্ম তার মগজে পুরোপুরি খেলবার আগেই সোমরা কালভার্টের উপর উঠে গেছে, আর তখনি সে দেখতে পায় উলটো দিক থেকে তীর-বেগে ছুটে আসছে কিছু একটা। শেয়াল? না কি অন্য কিছু? সামনে সোমরাকে দেখে সেই কিছু একটা থমকে দাঁড়িয়েছিল। আর তার পরই সোমরার দিকে লাফিয়ে উঠেছিল। সোমরার শুধু মনে আছে হাতের লাঠিখানা ওকে প্রচণ্ড শক্তি যোগাচ্ছিলকুলি-লাইনের দিক থেকে আসা সোরগোলের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সে লাঠিখানা উপরে তুলে প্রাণপণ শক্তিতে একেবারে সামনে এসে পড়া সেই কিছু একটাকে আঘাত করেছিল। জন্তুটা প্রায় তার গায়ের উপরেই এসে পড়েছিল। সোমরার আঘাতটা ছিল মোক্ষমসেই কিছু একটা ছিটকে পড়েছিল রাস্তার উপর। এরপর আবার ছুটে এলে সোমরা কোনও বুদ্ধি বা কৌশলের ধারে কাছে না গিয়ে এলোপাথাড়ি লাঠি চালিয়েছিল। কালভার্টের সংকীর্ণ পরিসরে জন্তুটা বেকায়দায় পড়েছিল খুব। অনেকক্ষণ এভাবে লাঠি চালানোর পর একসময় সোমরা টের পায় তার লাঠি হয় রাস্তার পাথরে পড়ছে, নয় কালভার্টের কাঠের রেলিং-এসে বুঝতে পারে, সামনে এখন আর তার কোনও প্রতিপক্ষ নেইএকটু থেমে দম নিতে গিয়ে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারে না সোমরা। অবসন্নের মত রাস্তার উপর বসে পড়েতারপর শুয়ে পড়ে। তারপর আর কিছুই মনে নেই তার
এই যা যা বলল সোমরা, এর কিছুই হয়তো বানিয়ে বলা নয়যা মনে আছে তাই বলেছেবা ওর যেরকম মনে আছে তাই বলেছেঘটনা যা ঘটল, আর সোমরা ঘটনাটা যেভাবে মনে রাখল, বা স্মৃতি থেকে তার যতখানি উদ্ধার হল, সে সবের মাঝে ফারাক থেকেই যেতে পারে। তাছাড়া মানুষ কখন যে তার চোখে দেখা সত্যের মধ্যে নিজের পছন্দের রঙ মিশিয়ে দেয় সে নিজেও জানে না। এইসব মিশেলের দায় কে নেবে! তখন বাগানে মাঝে মাঝে এমন বাঘ পড়ত কুলি-লাইনের কারো ছাগল গরু টেনে নিত। টের পেলে লোকেরা দল বেঁধে বেরিয়ে টিন বাজিয়ে, চিৎকার করে করে বাঘটাকে তাড়াবার চেষ্টা করত। সেদিনও এরকম তাড়া খেয়ে বাঘটা পালাতে গিয়ে পড়ে যায় মাতাল সোমরার মুখোমুখি। বেচারা বাঘটাকেও ঝর্না পার হবার জন্য ওই কালভার্টের রাস্তাই ধরতে হল। কি করে জানবে, এরকম একটা অদ্ভুতুড়ে সময়ে মাতাল সোমরা লাঠি হাতে ওই কালভার্ট ধরেই আসছে? আর আসছে তো আসছে একেবারে বেহেড মাতাল হয়ে! একটু হুশ বুদ্ধিতে থাকলে না হয় মনে ভয়ডর থাকতো, আর গোটা খেলাটাই তখন হত খেলার নিয়মে। কিন্তু হয়ে গেল বেনিয়মের খেলঅন্ততঃ বাগানের লোকেরা ঘটনাটাকে সেভাবেই নিল।
এমনিতে সারাক্ষণ ঝিম মেরে থাকা চা বাগানের জীবনটা সোমরার বাঘ মারার খবরে যেন হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে নড়ে উঠল। একদল সেই সাতসকালে ট্র্যাক্টরের ট্রেলারে শুইয়ে সোমরাকে প্রথমে হেল্‌থ সেন্টার, পরে ব্লক হাসপাতালে নিয়ে গেল। আরেক দল ছুটলো, সবাইকে খবরটা দিতে। একজনের থেকে অন্যজন হয়ে সারা বাগান জেনে গেল, সোমরা বাঘ মেরেছে। বাগানের মানুষের জীবনে নিয়মের জন্ম মৃত্যুর চেয়ে বড় মাপের ঘটনা সচরাচর ঘটে না। এখন এত বড় মাপের একটা ঘটনার সাক্ষী হতে পেরে মানুষগুলো ভেবে পাচ্ছিল না একে জীবনের কোন কুলুঙ্গিতে রাখবেউৎসাহে টই টম্বুর হয়ে ওরা শুধু একে অন্যকে বলতে লাগল, শুনলি কথাটো? বড়বাবু থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হয়ে খবর পৌঁছলো ম্যানেজার সাহেবের কানে। ম্যানেজার সাহেব নির্দেশ পাঠালেন, বড়বাবু যেন নিজে সামনে দাঁড়িয়ে সুন্দর করে বাঘের চামড়া ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেন, যেন কোনও খুঁত না থাকে। এর বেশী কিছু বলার দরকার ছিল না। বাগানের অফিস সকাল সাতটায় শুরু হয়। বড়বাবু সাতটার মধ্যেই পৌঁছে যান অফিসে। তিনি দায়িত্ব নিয়ে বাঘের চামড়া ছাড়ানোর ব্যবস্থা করলেন। মাথার যে জায়গায় চামড়া থেঁতলে গেছে,  সেই জায়গা সে রকমই থাকল। মাংসের ব্যাপারে মাথা ঘামালেন না। সোমরাদের বস্তির লোকেরা মাংস নিয়ে গেল। চামড়াখানা চলে গেল ম্যানেজারের বাংলোয়।  
এদিকে লোকের মুখে মুখে চারদিকে রটে গেছে রাধানাথপুরের সোমরা ভূমিজের বাঘ মারার কথা। কেউ শুনেছে লাঠি দিয়ে, কেউ শুনেছে খালি হাতেই, কুস্তি করেকুলি লাইনের আরও কেউ কেউ অবশ্য কৃতিত্বের দাবী তুলেছিল। কেউ বলেছিল, ওর ছুঁড়ে মারা পাথরের ঘা খেয়েই বাঘটা মরেছে, কেউ বলেছিল ওর লাঠির আঘাতেই বাঘটার কোমর ভেঙ্গে গিয়েছিল। ভেবে দেখলে এটাও সত্যি যে পেছনে টিন বাজিয়েদের খেদা না থাকলে বাঘটা ঝোপে ঝাড়ে লুকিয়ে পড়ত, এ ভাবে পুলের উপর দিয়ে ছুটতো না। কিন্তু অন্য কোনও দাবী ধোপে টিকলো না। রাধানাথপুরের জীবনে এটা এমনই এক ঘটনা যা আশপাশের দশটা বাগানে কখনও ঘটতে শোনেনি কেউতখন তো এই সবগুলো বাগানই ছিল জঙ্গলের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করেসব বাগানেই দু পাঁচ বছরে এক আধবার বাঘ পড়তে শোনা যেত লোকের ছাগল, গরু টেনে নিতবেশীর ভাগ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের চিৎকার আর টিন পেটানোর আওয়াজে বাঘ পালিয়ে যেতক্বচিৎ কখনও শোনা গেছে অমুক বাগানে বাঘের সন্ত্রাসে বাধ্য হয়ে শহর থেকে শিকারি আনা হয়েছেসেই শিকারি গাছের ওপর মাচান বেঁধে বন্দুক তাক করে বসে থেকেছে সারা রাত। বাঘ মারা পড়লে এলাকা জুড়ে খবর হয়েছে। আর রাধানাথপুরের ভাগ্যে কি না একেবারে মুখোমুখি লাঠি দিয়ে বাঘ মেরে ফেলা, আর তাও কি না আমাদেরই ঘরের ছেলে সোমরার হাতে! এই পুরো অঞ্চলের বাগানী মানুষের চোখে সোমরা হিরো বনে গেলআর রাধানাথপুরের মানুষের কাছে সে হয়ে গেল বাগানের গর্ব। হামদের সোমরা, হামদের বাঘুয়া সোমরা, হামদের বাঘুয়াটো 
মেডেলের কথাটা সোমরার মাথায় ঢোকে হাসপাতালে থাকার সময়। এগারো দিন হাসপাতালে ছিল সেহাসপাতালে ওকে দেখতে আসা বন্ধুদের মুখে শুনেছে বাগানে ওকে নিয়ে তোলপাড় হচ্ছেসোমরা শুনে হাসত, আর মনে মনে বুঝতে চাইত, কেমন হয় সেই তোলপাড়। তবে খ্যাতির স্বাদ সে প্রথম পেল এই হাসপাতালেই। বাঘের সাথে লড়াই করে জিতে আসা একটা ছেলে এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, এমন খবর চাউর হওয়া মাত্র ওকে দেখার জন্য ভিড় জমে গেল। প্রথম দিকে সোমরা একটু গুটিয়েই থাকত। একে তো এটা তার চেনা পরিবেশ নয়। তার ওপর ও যে বাঘ মেরেছে, এই ধারণাটাই ওর  ভেতরে ঠিক শেকড় গাড়তে পারছিল না। ওর কাছে তখনও পুরো ব্যাপারটাই ছিল এক মাতাল মস্তিষ্কের আলো-আঁধারিওকে দেখতে আসা লোকদের নানা প্রশ্নের উত্তরে ও কিছুই বলত না, কেমন একটা বিভ্রান্ত হাসি মুখে ঝুলিয়ে রাখতকিন্তু একটু সুস্থ হবার পর যখন ও সামান্য চলাফেরা করে, বা বেডের উপর বসে থাকে, তখন লোকেরা এসে ওর কাছ থেকে জানতে চাইতো, কীভাবে কী ঘটেছিল। বার বার একই গল্প সবাইকে বলতে হতএবং এভাবেই একসময় বাঘ মারার কৃতিত্বটা ওর মধ্যে গ্যাঁট হয়ে বসে যতটা পারে গুছিয়ে সে লোকদের কথার উত্তর দিতো। শুনে কেউ বলল, তোমার তো ফটো তুলে কাগজে দেওয়া দরকারকেউ বলল, তোমাকে তো মেডেল দেওয়া উচিত। কেউ বলল বাগান থেকে নিশ্চয় অনেক কিছু দেবে তোমাকে? প্রতিটি প্রস্তাবেই তার মনে আশ্চর্য সব প্রত্যাশার বুড়বুড়ি উঠছিলআবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেই প্রত্যাশার বেলুন চুপসেও যাচ্ছিল, যখনই মনে পড়ছিল বাগানের গুঁফো ম্যানেজারের মুখটি। ওই বদরাগী ম্যানেজারটা হাসি হাসি মুখ করে সোমরাকে মেডেল পরিয়ে দিচ্ছে, এই দৃশ্য কল্পনাও করা যায় না। বাঘের মতোই হিংস্র মুখ ওর, বাঘের মতোই খাড়া খাড়া গোঁফ। লালচে রঙের চুলে আর গোঁফে ম্যানেজারটিকে অবাঙ্গালী মনে হলেও আসলে সে বাঙ্গালী, ভটচায। সোমরা তো সাহস করে ওকে কিছু বলতেই পারবে না। লোকদের কথার উত্তরে সোমরা অনিশ্চিত গলায় শুধু বলেছে, জানি না আইজ্ঞা। তবে হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে মেডেলের কথা ভাবতে ভাবতে মেডেলটা তার স্বপ্নে ঢুকে গেল 
বাগানের গাড়িতে করেই হাসপাতাল থেকে ফিরেছিল সোমরা। ফেরার পথে ওর বন্ধুরা গলা ফুলিয়ে চিৎকার দিচ্ছিল। রাস্তার লোকেরা ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিল। শহর ছাড়িয়ে বাগানের পরিবেশে ঢুকে পড়তে ওদের উল্লাসের মাত্রা বেড়ে গেল। যেন ফুটবল ম্যাচ জিতে ফিরছে বা যেন দুর্গাপূজার ভাসান থকে ফেরাওরা শ্লোগান দিচ্ছিল, হামদের সোমরা-জিন্দাবাদ। বাঘুয়া সোমরা-জিন্দাবাদ। পাতা ভর্তি ঝুড়ি পিঠে নিয়ে ফিরতে থাকা কামিনের দল উৎসুক চোখে তাকিয়ে একে অন্যকে বলছিল, কোনটা, হেই কোনটা, এঃ, আমি না-ই দেখলাম রে। অফিসের সামনে ট্র্যাক্টর থেকে নামলে কয়েকজন মিলে সোমরাকে কাঁধে তুলে নিল। সাড়া পেয়ে কাছাকাছি যারা ছিল তারাও এসে জুটল। নতুন একটা তামাশা পেয়ে ওদের মুখে হাসি আর ধরে না। বাচ্চারা চোখ পিটপিট করে একবার সোমরার দিকে তাকাচ্ছে, একবার অন্যদের দিকে, আর যে কোন কথার শেষেই একবার পটাপট হাততালি দিচ্ছে একটা হুলুস্থুলুর পরিবেশ সৃষ্টি হতে দেখে বড়বাবু বেরিয়ে এসে বললেন, এই, তোরা কী শুরু করেছিস এখানে? অফিস ঘরে চেঁচামেচি জুড়েছিস। সাহেবের কানে গেলে কিন্তু অবস্থা খারাপ হয়ে যাবেসবাই একটু দমে যায়। সাহেব মানে সেই গুঁফো ম্যানেজার। বাগানের দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা। তাঁর নামে সকলেরই বুক কাঁপেওরা বোঝে এভাবে অফিস ঘরের সামনে চেঁচামেচি করাটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে নাসোমরা শুধু একবার লাজুক হেসে বড়বাবুকে বলল, আইজ্ঞা, আমারে কিন্তু মেডেল দিবা একটা। আকাশ থেকে পড়া বড়বাবু চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করেন, কী? মেডেল? সমবেত ভিড় যেন এবার একটা নির্দিষ্ট দাবী হাতে পেয়ে মহা উৎসাহে সমস্বরে বলে ওঠে, মেডেল দেওয়া লাগব আইজ্ঞা। আবদারের সুরে বলা। তবে বড়বাবু টের পান এই আবদার নিয়ে এখন প্রশ্ন তুললে ভিড় সরবে না তাড়াতাড়ি। তাই তর্কে না গিয়ে উনি বলেন, ঠিক আছ, ঠিক আছে, পরে দেখবএখন যা, ভাগসমবেত জনতা এই কথাকেই আশ্বাস ভেবে আরেকবার উল্লাসে হৈ হৈ করে উঠল, বাচ্চারা আরেকবার হাততালি দিল। ভিড় এবার মিছিলের মত করে কুলি লাইনের দিকে রওয়ানা হয়কিন্তু সামনে আর কোনও তামাশা নেই অনুমান করে আস্তে আস্তে মিছিলের ল্যাজ ফাঁকা হতে থাকে
কুলি লাইনে পৌঁছে ওরা তখনকার মত যে যার বাড়ি চলে গিয়েছিল। কয়েকজন আবার রাতে একজোট হলবড়বাবুর কথার সুরে ওদের আত্মবিশ্বাস একটু টাল খেয়েছিল। এখন মদ খেয়ে সেই হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনল এবং যে যতটা পারে গলা তুলে মেডেলের দাবীটা নিজেদের মধ্যে ঝালিয়ে নিল। মেডেল জিনিষটা কেউ কেউ সিনেমায় দেখেছে। ঠিক নিশ্চিত নয় জিনিষটা সোনার, না রূপার, না কি টিনের দুর্গা পূজার ঢাকিদের পোশাক থেকেও মেডেল ঝুলতে দেখেছে ওরা। সে সব নিশ্চয়ই তেমন দামী নয়। ওরা সিদ্ধান্তে আসে যে রূপা বা টিনের মত সস্তা মেডেল থাকলেও বাঘ মারার মেডেল সোনারই হবে। যদি মেডেল সোনার হয়, তবে তার দাম কত হবে, কেউ কোনও আন্দাজ করতে পারে না। এরপর কথা উঠল, মেডেলটা সত্যি দেবে তো। বাবুদের কথায় ভরসা কিযদি না দেয়! মা কসম, বাপ কসম বলে ওরা নানা রকম পরিকল্পনা ছকে ফেলল। মেডেল না দিলে বাগানে ইস্ট্রাইক করে দেব। মেডেল না দিলে অফিসঘরের টিনের চালে পাত্থর মারবো মেডেল না দিলে ম্যানেজারের গাড়ির পাম্‌ ছেড়ে দেব। মেডেল না দিলে...
এমনিতে বাঘ মেরে বাগানে সোমরার খাতির বেড়ে গিয়েছিল অনেকবড়রা সবাই তারিফের চোখে তাকাত, পিঠ চাপড়ে দিতএমন কি বাবুরাও এখন ওকে দেখলে বলে, কীরে সোমরা। আগে বলত, এই, কী যেন নাম তোর। এমনিতে বাগানে সোমরা ও তার বন্ধুদের দলের একটা দাদাগিরি আছে। সেখানে ওদের চার পাঁচ জনের মধ্যে কেউ কারো কম নয়। তবে সারা বাগানের সমর্থন পেছনে এসে জুটেছে বলে বন্ধুরাও সোমরাকে একটা বাড়তি গুরুত্ব দিতে আরম্ভ করে। কোনও ব্যাপারে নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা পেলে ফয়সালা সোমরার উপর ছেড়ে দেয়। এভাবে এক অলিখিত নেতৃত্ব এসে গেল সোমরার মধ্যে। বাগানে সবাই ওর মধ্যে একটা বল, ভরসা খোঁজে। সোমরাও তাঁর বন্ধুদের নিয়ে, যতটা পারে সকলের নানা কাজে এগিয়ে যায়। মাঝরাতে অসুখ বিসুখ কি কারো বিয়ে শ্রাদ্ধে খাটা খাটুনি, সোমরাকে সবাই ডাকে। কিন্তু এত সব খাতির, নামডাকের পরেও একটা মেডেলের সাধ সে সযত্নে পুষে রেখেছেহাজার কাজ, হাজার ফুর্তিফার্তা, হল্লোড়বাজির মধ্যেও গোপনে সে একটা মেডেলের স্বপ্নে দিনরাত মশগুল।   
প্রথম প্রথম সোমরা ভাবতো বড়বাবু যখন বলেছেন, ব্যবস্থা কিছু একটা নিশ্চয় হবেতাড়া দেওয়ার কিছু নেইতলবের দিন অফিসে গেলে বড়বাবুর সাথে দেখা হত। সোমরা কান পর্যন্ত হাসি ছড়িয়ে তাকাতো, অপেক্ষা করত বড়বাবুর মুখ থেকে হয়তো মেডেলের খবর বেরোবে কিছু। বড়বাবু কখনও, কি রে, কেমন আছিস জাতীয় ভঙ্গীতে চোখ নাচাতেন শুধু। কখনও ওকে খেয়ালই করতেন না। দু তিন সপ্তাহ এভাবেই কাটে। বড়বাবু কিছুই বলেন না। তখন একদিন ও নিজেই গিয়ে বড়বাবুকে বলে, আইজ্ঞা, আমার মেডেলটা? বড়বাবু কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে জবাব দেবেন, ও, মেডেল? আচ্ছা, হবে যা। আবার  কিছুদিন পরে জিজ্ঞেস করলে বড়বাবু বলেন, আরে হ্যাঁ, তুই তো রাষ্ট্রপতির মেডেল পেয়েছিস, দেখি রাষ্ট্রপতি কবে আসেন। সোমরা ভাল করে না বুঝে বলেছে, আইজ্ঞা আইচ্চা। তারপর অন্যদের মুখে হাসি দেখে বুঝতে পেরেছে এটা মস্করা তারপর নিজেও বোকার মত হেসেছে। এভাবে কয়েকদিন নানা মস্করা সহ্য করে করে একদিন সোমরা দুপুর বেলাতেই মদ গিলে অফিসে এলো। এসে বড়বাবুকে ধরলো, আমার মেডেলটা দেইন আইজ্ঞা বড়বাবু অনেকক্ষণ একদৃষ্টে সোমরার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, তুই মদ খেয়ে এসেছিস, এখন বাড়ি যা। শুনে সোমরা আরও তড়পাতে লাগল। বড়বাবুর কথার একটা যুৎসই জবাব দেবার চেষ্টায় সে বলল, মদ খাইসি তো মদ খাইসি, কেউর বাপর মুত খাইসি নি। এবং এই কথাটি বলে তার মনে হল এটা খুব বিচক্ষণ জবাব হয়েছে। অন্তত তার অঙ্গভঙ্গিতে সেই রকমের আত্মতৃপ্তি দেখা গেলএবার বড়বাবু বিরক্ত হলেন। বললেন, এই, তুই আর আমার কাছে মেডেল মেডেল করিস না তো? কীসের মেডেল রে? জানিস বাঘ মারা বেআইনি? বাঘ মারলে জেল হয়, আর তুই এসেছিস মেডেল চাইতে? যা, সাহেবের কাছে যা। দেবে তোকে মেডেল।
এবার সোমরার চোয়াল ঝুলে গেলবাবু বলে কী? এতদিন দিচ্ছি দিচ্ছি বলে ঝুলিয়ে রেখে এখন উল্টো কথা শোনাচ্ছে। বাঘ এসে তাদের গরু খাবে, ছাগল খাবে, সুযোগ পেলে মানুষও উঠিয়ে নিয়ে যাবে। টিন পিটিয়ে বাঘ তাড়ানো চলবে। আর সেই বাঘ মারলে নাকি মানুষের হবে জেল? ওর মনে হয় এটাও বড়বাবুর মস্করা। তাই সে তার চেহারায় রাগের ভঙ্গী এবং গলায় রাগের সুর বজায় রেখেই জোর দিয়ে বলে, আইজ্ঞা আইচ্চা। তারপর বেরিয়ে এসে কী করবে ভেবে পায় না। মদ খাওয়া অবস্থায় বাবুদের সঙ্গে কথা বললে সোমরাদের ব্যবহারে আটক থাকে না। যে কোনও কথাই একটু বাড়তি জোর দিয়ে বলে মনে তৃপ্তি পায়, যেন খুব যুতমত একটা দামী কথা বলা হয়েছে আর এই করতে গিয়েই বাড়াবাড়ি হয়পরদিন অফিসে ডাক পড়ে। মাটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গালাগাল শুনতে হয়। আবার মদ না খাওয়া অবস্থায় ওদের কেমন যেন কথা বলার সমস্ত কৌশল হারিয়ে যায়যত কিছু বলার থাকে, সব ঠিকঠাক গুছিয়ে এনেও বাবুদের পাল্টা জবাব শুনে সব চিন্তা এলোমেলো হয়ে যায়। বাবুগুলোকে তখন বড় দুর্বোধ্য মনে হয়। তখন বাবুরা যা বলেন, সবই ওরা ‘আইজ্ঞা আইচ্চা’ বলে মেনে নেয়। বলার কথাটা আর ওদের ঠিকঠাক করে কোনও দিনও বলা হয়ে ওঠে না।
 বাড়াবাড়ি করে সেদিন সোমরা বড়বাবুর কাছে মেডেল নিয়ে দরবার করার সুযোগটাই হারিয়ে ফেললতার উপর বড়বাবুর মুখে যে কথা শুনলো, তাতে তার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল, সত্যি কি বাঘ মারলে জেল হয়?
এই রকম সময় একদিন বাগানের মেয়ে লখিয়া আর বুধনী দারুণ একটা খবর আনল। ওরা দুজনে ম্যানেজারের বাংলোয় কাজ করে, ঘর মোছা, সাফ সাফাই-এর কাজওরা একদিন খবর আনলো, সাহেবের বৈঠকখানা ঘরের দেয়ালে একটা বাঘের চামড়া ঝুলছে, যেটা আগে ছিল নাচোখের যায়গায় মার্বলের গুলি বসানো, ঝক ঝক করছে একেবারেমুখটা হাঁ করা, দাঁত খিঁচানো, দেখলে বুক কাঁপে। মনে হয় বুঝি এক্ষুনি ঘ্রা-উ-উ বলে লাফিয়ে পড়বে পিঠে। শুনে সোমরা ভাবে, আমার বাঘটা! বাঘের চামড়াটা ম্যানেজারের ঘরে চলে যাওয়ার খবর কেউ কেউ জানে। কেমন দেখতে বাঘটা? সে তো দেখেও নি ভাল করেকিন্তু বাঘ মারা সত্যি সত্যি বে-আইনি হলে সাহেবের ঘরে বাঘের চামড়া ঝুলছে কি করে? ওর মনে হয়, এবার আর বড়বাবুর সাথে কথা না বলে সোজা সাহেবকেই বলবে। গিয়ে বলবে, এই আমি, আমি সোমরা ভূমিজ, বাঘটা আমিই মেরেছি আইজ্ঞা। বললে সাহেব নিশ্চয় তার জন্য মেডেলের ব্যবস্থা করবে। নিশ্চয় করবে।
কিন্তু সোমরা গিয়ে ম্যানেজারকে মেডেলের কথা বলার সাহস জোগাড় করার আগেই এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল যে আমাদের রাধানাথপুর বাগানের নামটা একেবারে খবরের কাগজে উঠে গেল। কাগজে এই রকম লিখেছিল- রাধানাথপুর বাগানে শ্রমিক অসন্তোষ। ম্যানেজারের হাতে এক শ্রমিক রমণীর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাধানাথপুর বাগানে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। খবরে প্রকাশ, দোষী ম্যানেজারের শাস্তি চেয়ে শ্রমিকেরা ম্যানেজারের বাংলো ঘেরাও করে রেখেছিল উত্তেজিত শ্রমিকরা ম্যানেজারের গাড়ীতে অগ্নি সংযোগ করে এবং পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে বাংলোরও প্রচুর ক্ষতিসাধন করে। পরে বিশাল পুলিশ বাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেবাগানে এখনও টান টান উত্তেজনা বিরাজমান
সবাই সব কথা জানে না। তবে যে মহিলাটি মারা গেল তাকে সবাই চেনে। সে সোমরার পিসি, নাম এতোয়ারী। সেদিন লখিয়ার জায়গায় বদলী খাটতে গিয়েছিল এতোয়ারীকী নিয়ে ঝামেলা হল, ম্যানেজারের বাংলোর নেপালি দারোয়ান কেনই বা এতোয়ারীকে ধাক্কা দিতে দিতে ঘর থেকে বের করে আনছিল, কেনই বা সাহেবকে দেখে এতোয়ারী কথা বলতে গেল, কীইবা বলেছিল যে সাহেব রেগে মেগে রিভলভার খুলে গুলি করে বসলেন, এসবের কিছুই জানার উপায় নেই। সেদিন এতোয়ারীর সঙ্গে কাজে বুধনীও ছিল। তবে দুজন দু জায়গায়বুধনী জানিয়েছে, এতোয়ারীর কাজ ছিল বারান্দায়, ফুলের টবগুলো থেকে আগাছা সাফ করা, বারান্দা মোছা, এই সব। ও নাকি বৈঠকখানায় ঢুকেছিলঢুকলেই বা কী? কাজের জন্য ওরা তো ঢোকে ভেতরে। তাহলে এমন হতে পারে, বুধনী গল্পটা নিজের বুদ্ধিতেই সাজায়, বারান্দায় কাজ করতে করতে কোনও সময় পর্দা সরে গিয়ে এতোয়ারীর চোখে পড়েছে দেয়ালে টাঙানো বাঘছালটা। নিজের ভাইপোর হাতে মারা যাওয়া বাঘটাকে একটু ভালো করে দেখবার লোভে হয়তো এতোয়ারী ঘরে ঢোকে। তারপর সে কি বাঘটাকে হাত দিয়ে ছুঁয়েছিল? কেউ কি মানা করেছিল? জবাবে এতোয়ারী কী বলেছিল? এই সব জানা যায় না। কাগজে খবরটা পড়ে শহরের লোকেরা বলবে, নিশ্চয় চুরি টুরি করেছিল, নইলে একটা ম্যানেজার কি পাগল নাকি যে গুলি করে দেবে? বাগানের বাবুরা বলবে, কী আর বলব। সাহেবটার মাথা গরমকিন্তু তোদেরও তো সমঝে চলা দরকার ছিল। আর বাগানের শ্রমিকরা বলবে, উ ম্যানেজারটো সব পারে। রোদে বসে বন্দুক সাফাই করছিল, রাগ হতে গুলি মেরে দিল।
সারা বাগান যখন এই ঘটনায় উত্তাল, যখন বাচ্চা বুড়ো মেয়ে মরদ সবাই কুলী লাইন থেকে চারাবাড়ি থেকে মেশিন ঘর থেকে নার্সারি থেকে টিলা থেকে মাঠ থেকে কাতার দিয়ে ছুটে যাচ্ছে ম্যানেজারের বাংলোর দিকে, সেই কাতারে সবাই সোমরাকে খুঁজেছিল। সোমরা তো বাগানের একজন বল ভরসা। খবর পেতে দেরী হয়নি ওর। খবরটা শুনে সেও এগোচ্ছিল। তারও মাথা মগজ জ্বলছিল। ম্যানেজারের বাংলোর গেটের সামনে তখন দেড় দুশো শ্রমিকের ভিড়। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজাররা, বাবুরা, এমন কি সর্দারদেরও বয়স্ক কেউ কেউ ভিড় সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছিল। সাহেবের বিশাল আকৃতির কালো আর বাদামীর মিশেল দেওয়া কুকুরটা গেটের বাইরের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করে লাফিয়ে উঠছে আর তার বকলেসে বাঁধা শেকল টেনে কুকুরটাকে সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে নেপালী দারোয়ানসোমরা এগিয়ে গিয়েও দূর থেকে ম্যানেজার আর বাবুদের দেখে কেমন সঙ্কোচে পড়ে যায়। হঠাৎ করে তার চোখের সামনে সরু লাল ফিতেয় লটকানো একটা মেডেল দুলতে থাকে। সোনার মেডেল। রোদে চকচক করছে। আলো ঠিকরে পড়ছে। চোখে ধন্দ লাগে সোমরার। পথভ্রান্ত হয় সে। মেডেলটা যে চিরকালের জন্য অধরা থেকে যাবে! মেডেলটা, সোনার মেডেলটা। এক অদ্ভুত দোটানায় কী করবে ভেবে না পেয়ে সোমরা নিজেকে আড়াল করে ফেলে। তারপর পেছোতে থাকে। লুকিয়ে পড়ে। একসময় তার সঙ্গীরা, বাগানের অন্য লোকেরা ওকে আর দেখতে পায় না। একটা মেডেলের স্বপ্নে সে তার রাজ্যপাট হারিয়ে ফেলে   
মেডেলটা সোমরা পেল নাসেদিন পুলিশ এসে গুঁফো ম্যানেজারকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাবার পর সে আর এই বাগানে ফিরে আসে নি। মেডেলের কথা আর কাউকে বলাই হয় নি। মেডেল পেলেও তার হয়ে তখন হাততালি দেবার কেউ ছিলা না বাগানে। সোমরার বয়স এখন ষাট পেরিয়েছে। সামনের চারটে দাঁত পড়ে গিয়ে তার মুখটা এখন ফোকলা, হাসলে জিভ দেখা যায়। মাথার ঝাঁকড়া চুল পেকে সাদা। মাঝে মাঝে সোমরা কুলি লাইন থেকে বেরিয়ে আসে। কখনও শীতের সকালে চাদরে শরীর পেঁচিয়ে সে রোদে পিঠ দিয়ে দাঁড়ায়। কখনও কালো হাফ প্যান্টের সঙ্গে রংচটা টি শার্ট পরে কোনও শিরিষ গাছের তলায় এসে বসে কখনও গিয়ে বসে নিস্তলের ঝর্নার উপর কোনও পাথরে। প্রকৃতির শোভা দেখতে কেউ কেউ এই ঝর্নার দিকে আসে। সোমরা বসে বসে ওদেরে দেখে। আজকাল কেউ সোমরাকে দেখিয়ে বলে না, এ হল বাঘুয়া সর্দার, আমাদের সোমরা। এই লোকটা বাঘ মেরেছিল। সোমরা নিজেও কথাটা সারাক্ষণ বয়ে বেড়ায় না। কদাচিৎ কোনও বাচ্চা ছেলে বা মেয়ে বাপ কাকার কাছে শুনে ওকে জিজ্ঞেস করে, সোমরা বুড়ো, তুমি নাকি বাঘ মেরেছিলে? শুনলে বড় খুশী হয় সোমরাফোকলা হাসি সারা মুখে ছড়িয়ে উত্তর দেয়, অয়, আইজ্ঞা।  সোমরার বন্ধুদেরও বয়স হয়েছে। রাতে কখনও দুচার জন বন্ধু বান্ধব একসাথে বসে মদ খেলে কেউ কেউ খুঁচিয়ে তোলে মেডেলের কথা। এত করেও মেডেলটা তুই পেলি না সোমরা। সোমরা তখন রাগে তার ঝাঁকড়া চুলওলা মাথাটা ভীষণ ঝাঁকাতে থাকে। তারপর অকারণেই চেঁচিয়ে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বাগানী বাংলায় বলে -লাগে না আমার মেডেল। তারার মেডেলর উপরে আমি মুতি!  
(আমাদের সমকাল, শিলচর, ২০১৪)

No comments:

Post a Comment