ম্লান সন্ধ্যার
কথকতা
-মলয়কান্তি দে
সরুপাথারে আমি কখনও যাই নি। সরুপাথার কোথায়, কি করে সেখানে যেতে হয় জানতাম
না। অতনুর মুখেই শুধু সরুপাথারের গল্প শুনতাম। অতনু সিংহ, আমার কলেজ জীবনের বন্ধু।
কলেজ জীবনের, আর তার পরেরও। অতনু খুব সরুপাথারের গল্প বলত। এক গল্প অনেক বার বলত। বার বার বলত। শুনে শুনে ওই জায়গা আর তার কিছু কিছু মানুষ জনের
সমস্ত খুঁটি নাটি আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এর পরেও যখন আবার সে ওই একই গল্প শুরু করত, আমি ওকে থামাতে পারতাম না।
কারণ সরুপাথারের গল্প বলার সময় অতনুর মুখটা কেমন বাচ্চাদের মত হয়ে যেত, কেমন যেন
উৎসুক, মুগ্ধ আর কেমন যেন টলটলে। চোখে একটা ঘোর নেমে আসত। গলার স্বর পাল্টে যেত। আমি হা করে তাকিয়ে থাকতাম ওর দিকে। ওর এই ঘোর ভাঙাবার চেষ্টা করতাম না। দু একবার ওকে থামাতে চেয়েছি, বলতে চেয়েছি, এ গল্প আর বলতে হবে না, এর দাড়ি
কমা আমার জানা হয়ে গেছে। কিন্তু বলতে পারি
নি। আমার মনে হত আমি কিছু বললেও ও তখন শুনতে পাবে না। আমি
তাই নিরস্ত হয়ে শুনে যেতাম সেই একই গল্প বার বার। পরে, ওর ঘোর ভাঙ্গলে কখনও জিজ্ঞেস
করেছি, এক গল্প বার বার বলিস কেন? ও উত্তর দিয়েছে, লোকে এক গান বারবার গায় কেন? এক
গান বারবার শোনে কেন? অতনু বলত সরুপাথারে ওর মামার বাড়ির কথা, ওর এক পিসতুতো বোনের
শ্বশুরবাড়ির কথা, সেই জামাইবাবুর কথা, একজন কুল-পুরোহিতের কথা। আরও নানা আত্মীয়-অনাত্মীয়
পরিচিতদের কথা। সেই সঙ্গে আরেকজনের কথাও বলত, হঠাৎ কোনও দিন। খুব একটা খুলে বলতো না। টুকরো টুকরো। খাপছাড়া। সেই সব টুকরো জুড়ে দিয়ে আমি কোনও পুরো ছবি পাই নি, কারণ ওই
টুকরো গুলোর মাঝখানে অনেক কুয়াশা থাকত, নেড়ার আগুনের ধোঁয়া থাকত, গাছপালার আড়াল
থাকত। শীতের শান্ত পুকুরের জলে ইট রঙের সর থাকত।
আমি আর অতনু দুজনেই আলাদা আলাদা অফিসে ছোট ছোটো চাকরি করি। সন্ধ্যাবেলা আমরা
দুজনেই আমাদের নিজের নিজের ঘরে ফিরি। হাত মুখ ধুয়ে চা খেয়ে আবার দুজনেই বেরোই। তারপর
আমাদের কোথাও দেখা হয়ে যায়। আমাদের এই ছোট শহরে সকলের সঙ্গেই সকলের দেখা হয়ে যায়। সবাই সবাইকে খুঁজে পায়।
তারপর আমরা একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই কোনও দিন রেল লাইন ধরে অনেক দূর।
কিছুক্ষণ বসি ঘাসের ওপর। সামনে বিস্তৃত ধানক্ষেতের ওপর মরা জ্যোৎস্না কাত হয়ে শুয়ে
থাকে। আমরা গল্প করি
অনেকক্ষণ। তার পরে রেললাইন ধরে ফিরে আসি। আবার কোনও দিন চলে
যাই উদয়নের চায়ের গুমটিতে। একটা পাকা কালভার্টের পাশে ওর
গুমটি। কালভার্টের দু পাশ উঁচু করে বাঁধানো। সেখানে বসা যায়। রাস্তার পাশে অনেকগুলো
কংক্রিটের পাইপ ফেলে রাখা আছে, তার উপরেও বসা যায়। এমন কি ফুটপাতেও বসা যায় কাগজ
পেতে। উদয়নের গুমটির
চালার তলায় দুটো নড়বড়ে কাঠের বেঞ্চি রাখা আছে। আমরা সেখানে বসি না। ওটা ভাল
খদ্দেরদের জন্যে। ভাল বলতে একটু যারা পয়সা-ওলা, ভদ্র গোছের। ওরা আসে, চায়ের সঙ্গে
বিস্কুট খায়। ওদের জন্যে বেশী দামের স্পেশাল চা বানায় উদয়ন। ওরা চা খেয়ে চলে যায়।
বসে না বেশীক্ষণ। আমরা তো বসব ঘণ্টার পর ঘণ্টা, চা খাব একবার কি বড়জোর দু-বার।
আমরা ওই বেঞ্চ দখল করে নিলে উদয়নের ভাল খদ্দেররা আর আসবে না। আর তাছাড়া আমাদের গল্প গুজব আর কেউ কান পেতে শুনুক তা-ও আমরা চাই না। তাই আমরা একটু ফাঁকায় বসি। মশা কামড়ায়। গরমের দিনে কংক্রিট
গরম হয়ে থাকে। আমরা সেসব সহ্য করে নিই। তবে বৃষ্টি বাদলায় উদয়নের খদ্দের কমে গেলে
আমরা গুমটির ডালার নীচে চলে আসি। কাঠের বেঞ্চে বসে গল্প করি। একমাত্র খদ্দের এই
আমরা দুজনের জন্য উদয়ন ওর কয়লার উনুন জ্বালিয়ে রাখে। সে সব দিনে উদয়নও আমদের সঙ্গে
গল্পে যোগ দেয়। আমাদের মত ওর গল্পেও মরা জ্যোৎস্না
কাত হয়ে পড়ে থাকে। বাড়ি ফেরার খুব তাড়া থাকে না ওর। কোনোদিন আমরা রেলস্টেশনে চলে
যাই। ওখানে ওভারব্রিজের রেলিঙে বসে গল্প করা যায়, চা খাবার কোনও বাধ্যবাধকতা থাকে
না। এরকম অনেক জায়গা আছে আমাদের গল্প করার। তবে মাঝে মাঝে
তেমন তেমন দিনে আমরা বাবুলদার চালাঘরে চলে যাই। বাবুলদার বাঁশের চালাঘরটা
রেলওয়ে সাইডিঙের পাশে। চারদিকে মুটে-মজুরদের ভিড় আর রেললাইন আর মালগাড়ী চলার ঘটাংঘট।
লাইনের ওপর সারি সারি রেলের ওয়াগন থাকে। কিছু খালি, কিছু মালবোঝাই। বাবুলদার চালাঘরের সামনের দিকে একটা কয়লার উনুনে চায়ের
কেটলি চাপানো থাকে। কিন্তু উনুনে আঁচ থাকে
না। দিনের বেলা চা বিস্কুট পাউরুটি আর ঘুগনি বেচে বাবুলদা। সন্ধ্যার পর না জেনে
কেউ গিয়ে চা চাইলে বাবুলদা এটা ওটা বলে কাটিয়ে দেয়। কখনও বলে দুধ নেই, কখনও
চিনি-চাপাতা শেষ হয়ে গেছে। আর যারা জানে, তারা সোজা ভেতরে ঢুকে যায়। চেনা খদ্দের
সব। বাবুলদার চালায় অনেক খোপ করা আছে। বাঁশের বেড়ার আড়াল দিয়ে দিয়ে। গলার আওয়াজ বের
না করে ওখানে বাপ-ছেলে একসঙ্গে বসে মদ খেতে পারে। কেউ কাউকে দেখতে পাবে না।
বাবুলদা লোক দেখে দেখে সবাইকে মাপ মত খোপে ঢুকিয়ে দেয়। ভেতরে গিয়ে সবাই চেনা মুখ পেয়ে
যায়।
বাবুলদা আমাদের বন্ধু লোক। কমরেড লোক। একসময় আমরা একসঙ্গে পার্টী করতাম।
বিপ্লবের কথা বলতাম। এখন আমরা পার্টী করি না। বিপ্লবের কথা বলি না। তবু পুরনো
খাতিরে আমরা গেলে বাবুলদা আমাদের আলাদা একটা আড়ালে বসতে দেয়। আমরা সেদিন বসে বসে
মদ খাই। কখনও কখনও আমরা টুকটাক কথাও বলি। কখনও আমরা কেউ কোনও কথা বলি না। চুপচাপ
বসে মদ খাই শুধু। আসলে সেসব দিনে আমাদের খুব মন খারাপ থাকে। আমাদের যে কোনও একজনের
মন খারাপ থাকলে অন্যজনও তখন মন খারাপ করে নিয়ে একে অন্যকে মনখারাপের সঙ্গ দিই।
আমাদের এই প্রত্যেক দিনের গল্পে নতুন কথা কিছুই থাকে না। আমাদের অনেক অনেক
না পাওয়ার গল্প সব বলে যাই একে অপরকে। অনেক অপমানের গল্প। স্কুলের স্যারের কাছে
মার খাওয়ার গল্প, পাড়ার কাকুর কাছে কানমলা খাওয়ার গল্প, ভালবাসার মেয়েদের সামনে
চটি ছিঁড়ে যাবার গল্প। আমাদের পাশের বাড়িতে চুরি হলে পুলিশ এসে আমাকে সন্দেহ করে
নানান প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল, কাঁচা মাটিতে আমাকে লাফাতে বলেছিল আর সেই পায়ের
ছাপের গর্তে গলানো মোম ফেলে আমার পায়ের ছাপ উঠিয়ে নিয়েছিল, তার গল্প। আমার ছোট
বেলার গল্পে জাঁক করার কিছু নেই। মজার কিছু নেই। যা আছে তা-ই বলি। লজ্জার কথা সব। হেরে
যাওয়ার গল্প সব। তবু সেসব বলে বলে আমি খুব হাসি। আমি হাসলে অতনুও হাসে। কেন যে সেসব
গল্পে অতো হাসি পায়, বুঝি না। অতনুর ছোটবেলার গল্প গুলোও অনেকটাই আমার মত। ওর
গল্পেও আমরা দুজনে খুব হাসি। কখনও কখনও বড় হয়ে যাবার পরের গল্পও বলি। যখন ওর সাথে
আমার দেখা হয়ে গিয়েছে, যখন আমরা পরস্পরের বন্ধু হয়ে গিয়েছি, যখন আমাদের গল্পগুলোও
সব এক হয়ে গেছে, তখনকার গল্পও বলি। একজনের গল্পের ফাঁক অন্যজন ধরিয়ে দিই। আর দুজনে মিলে হাসি। এরই মধ্যে হঠাৎ একেকদিন অতনু শুরু করে দেয় ওর সরুপাথারের
গল্প।
কখনও অতনু ওর মামাদের কথা বলে। ওই মামাদের কারও নাকি স্থায়ী কোনও রোজগার
নেই। কে যে কী করে, আর ক’দিন সেটা করে তা অতনুও বলতে পারে না। এক মামার কথা বলে,
যিনি একটা চাকরি পেয়েছিলেন, সরকারী চাকরী। কিন্তু থাকতে হবে প্রায় একশো কিলোমিটার
দূরের অন্য শহরে। মামা এক সপ্তাহ চাকরি করে ফিরে এলো। অতো দূরে নাকি থাকতে পারবে না। সেই মামা
এখন আর কিছুই করে না। যাত্রাপালার পোকা। তা-ই করে বেড়ায়। ওর ছোট মামার না কি খুব চাকরি করার শখ ছিল। সব সময় খালি দুঃখ
করে, জানিস, তিন তিনটে ইন্টারভিউর কল পেলাম। একটা না একটা নির্ঘাত হয়ে যেত। কিন্তু
কল লেটারগুলো এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ইন্টারভিউর তারিখ পেরিয়ে যেত। নইলে আমি পাহাড়
জঙ্গলে গিয়েও চাকরি করতে রাজী ছিলাম। এই রকমই সব। সবাই বিয়ে তা করেছে, সংসার করছে, বাচ্চাকাচ্চা আছে। খেতের চাল
আছে, ভাতের অভাব নেই। ব্যাস।
বারান্দার একপাশে ছিল দিদিমার ঘর। মামাবাড়ি গিয়ে যখনই পৌঁছাক, অতনুর তাড়া
থাকত, কখন দিদিমার ঘরে যাবে। দিদিমার ঘরে গেলে দিদিমা খুব আদর করে ওর গালে-মুখে হাত বুলিয়ে দিত। দিদিমার
আঙুল নাকি ছিল খুব ঠাণ্ডা আর খরখরে। তবু খুব ভাল লাগত ওই হাত বুলিয়ে দেওয়া। একটু
পরে কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে, তাকের ওপর থেকে একটা বড় কাচের বৈয়াম সাবধানে নামিয়ে আনত
দিদিমা। তার থেকে বের করে একটা নারকোলের নাড়ু দিত
অতনুর হাতে। অতনু বলে, এখন তো কতই খাই। সেই ভাল
লাগাটা আর ফিরে পাই না। একেকবার মামাবাড়ি গেলে দশ বারো দিন থাকতাম। নারকোলের নাড়ু কিন্তু
বরাদ্ধ ছিল প্রতিবারে ওই একটাই। পরের বার গেলে তখন আবার একটা।
এক জামাইবাবুর কথা খুব বলে অতনু। ওর পিসতুতো দিদির বর। জামাইবাবুর একটা বেশ
বড় দোকান আছে। উনি রোজ সকালে নিয়ম করে দোকানে যান। দোকানটা আয়তনে বড়, কিন্তু বিক্রির
সামগ্রী তেমন কিছুই নেই, কোনও খদ্দেরও ঢোকে না। সেই খদ্দের-হীন দোকানে একটা কম
পাওয়ারের বাল্ব জ্বালিয়ে ক্যাশবাক্স আগলে বসে সেই জামাইবাবু সারাদিন শুধু আগের
দিনের পেপার পড়েন। সরুপাথারে খবরের কাগজ পৌঁছায় পরের দিন। সবাই সেখানে বাসী খবর
পড়ে। এবং সেই খবর নিয়ে টাটকা আলোচনা করে। যেন
সারা পৃথিবীর জন্য একটা ঘটনা যখন ঘটে গিয়ে খবর হয়েছে, পরে সরুপাথারের জন্য তা
আলাদা করে আবার ঘটে। আর সরুপাথারের
লোকেরা তা নিয়ে তখন আলোচনা করে। যে সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে এতক্ষণে, তারও সমাধান
খুঁজে মাথা ঘামায়।
সেই জামাইবাবু অতনুকে নিয়ে বিকেলে বেড়াতে বেরোত। ওই না-গ্রাম, না-গঞ্জ জায়গায়
এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে সব দেখাত। সব বলতে শুধু ধানের খেত। ফসল কাটা হয়ে গেছে, মাঠে
কেবল নেড়া পড়ে আছে। জামাইবাবু বলত, এখানকার মাটি এত ভাল, ধরো একটু বৃষ্টি হয়েছে,
তুমি পা দিয়ে কাদা ছেনে ধানের বীজ লাগিয়ে দাও, গাছ উপচে ধান ফলবে। এদেশে বুঝলে,
ভাতের অভাব নেই। জামাইবাবু ওকে শোনাত সরুপাথারের একটা চলতি কথা, খার খোয়া অসমীয়া,
মার খোয়া বঙালী আর ধার খোয়া নেপালি। কেন? ধার খোয়া নেপালী কেন? অতনু জিজ্ঞেস করত। জামাইবাবু বলত ওরা খালি টাকা ধার
করে। কেন, টাকা ধার করে কেন? জামাইবাবু উত্তর
দিত, খাইস্লত। বাড়িতে জামাইবাবুর এক কাকু আছেন, উনিই পরিবারের কর্তা। অসুস্থ, তাই ঘরেই শুয়ে থাকেন। সন্ধ্যার সময় শুয়ে থাকতে
নেই বলে উনি এসে বারান্দায় জলচৌকি নিয়ে বসেন কিছুসময়। ওই সময় উঠানের একপাশে তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালানো হয়,
উলুলুলু শব্দ তুলে জোকার দেওয়া হয়। বারান্দায় কুপি জ্বলে কাঠের গাছার উপরে। উঠানের
তিন দিকে তিনটে বাঁশের ঘর, শনে ছাওয়া। সব বারান্দাতেই এরকম কুপি জ্বলে। সেই সব কুপির হলদেটে আলোয় প্রশস্ত উঠানের পুরোটাই দেখা
যায়। তুলসী-তলার প্রদীপ একসময় শীতের হাওয়ায়
নিভে যায়। সেই কাকা অতনুর সঙ্গে কথা বলেন। আর তার
কাশি ওঠে। সেই কাকা বলেছেন, এটা তোমার দিদির বাড়ি, তোমারই বাড়ি মনে করবে। ইচ্ছে
হলেই আসবে। খোঁজ খবর রাখবে। আমি আর ক’দিন। তারপর ঠাণ্ডা লাগছে বলে ঘরে গিয়ে শুয়ে
পড়েন। রাতে যতক্ষণ জাগা থাকে অতনু, কাশির আওয়াজ পায়।
মাঝে মাঝে অতনু তার গল্প শেষ করেও গল্পের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। চুপ করে বসে থাকে। আমি তখন নিজের থেকেই ওকে কিছু একটা মনে
করিয়ে দিই, তোদের সেই কুল-পুরোহিতের কথা বলছিলি না একদিন! সেই যে দেখতে গেলি তোর
ছোট মামার সাথে। ......হ্যাঁ, আমাদের কুল–পুরোহিত। একদিন ছোটমামা বলল, চল একজনের
সঙ্গে দেখা করে আসি। যেতে যেতে বলল, তোদের কুল- পুরোহিত। অশ্বিনী ঠাকুর। চিনিস? অতনুর
মনে পড়ল, ছোট বেলা প্রায়ই আসতেন। তখন পাকিস্তান হয়ে গেছে। অতনুর বাবা এদেশে এসে
কোনও মতে একটা মাথা গোঁজার জায়গা পেয়েছেন। এই পুরুত দাদু তখনও পাকিস্তানে। মাঝে মাঝে অতনুদের
বাড়ি এলে ওর মা রান্নাঘর ভালো করে লেপে, রান্নার আয়োজন সামনে রেখে জড়সড় হয়ে একপাশে
বসে থাকতেন। পুরুত দাদু নিজে রান্না করতেন। অতনু বলে, আমাদের মায়ের রান্না তো ভালোই
ছিল। তবু পুরুত দাদুর নিজে রান্না করা ডাল ভাত আর মিষ্টি কুমড়োর ভাজা খাব বলে আমরা
জিভের জল ঝরিয়ে বসে থাকতাম। অনেক বছর হল দেখি
না। ......... অতনুরা গিয়ে দেখল অনেকগুলো অতি সস্তা, প্রায়
জালি জালি দেখতে গামছা, বিয়ে বা পূজো-আচ্চার অনুষ্ঠানে দানের গামছা হিসেবে যা
পুরুতকে দেয় মানুষ, সেগুলোই একটার সাথে অন্যটা সেলাই করে করে একটা তোষকের খোল তৈরি
করেছেন এক অশীতিপর বৃদ্ধ। সেই খোলের ভেতর নরম নরম খড় সমান করে বিছিয়ে দিয়ে এখন
সেলাই করা হচ্ছে। তোষক তৈরি হবে। অতনুরা কাছাকাছি যেতে মাথা তুলে তাকালেন। অতনু চিনতে পারল পুরুত দাদুকে। মামা জিজ্ঞেস
করলেন, চিনছইন নি ঠাকুরদা, আপনার যজমান। মামার মুখে অতনুর বাবার নাম শুনে কাঁপা কাঁপা দৃষ্টি স্থির করে তাকালেন অতনুর মুখের দিকে। তুবড়ানো, চুপসানো, খুব ফর্সা, প্রায়
লালচে মুখখানায় এবার হাসি ফোটে। চোখদুটোয় নীল এর আভাস। তবে কেমন যেন জল
আটকে থাকা চোখ, যেন চোখদুটো গলে গিয়ে তরল হয়ে আছে। অতনু বলে, দেখে নাকি ওর কেমন কষ্ট হয়েছিল। বলে, আমাদের
মত যজমানদের পুরুতের আর কী সঙ্গতি হবে বল। শীতের হাত থেকে
বাঁচতে সস্তার গামছা দিয়ে খড়ের তোষক বানাচ্ছেন। ওরা ফিরে আসার
সময় পুরুত দাদু মাথা তুলে তাকালেন অতনুর দিকে। বললেন, তোমার বাবারে কইও, ভালা আছি। দেখিয়া
যে গেলায়, বড় আনন্দ পাইলাম। বাঁচিয়া থাকিও। অতনুরা গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে বড় রাস্তায়
পৌঁছতেই সন্ধ্যার অন্ধকার জাঁকিয়ে বসেছিল গ্রামটার ওপর।
অতনুর গল্পগুলো শুনে শুনে আমি চোখের সামনে দেখতে পাই একজন লোক সারা জীবন
শুধু আফসোস করে যাচ্ছে, ইন্টারভিউর কল লেটার দেরী করে এসেছিল বলে। একজন লোক শুধু
অন্য শহরে থাকতে হবে বলে সরকারী চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে যাত্রাপালা করে বেড়ায়।
একজন দোকানদার খদ্দের-হীন, মাল-পত্রহীন দোকানে বসে সারাদিন শুধু বাসী খবরের কাগজ
টাটকা ভেবে পড়ে যায়। একজন বৃদ্ধ পুরুত শীতের হাত থেকে বাঁচতে জালি জালি গামছার
ভেতর খড় পুরে তোষক বানায়। গল্পগুলো আমার কাছে নিতান্ত আটপৌরে মনে হত। আমি ঠিক
বুঝতে পারতাম না এই গল্পগুলোর মধ্যে এমন কী আছে, যে অতনু এগুলো বার বার মনে করতে
চায়? কেন ও নিজেকে হারিয়ে ফেলে এই সব গল্পের মধ্যে। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুই
কি সরুপাথারের কথা মনে করে খুব আনন্দ পাস? ও কেমন আশ্চর্য হয়ে উত্তর দিল, আনন্দ?
আনন্দ পাব কেন? আনন্দের কী আছে। আনন্দ টানন্দ কিছু নেই। তা হলে কেনই বা ওগুলো বার
বার বলিস? আর কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাস? একটু সময় চুপ করে থেকে অতনু বলে,
আসলে কষ্ট পাই। আর সেই জন্যেই বার বার বলি সেই একই গল্প। আসলে কষ্টগুলো হারিয়ে
গেলে বাঁচা বড় কঠিন হয়ে যাবে। আমি ওর কথার মাথামুণ্ডু বুঝি না। তাই এ নিয়ে কথাও
বলি না।
আমার এরকম কোনও গল্প নেই যা থেকে আমি একটু কষ্ট পেতে পারি। যেখানে আমি মাঝে
মাঝে হারিয়ে যেতে পারি। আমার ছোটবেলা কেটেছে এই শহরে। কাছাকাছির মধ্যে আমারও মামাবাড়ি
বা মাসী-পিসির বাড়ি আছে। গেছিও কখনও কখনও। সেই সব বেড়ানোর স্মৃতি সব আমার মনেও পড়ে না। বসে বসে মনে করার চেষ্টাও করি না। মনে
করে করে সে সব বললেও আমি নিশ্চিতই কোনও ঘোরের মধ্যে চলে যাব না। আমার ভেতরে কোনও
ঘোর নেই।
খুব জাঁকিয়ে শীত পড়েছে কদিন ধরে। হাই-নেক সুয়েটার আর টুপীতে নিজেদের সজ্জিত
করে সেদিন বসেছিলাম ওভারব্রিজের রেলিঙে। সামনে দিয়ে নানা লোক যাচ্ছে, আসছে। একটা
পরিবার হেঁটে গেল, স্বামী, স্ত্রী, একটা সাত আট বছরের ছেলে বাবার হাত ধরে, আর
তাদের পেছনে বছর পনেরোর একটি মেয়ে। ফ্রক পরা, চুলে বেণী বাঁধা। যেতে যেতে মেয়েটা
আশ্চর্য হয়ে আমাদের দেখছিল। এই ঠাণ্ডায় দুটো আধবয়সী লোক এভাবে ছোকরাদের মত রেলিঙে
বসে আড্ডা দিচ্ছে, হয়তো ভাবছিল আজব লোক। আমি দেখলাম অতনু সেই চলে যাওয়া মেয়েটার
দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী দেখছিস? অতনু বলল, এই মেয়েটা যদি এখন
ফিরে আসত, আর যদি এখন চারদিকে খুব কুয়াশা থাকত সরুপাথারের ভোরবেলার মত, তাহলে ওর
পেছনে থাকতো একটা পুকুর ঘাট, পুকুরের জলের ওপর ভেসে বেড়াতো দলা দলা কুয়াশা, ওর মুখ
চোখ হয়ে উঠতো ঘুম ভাঙা, ফোলা ফোলা, বালিশের ঘষা লাগা চুল হত সামান্য উসকো খুসকো,
ওর চোখে থাকত সরল কৌতূহল, আর ওর সামনে থাকতাম আমি। ক্লাস টেনে পড়া আমি, কুয়াশার
ভোরে ঘুম থেকে উঠে উঠানে বেরিয়ে এমনি কুয়াশার টানে টানে পুকুরের দিকে এগিয়ে হঠাৎই
আটকে গেছি শাদা ফ্রকের ওপর মেটে রঙের সুয়েটার পরা কালো মেয়েটিকে দেখে, আমার চোখে
অবাক বিস্ময়।
আমি বললাম, প্রায়ই তো বলিস এই একটা মেয়ের কথা। তারপরই বলিস কুয়াশা এসে সব ঢেকে দিল আর কুয়াশা কাটিয়ে এসে
তুই শুধু দেখলি পুকুরের শিশির ভেজা সিঁড়িতে আলাদা করে দেখা যাচ্ছে দুটো ভেজা পায়ের
ছাপ। অতো রাখঢাক করার কী আছে বলতো। খুলে বললেই পারিস। ও কি তোর মামাদের কোনও পড়শি?
আগে দেখিস নি কখনো?
জানি না। কাউকে জিজ্ঞেস করিনি কোনও দিন।
কথা হয় নি কোনও দিন?
হয়েছে। সেবারই। ফিরে আসার আগের দিন, ওর সাথে কথা বলছিলাম ওই পুকুর ঘাটে বসে।
পুকুরের জলে ইট রঙের সর পড়েছিল। ও বসে বসে পুকুরের জলে ঢিল ছুঁড়ছিল আর সেই সর একটু
সরে গিয়ে ঢিলটাকে ডুবে যেতে দিয়ে পর মুহূর্ত্যেই আবার সেই ফাঁক ঢেকে দিচ্ছিল। ঢিলগুলো
পড়ার কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল না। যেই বললাম, কাল আমি চলে যাব, অমনি কেমন
অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর আর একটাও কথা না বলে দৌড়ে
চলে গেল পুকুরের পাড় ধরে উল্টো দিকে। তারপর সেই উঁচু
পাড় থেকে লাফিয়ে নামল নীচের ধানক্ষেতে, তখন কিছুক্ষণ আর ওকে দেখতে
পাচ্ছিলাম না। একটু পরেই আবার দেখলাম বেশ কিছুটা দূরে।
ধানক্ষেতের উপর দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। কারা যেন মাঠের খড়ে আগুন জ্বালিয়েছিল।
সেই ধোঁয়া হঠাৎই বেড়ে গিয়ে চারদিক ঢেকে ফেলে, ওকে আর দেখতে পেলাম না। জানলাম না
কোন বাড়িতে গিয়ে ঢুকল।
এর পরের বার গিয়ে দেখা হয় নি?
এর পরে আমি আর সরুপাথার যাই নি।
অতনুর ছেলের ফিটের রোগ আছে, হঠাৎ করে কেমন গোঁ গোঁ করে অজ্ঞান হয়ে যায়।
ডাক্তার টাক্তার দেখিয়ে কাজ বিশেষ কিছু হয় নি। অফিসের একজন এক কোবরেজের সন্ধান
দিয়েছিল। অতনু একদিন আমাকে নিয়ে সেই কোবরেজকে খুঁজতে বেরোল। পাড়াটা আমি চিনি, যদিও
এদিকে আমার আজকাল বড় একটা আসা হয় না। রাস্তার দুপাশের বাড়িঘর অনেক পাল্টে গেছে,
আসি না বলে খেয়াল করিনি। একটা কালভার্ট পেরোনোর সময় নীচের খালটা দেখিয়ে আমি অতনুকে
বললাম, একটু ডানদিকে এগিয়ে এই খাল নদীতে পড়েছে। ওই জায়গাটা আমার খুব ভাল লাগত,
ছোটবেলা কত গেছি। ওখানে মাছ ধরেছি, সাঁৎরেছি, খালের উপর ঝুঁকে থাকা একটা বটগাছের
নীচে বসে আমি প্রথম বিড়ি খেয়েছিলাম। অতনু খুব উৎসাহ নিয়ে আমার কথা শুনছিল।
কোবরেজের বাড়ি গিয়ে জানা গেল উনি মারা গেছেন ছ মাস আগে। ফিরে আসার সময় অতনুই জোর
করল, চল তোর সেই বিড়ি খাবার জায়গাটা দেখে আসি। সন্ধ্যা হতে তখনও বেশ বাকী আছে। আমি
রাজী হলাম। কিন্তু যত এগোচ্ছি, তত আমি নিরাশ হতে আরম্ভ করেছি। সব কিছু এত বেশী রকম
পাল্টে গেছে, নালাটার দুপাশে পাকা বাড়ি গজিয়ে গেছে, ঠিক চিনতে পারছিলাম না। শেষ
পর্যন্ত নদীটির কাছে গিয়ে দেখলাম সেই বট গাছটা নেই। নালাটা দুদিকে রিটেনশন ওয়ালের
মধ্যে আটকা পড়ে সরু হয়ে গেছে, তার সেই বিস্তারটুকুই হারিয়ে গেছে। একটা পার্ক গজিয়ে
গেছে তার পাশে। জলটাও যেন আগের তুলনায় অনেক নোংরা। আমি
কেমন আশাহত হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। অতনু হঠাৎ একটা অদ্ভুত কথা বলল। বলল, সরুপাথারে হলে এরকম হত না। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। ভেবেছিলাম হাল্কা
রসিকতা করছে, কিন্তু ওর মুখে কোনও রসিকতার দুষ্টুমি মাখানো নেই। মুখখানা এক সরল
প্রত্যয়ে স্থির হয়ে আছে। আমি আবার জিজ্ঞেস করি, কেন? সরুপাথার হলে এরকম হত না কেন?
ও সেই একই প্রত্যয়ের সঙ্গে বলল, সরুপাথারে কিছুই পাল্টায় না। সব একই রকম থাকে। ওর
মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আর কথা না বাড়িয়ে শুধু বললাম, চল, ফিরি।
হঠাৎ করেই আমার একটা সুযোগ এসে গেল সরুপাথার যাবার। আমার অফিসের বড় সাহেবকে
একটা জরুরী কাজে সরুপাথার যেতে হবে। উনি চাইলেন আমিও সঙ্গে যাই। ওখানে কিছু কিছু
টাইপের কাজ করতে হবে যা উনি আমাকে দিয়েই করাতে চান। টাকা পয়সা সংক্রান্ত কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে ওখানে, সাহেব সেটার তদন্ত করতে যাবেন। সঙ্গে বিশ্বাসী লোক দরকার। সেদিন বিকেলে অতনুর
সাথে দেখা হতে আমি ওকে চমকে দেবার মত করে খবরটা দিলাম। ভাবলাম অতনু উচ্ছ্বসিত হয়ে
আমাকে বলবে ওর মামাদের সাথে দেখা করতে, পারলে সকলের একটু খোঁজ করে আসতে। কিন্তু ও
বিশেষ উৎসাহ দেখাল না। শুধু বলল, সরুপাথার কি চাইলেই যাওয়া যায়? আমি তো সেই ক্লাস
টেন-এর পর আর যেতেই পারলাম না। দেখ যদি যেতে পারিস। এটুকু মাত্র বলেই ও প্রসঙ্গ
পাল্টালো। আমি খুব আশ্চর্য হলাম।
অফিসের নির্দেশ মত আমি আগেই ট্রেনে করে চলে যাই যোরহাট। আমার বড় সাহেব
সেখানে গিয়ে পৌঁছলে আমি গিয়ে হোটেলে দেখা করি। তারপর ঠিক হয় পরদিন যোরহাট অফিসের
আরেক সাহেবকে নিয়ে আমার বড় সাহেব রওয়ানা হবেন সরুপাথার। আমি ওদের সঙ্গে একই গাড়িতে
যাব।
একটা জায়গায় বড় রাস্তা ছেড়ে আমাদের গাড়িটা পাশের একটা ছোট রাস্তায় ঢুকে
পড়ল। এটাই নাকি সরুপাথার যাবার রাস্তা। গাড়িতে বসে দুই সাহেব নানা কথা বলছিলাম।
আমি বাইরের মাঠ ঘাট গাছ পালা দেখতে দেখতে কান পেতে ওদের কথা শুনছিলাম। যোরহাটের
সাহেব আমার সাহেবকে বলছিলেন, আপনি আগে কখনও গেছেন সরুপাথার? আমার সাহেব বললেন, না।
এদিকে আমার পোস্টিং হয়নি কখনও। যোরহাটের সাহেব বললেন, এই সরুপাথার জায়গাটায় গেলে
আমার কেমন মনে হয় গোটা গ্লোবেলাইজেশন ব্যাপারটা যেন এই সরুপাথারকে বাইপাস করে চলে
গেছে। সারা পৃথিবী বদলে গেলেও সরুপাথার বদলায়নি এতটুকু।
আমার সাহেব জিজ্ঞেস করেন, আপনি বুঝি অনেকবার গেছেন সরুপাথারে? গেছি মানে? ছোটবেলা
তো অনেকবার এসেছি। আমার মামার বাড়ি আছে এখানে। আজকাল আর আসা হয় না। বিশ্বাস করবেন,
আমার এক মামার এত সখ ছিল চাকরি করার। তিন তিনটে চাকরির ইন্টারভিউ দেবার জন্য কল
লেটার পেয়েছিল। কিন্তু সবগুলোই হাতে পেল ইন্টারভিউর তারিখ পেরিয়ে যাবার পর।
এ কথা শুনে আমি চমকে উঠি। আমার একবার ইচ্ছে করে পিছন ফিরে দেখি অতনুই
যোরহাট অফিসের সাহেব সেজে আমার পিছনে বসে আছে কি না। কিন্তু না, এটা তো হতে পারে
না। তা ছাড়া গলার স্বরটাই আলাদা। এই সাহেবের গলার আওয়াজ সাহেবদেরই মত। আমার বা অতনুর মত কেরানী-মার্কা নয়। আমার কেমন তালগোল
পাকিয়ে গেল। আবারও ওদের কথায় কান পাতলাম। এবার সেই সাহেব বলছেন, আমার দিদিমা একটা
নারকোলের নাড়ু হাতে ধরিয়ে দিতেন। এমন নাড়ু তো কতই খাই। কিন্তু সেই স্বাদ আর পাই
না। আমার কান মাথা ভন ভন করছিল। আমি জানি এর পরে আসবে এক কুল-পুরোহিতের কথা, যে
শীতের হাত থেকে বাঁচতে জালি জালি গামছা সেলাই করে ভেতরে খড় পুরে তোষক বানায়। আসবে
সেই দোকানদারের কথা যে খদ্দের-হীন এক দোকানে সারাদিন বসে বসে শুধু বাসী খবরের কাগজ
পড়ে। একদল নেপালি মানুষ শুধু টাকা ধার করে যায়, যেহেতু এটা ওদের খাইস্লত। একজন
বৃদ্ধ লোক সারা রাত কাশতে থাকেন। আর একটা শাদা রঙের
ফ্রক আর মেটে রঙের সুয়েটার পরা মেয়ে, কিংবা সেই কুয়াশা কিংবা গাছপালা কিংবা
নেড়ার আগুনের ধোঁয়া কিংবা পুকুরের জলের ওপর সর পড়ে থাকার কথা বলতেও পারেন, না-ও
বলতে পারেন। তাতে অবশ্য আমার কিছুই যায় আসে না। আমি এবার ওদের কথায় কান না দিয়ে
চোখ ভরে বাইরের দৃশ্যাবলী দেখে যাই। আমি জানি গ্লোবেলাইজেশন এ পথে আসে নি। ওই বড়
রাস্তা দিয়ে চলে গেছে অন্য শহরে। তাই এই দৃশ্যাবলী পাল্টায় নি বছরের পর বছর।
আমাদের গাড়িটা সেদিন আর সরুপাথার যেতে পারল না, কারণ একটা পুল ভেঙ্গে গেছে।
কবে ঠিক হবে কেউ জানে না। লোকজন পুলের তলা দিয়ে জল কাদা ভেঙ্গে পারাপার হচ্ছে,
যাদের দরকার। বাকীরা বসে বসে অপেক্ষা করছে কবে পুল ঠিক হয়।
দুই সাহেব মিলে ঠিক করলেন, ফিরে যাওয়াই ভাল। পরে রাস্তার খবর নিয়ে আবার আসা
যাবে। আমিও আবার যোরহাট থেকে ট্রেন ধরে ফিরে এলাম।
সেদিন বাড়ী পৌঁছতে অফিসের টাইম পেরিয়ে গিয়েছিল বলে আমি দুপুরটা বাড়িতেই
কাটালাম। খাওয়া দাওয়ার পর একবার উঠে পুরোন বাক্স প্যাঁটরা হাতড়ে আমার সব পুরোন স্মৃতিগুলোকে
এক জায়গায় জড়ো করার চেষ্টা করলাম। দেখলাম, খুব স্পষ্ট না হলেও এখনও খুঁজে পাওয়া
যাচ্ছে একজন দিদিমার খরখরে ঠাণ্ডা আঙুলের স্পর্শ, নারকোলের নাড়ু, এক কুল-পুরোহিতের
গামছা সেলাই করে খড়ের তোষক বানানোর দৃশ্য, ইত্যাদি। সবই প্রায় আছে, হয়তো একটু আধটু
মলিন হয়ে আছে, তবু আছে তো। আমি সব যত্ন করে আলাদা করে রাখি। একবার এগুলোকে
সরুপাথার পৌঁছে দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত। ওখানে পৌঁছে দিতে পারলে কিছুই আর বদলাবে
না।
সেদিনই প্রথম আমি সরুপাথারের কথা ভাবতে ভাবতে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে
যাই। আর আমার বেশ একটা কষ্ট হতে থাকে।
________________________________________________