Thursday 14 January 2016

বাসি ফুল



বাসি ফুল
- মলয়কান্তি দে
গন্ধরাজ ঘুম থেকে উঠেছিল, রোজ যেমন ওঠে, কাক-ডাকা ভোরে। ওই সময় আকাশে আলো তেমন ফোটে না। কেবল ঘরবাড়ি, গাছপালা, মাঠ, পুকুর ইত্যাদি চাপড়া চাপড়া ঠাহর করা যায়। কিন্তু আজ ক’দিন ধরে আকাশের চেহারা অন্যরকম। মোষের মত কালো রঙের মেঘে সারাক্ষণ ছেয়ে আছে আকাশ। দিনরাত শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি। বৃষ্টি পড়ে পড়ে পচিয়ে দিচ্ছে চারদিক। বাঁশের দরজা সরিয়ে গন্ধরাজ বাইরে এল। আকাশ আজও মেঘে ঢাকা। বৃষ্টি পড়ছে, তবে একটু  ঝিমিয়ে। তেজ কমেছে যেন। বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় নিয়ে উঠানে নামল সে, তারপর চলে গেল বাঁশঝাড়ের দিকটায়। ফিরে এসে চোখে মুখে জল দিল। গামছা দিয়ে গা-মাথা মুছে নিল। ভেজা হাওয়ায় একটা ঠাণ্ডা শিরশিরানি লাগছে গায়ে। ঘরে ঢুকে এক টুকরো থান কাপড় গায়ে জড়িয়ে আবার বারান্দায় এল। বারান্দা বলতে মাত্র দেড় হাত বাড়তি ভিটে। খড়ের চালাটাও সেই হিসেবে বাড়ানো। একটু সময় দাঁড়িয়ে থেকে কী করবে ভেবে না পেয়ে গন্ধরাজ পিড়ি পেতে বারান্দায় বসল। রোজ যেরকম বসে। ঠাণ্ডা লাগছে, তাই একটু কুচিমুচি লেগে বসেছে গন্ধরাজ। এই মুহূর্ত্যে কিছু করার নেই তার।  
বৃষ্টি বাদলা না হলে এই সময় গন্ধরাজ পায়ে পায়ে সারা বাড়ির আনাচ কানাচ হেঁটে বেড়ায়। ঘুরে  ঘুরে দেখে, কোথায় আমগাছের একটা ডাল নুয়ে আছে, পুকুরে যেতে আসতে মাথায় লাগছে, কাটতে হবে। ঘাটার খুঁটিগুলো নাড়া দিয়ে দেখে, একটার বোধ হয় গুড়ি পচে গেছে, পাল্টাতে হবে। জবা গাছের একটা ডাল হয়তো কোনও কারণে মাজা ভেঙ্গে কাত হয়ে আছে, তুলে ধরে বাঁশের কঞ্চির ঠেকা লাগিয়ে সোজা করে দেয়। মাঝে মাঝে বাড়ির বাইরেও বেরোয়। মাটির রাস্তা ধরে এমনি এদিক ওদিক হাঁটে। কখনও কোথাও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চারপাশ খুব মন দিয়ে নিরীক্ষণ করে। ধানের চারার বাড় থেকে নালার জলের স্রোত, পুকুরে মাছের ঘাই থেকে কারো ঘরের চালে চালকুমড়ো, যা কিছু চোখে পড়ে তার সবই অনেক সময় লাগিয়ে দেখে। তার এই দেখার মধ্যে একটা প্রশান্ত, নির্লিপ্ত ভঙ্গী আছে। তার এই মুখ জোড়া প্রশান্তির সঙ্গে তার ঈষৎ ছড়ানো, এবং একটু ফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁট দুটো এমন এক সঙ্গতি তৈরি করেছে, যার জন্য ওকে সব সময়ই মনে হয় যেন হাসছে। যেন তার ভেতরটা সব সময় ভরা পুকুরের মত টই টম্বুর। জাগতিক কোনও আনন্দের ব্যাপার যখন ঘটে, তখন সেই পুকুরে রোদ পড়ে। আর যখন কোনও দুঃখ বেদনার কিছু ঘটে, তখন সেখানে ছায়া পড়ে, মেঘের ছায়া। পাঁচ বছর আগে যেদিন তার বউ শৈলবালা মারা গেল,  দাহকার্য শেষ করে এসে এই একলা ঘরখানার বারান্দায় বসে ছিল গন্ধরাজ। সেদিনও তার ঠোঁট-দুটো একই রকম, একটু ফাঁক আর দু পাশে একটু ছড়ানো ছিল। তার সেদিনকার মুখভঙ্গিকেও হাসি হাসি মনে হতে পারে, তবে তা ছিল কেমন অন্যমনস্ক। এ ছাড়া অন্য সব সময়ই সে হাস্যমুখ, আনন্দিত।   
এই কাকভোরেও, কখনও কারও সাথে তার দেখা হয়ে যায়। বরদাকান্ত কিম্বা অধীর কিম্বা অন্য কেউ। তারা কথা বলে, ভালা আছ নি বা, কাকা। গন্ধরাজ তার হাসি মাখানো মুখে উত্তর দেয়, অয়, আছি। টাউনো গেসলায় নি এর মাঝে। না-বা। কিতা করতাম গিয়া। আইজ কাইল আর শরীরে দেয় না। যদি কেউ মন খারাপের কথা কিছু বলে, যেমন, -পুয়া ইগুরে আর বাচাইতাম পারতাম নায় বা। কুন্তা খায় না, খালি বিছ্‌নাত পড়ি থাকে..., তখনও গন্ধরাজের মুখের ভঙ্গী একই থাকে, শুধু হাসিটা মনে হয় যেন বর্ষা-দিনের রোদের মত ঝপ করে মরে গেল। গন্ধরাজের মুখের একটাই অভিব্যক্তি। একটা জীবন কাটাতে এর বেশী অভিব্যক্তির তার দরকার হয় নি।
ভোরবেলার এই সব দেখাদেখি আর এই কদাচিৎ আলাপচারিতার মধ্যেই এক সময় চারদিক ফর্সা হয়। তখন ঘরে ফিরে আসে গন্ধরাজ। এসে তার চালাঘরের বারান্দায় পিঁড়ি পেতে বসে থাকে। বৃষ্টি না থাকলে, সে জানে, একটু পরেই বাঁশঝাড়ের মাথায় সকালের করমচা রঙের রোদ এসে পড়বে।  
গন্ধরাজের বয়স হয়েছে। দু বছর আগে হলে এই ভোরবেলাই গন্ধরাজ বাড়ির নানান কাজে ব্যস্ত হয়ে যেত। কোথায় ঘরের একটা খুঁটি পাল্টাতে হবে, কোথায় ভিটেতে আগাছা জন্মে গেছে, সাফ করতে হবে, জল নেমে গেছে বলে পুকুরের ধাপটা একটু নামিয়ে বাঁধতে হবে, এই সব কাজে সকালটা কাটিয়ে, স্নান করে, পেট পুরে পান্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়ত সাড়ে আটটার ট্রেনের উদ্দেশ্যে। ট্রেন ধরতে পারলে ভাল। মামার গাড়ি। বিনা পয়সায় পৌঁছে দেবে শহরে। তা নইলে বাস। বাসের কন্ডাক্টর মোটেও রেয়াত করে না। পুরো ভাড়া উসুল করে। গাঁটের পয়সা গচ্চা যায়। তারপর শহরে পৌঁছে হয়তো কোথাও কাজ ধরা আছে, গামছা পরে কাজে লেগে যাওয়া। আর নইলে দা হাতে এ-বাড়ি ও-বাড়ি কাজের খোঁজ করা। কাজ ধরা থাকলে দা-খানা রেখে আসতে হয় গৃহস্থের বাড়ি, জামিন হিসেবে। যাতে পরের দিন এক গৃহস্থকে লটকে রেখে অন্য গৃহস্থের কাজে লেগে যেতে না পারে। আর কাজ ধরা না থাকলে তখন হাতে থাকে গামছা পেঁচানো দা। যে কয়েকটা বাঁধা ঘর ছিল, সেই কবে থেকে যাদের ঘর সারানোর কাজ করে আসছে গন্ধরাজ, তারা সবাই একে একে ইট কাঠের দালান বানিয়ে ফেলেছে। ইসপল্টুর টিন লাগিয়েছে। গন্ধরাজের কাজ কমে গেছে। এখন কেবল কারও বাড়ির সীমানার বেড়া সারানো, শিম বা লাউ গাছের মাচা বানানো, - এই সব ছোট ছোট কাজ টিকে আছে। আজকাল আর শরীর দিয়ে পারে না গন্ধরাজ। তার বয়স হয়েছে। ঠিক কত বয়স হয়েছে সে জানে না। শুধু টের পায়, আজকাল বেশীক্ষণ রোদে কাজ করলে মাথা ঘোরে। তাই আস্তে আস্তে ঘর-বন্দি হয়ে গেছে সে। তার ছেলে বাপের রাস্তা ধরে নি। সে রিকসা চালায়। রিকসা চালানোতে তনাই থাকলে রোজগার আছে। গন্ধরাজের তনাই পড়ে গেছে। তা ছাড়া, তার রোজগারের রাস্তায় তনাই থাকলেও কাজ নেই। বাতিল মানুষের মত সে এখন বাড়িতে বসে থাকে। বাড়ির কাজকর্ম করে, হাত-দা খানা যত্ন করে ধার দেয়। শরীরটাকে খাটিয়ে চালু রাখে। বাকী সময় বারান্দায় পিড়ি পেতে বসে চারদিকে তাকায় শুধু। উঠানে চড়ুই নামলেও তাকায়, ঘরের চালে কাক বসলেও তাকায়, কোনও বাড়ির ছাগল এসে ঘাটার আগল ঠেলছে দেখলেও তাকায়। ওর হাসি হাসি মুখটা দেখলে তখন মনে হবে ও যেন খুব আমোদ পাচ্ছে এ সব দেখে।
কিন্তু এই ক’দিন ধরে এত বৃষ্টি পড়ছে, গন্ধরাজের নড়া চড়া বন্ধ। হাত পা ডাট্টা হয়ে যাচ্ছে। দা খানাতে জংকার না পড়ে যায়। বৃষ্টি মাথায় করে কাজে নামার বয়স আর তার নেই। তাই এই বৃষ্টির সকালে গন্ধরাজের কাজ শুধু বসে থাকা। বসে থাকতে থাকতে এক সময় পূবের ভিটার বাঁশের দরজায় ক্যাঁচকোঁচ শব্দ উঠতে গন্ধরাজ সেদিকে তাকাল। আরতি দরজা খুলে বেরিয়েছে। গন্ধরাজের পুত্রবধূ। গন্ধরাজকে দেখে গায়ের কাপড়টা একটু টেনে দিল। ঘোমটাও টানার চেষ্টা করল, খাটো কাপড়ে সেই চেষ্টা ফলবতী হল না। হাল্কা বৃষ্টির পরোয়া না করে বউ চলে গেল বাড়ির পিছন দিকে, সুপুরি গাছের শুকনো ছই দিয়ে বানানো আড়ালের আড়ালে। নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে বউটির থেকে চোখ সরালো গন্ধরাজ। একটু পরে বউ ফিরে এল। এবার গন্ধরাজের বসে থাকার মধ্যে একটা অপেক্ষা এসে যোগ হয়। একটা সরল, শান্ত, নিশ্চিত প্রাপ্তির অপেক্ষা। একটু পরেই দেখা গেল আরতি গ্লাসে করে চা নিয়ে আসছে। বৃষ্টির উঠান পার হয়ে আরতি, বাবা, চা নেইন, -বলে চায়ের গ্লাস এগিয়ে দিলে গন্ধরাজ আগ্রহের সঙ্গে দু-হাত বাড়িয়ে তা নিল। সঙ্গে এনামেলের বাটিতে অল্প মুড়ি। ঠাণ্ডার মধ্যে এই নুন দেওয়া ফিকা চা বড় তৃপ্তি দেয়। তারিয়ে তারিয়ে চা-টা খেল গন্ধরাজ। আরও কিছু পরে ছেলে অনন্ত বেরোল। এখন বৃষ্টি মাথায় করে শহরে যাবে। বিধান মজুমদারের কাছ থেকে ভাড়ার রিক্সাখানা নিয়ে ট্রিপ মারতে লেগে যাবে। বৃষ্টি বাদলায় সওয়ারি কম হয়, কিন্তু আমদানি ভাল। দেরি করার সময় নেই তার। আরও পরে, ঘুমের চোখ কচলাতে কচলাতে ঘর থেকে বেরোল উদোম ন্যাংটা, আরতির চার বছরের ছেলে, গন্ধরাজের নাতি, বাদল। মুখে ঘুম ভাঙ্গার বিরক্তি। গন্ধরাজ একটু জোরে চেঁচিয়ে বলল, কিতা বা লেংটা গদা। উঠি গেলায় নি। আজকের দিনের এটা তার প্রথম শব্দোচ্চারণ। নাতি একবার ঘাড় ঘুরিয়ে গন্ধরাজকে দেখল রাগ রাগ মুখ করে। তারপর যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকেই পেচ্ছাপের একটা সরু ধারা ছুঁড়ে দিল উঠানে। সেদিকে তাকিয়ে গন্ধরাজের মুখের হাসিটি প্রাণ পায়, যদিও সে আলাদা করে হাসে নি। নাতি গিয়ে ঘরে ঢুকল। এখন প্রত্যেকটি ব্যাপারেই একপ্রস্ত ঘ্যান ঘ্যান করবে। মা ওর পিঠে কিল বসাবে দু একটা। চেঁচিয়ে কাঁদবে তারপর। অর্থাৎ, শুরু হয়ে গেছে আরেকটা হাসি কান্নার দিন।  
বৃষ্টি একটু ধরেছে। যদিও খড়ের চালা থেকে মাঝে মাঝে টুপটাপ জলের ফোঁটা পড়ছে ছাচের পোতায়। উৎসুক চোখ তুলে আকাশ দেখল গন্ধরাজ, ছাই রঙ হালকা হচ্ছে ক্রমশ:, ধীরে ধীরে ফরসা হচ্ছে আকাশ। ঠাকুর যদি আজ একটু দিন দেয়। মনে মনে ভাবল গন্ধরাজ। রোদ না পেয়ে উঠানের এখানে ওখানে শ্যাওলার সর পড়ে গেছে। অসাবধানে পা পড়লেই হড়কাবে। গন্ধরাজ এবার ওঠে। গায়ের কাপড় খুলে রেখে গামছা খানা পরে নেয়। ঘরের বেড়ার খাপে ঢোকানো হাত-দা খানা টেনে বের করে উঠানে নেমে পড়ে। সারা বাড়িতে যেখানে যা খুচ খাচ কাজ চোখে পড়ে, একে একে সারতে থাকে। কোদাল এনে মাটি চেঁচে শ্যাওলা সরায়। বাঁশ ঝাড় থেকে একটা পোক্ত বাঁশ বেছে নিয়ে সেটা কেটে এনে উঠানে শুইয়ে রাখে, ঘরের খুঁটি বানাবে। আমগাছে পিঁপড়ের ঢোল হয়েছে একটা। কেটে দেয়। এই রকম করতে করতে এক সময় একটু রোদ ঝিলিক দিয়ে উঠল আকাশে। মনটা ভাল লাগল গন্ধরাজের। পুকুরে গিয়ে হাত পা পরিষ্কার করে স্নান করে নিল। ফিরে এসে খাটো ধুতিটা পরতে পরতে আরতিকে ডাকল, - কই গেলে গো মাই।
ঘর থেকে ত্রস্তপায়ে বেরিয়ে এল আরতি।
- ডাকিতরা নি বাবা?
- অয়। কুন্তা খাইবার দে। আমি টাউনো যাইতাম।
- টাউনো গিয়া কিতা করতা? শরীল ভালা নায়। আরতির গলায় উদ্বেগ।
- কত দিন গেছি না বেটি। ভাল্লাগের না। দিন দিছে তে একবারতা যাই। ওউ যাইমু আর আইমু।
- তে ভাত এক দলা মুখো দিয়া যাইন।
ভাত খেয়ে গন্ধরাজ একটা রংচটা সিনথেটিক হাফ শার্ট গায়ে দেয়। টায়ারের চপ্পল জোড়া বের করে ধুলো ঝেড়ে তাতে পা গলায়। তারপর বড় রাস্তা অবধি হেঁটে এসে বাসের জন্য অপেক্ষা করে।
*        *        *
          কপালে ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুমের লাগ কাটল আশালতার। চোখ না খুলেও টের পেলেন, কয়েকটি সরু সরু আঙ্গুল তার কপাল ছুঁয়ে আছে। ভাল লাগছিল আশালতার। কয়েকটা বাড়তি সেকেন্ড এই ভাল লাগাকে ধরে রেখে তারপর চোখ খুললেন। ঝাপসা চোখে একটুক্ষণ তাকিয়ে বুঝলেন, বিছানার পাশে তার বউমা এসে দাঁড়িয়েছে। শরীর কি রকম গো আইজ? কথাটা বুঝতে একটু সময় নিলেন আশালতা, তারপর মাথা নাড়লেন। ভাল। ভাল লাগছে তার। এই যে চোখ খুলে তাকিয়েছেন, চোখ ভারী হয়ে বন্ধ হয়ে আসছে না। শরীরে তেমন জ্বালা-পোড়া নেই। কেমন যেন সব কিছু ভাল লাগতে ইচ্ছে করছে। এই কয়েকটা দিন বড় খারাপ লাগছিল সবকিছু। এক নাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছিল।  ঘরের ভেতর চাপ চাপ অন্ধকার জমে থাকত। সেই অন্ধকারে কারা আসছে, কারা যাচ্ছে ঠিক বুঝতে পারতেন না। মনে হত অচেনা মানুষজন এসে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। তারা কি সব বলাবলি করছে, কিছুই বুঝতে পারছেন না উনি। দিন না রাত, তা-ও বোঝা যেত না। কেমন যেন ভয় করত আশালতার। ভয়ে কাঁটা কাঁটা হয়ে থাকতেন। মাঝে মাঝে খাবার ভেবে হাঁ করলে মুখে পড়ত তেতো ওষুধ। খাবারের গ্রাস মুখে নিলে গিলতে পারতেন না। ঘুমে ঢলে পড়তেন। আসলে ঘুম নয়, একটা আচ্ছন্নতা। আজ চারদিক তাকিয়ে দেখলেন আশালতা, ঘর খানা বেশ আলো আলো। চেনা আসবাবগুলো চোখে পড়ছে। এই যে সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার পুত্রবধূ, যার নাম প্রায়ই ভুলে যান তিনি, এখন ঠিক মনে পড়ছে ওর নাম সুনন্দা, ওকেও দেখতে বড় ভাল লাগছে। সুনন্দা বলল, জ্বরতো কমছে মনে অয়। প্রণতি আউক, কইমু আইজ একটু গা মুছাইয়া দিত আপনারে। ই কয়দিন তো গা মুছানি অইছে না। ভালা লাগব। বাধ্য শিশুর মত ঘাড় কাত করলেন আশালতা।
আজ রোদ উঠেছে। আশালতার পায়ের দিকে একটা কাঠের পাল্লার জানালা আছে। সকালে খুলে দেওয়া হয় আর বিকেলে, সন্ধ্যা নামার আগেই টেনে বন্ধ করা হয়। নইলে মশা ঢোকে। বৃষ্টি পড়লে দিনেও পাল্লা টেনে দেওয়া হয়, নইলে বৃষ্টির ছাট ঢোকে। একটা পাতলা সুতি কাপড়ের টুকরো পর্দা হয়ে আহ্লাদে দোল খায় সেই জানালায়। কাপড়টা মাঝে মাঝে হাওয়ায় সরে যায়। বেশী হাওয়ায় কখনও পেঁচিয়ে যায় জানালার শিকের সাথে। কারো চোখে পড়লে প্যাঁচ খুলে দেয়। এই অকুলীন পর্দাটি মাঝে মাঝে সরে গিয়ে যতখানি ফোকর তৈরি করে, ঠিক সেই মাপের পৃথিবী উঁকি দেয় আশালতার ঘরে। ঘরের অন্য জানালাটির সামনে অনেক বাক্স প্যাটরা রাখা, তাই সেটা খোলা হয় না। জানালা দুটির ওপাশে অন্য লোকের বাড়ি। সে বাড়িতে নানা বয়সের অনেক মানুষ। সেই বাড়ি থেকে বাচ্চাদের ঝগড়া, কারও কান্না, কারও শাসানি, একটু বড় হওয়া কারও মুখে এক-আধটা চালু হিন্দি গানের কলি, বড়দের ভারী গলায় সংসারী কথাবার্তা - ইত্যাদি এসে আশালতার ঘরে ঢোকে। এই সব শব্দে আশালতা সঙ্গ-সুখ পান। একটা চলমান জীবনে জুড়ে থাকার সুখ। এ ছাড়া তার ঘরে আছে একটা সিলিং ফ্যানের শব্দ, আর প্রতি ঘণ্টায় একবার টুং করে বেজে ওঠা একটা দেয়াল ঘড়ির শব্দ।   
এক বছর আগেও এমন শয্যাশায়ী ছিলেন না আশালতা। কারো সাহায্য ছাড়াই বিছানা থেকে নামতে পারতেন। লাঠি হাতে সামান্য হাঁটতেও পারতেন। বেডপ্যান ব্যবহার করতে পারতেন। একবছর হল তিনি সেই ক্ষমতা হারিয়েছেন। এক বছর ধরে বিছানাতেই তার মল-মূত্র ত্যাগ। শারীরিক ক্ষমতা কমে গিয়ে মানুষ যত অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়, ততই তার অধিকার-বোধ কমতে থাকে। আশালতা এখন তার নিজের কোনও চাহিদার কথা এমনকি ছেলেকেও বলতে দ্বিধা করেন। এক বছর আগেও তার নাতিটা দুপুর বেলা তার পাশে এসে শুয়ে পড়ে বলত, ঠাম্মা আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। আশালতার আলাদা ঘুমপাড়ানি গান ছিল, যা শুরু হত মাসি-পিসি দিয়ে। আর তার পর ওই একই ছন্দে এসে জুড়ে যেত চেয়ার টেবিল ঘুনু রে, সেলেট পেন্সিল ঘুনু, বুড়া বুড়ি ঘুনু রে, ময়না পাখি ঘুনু, এরকম যা মনে আসে তা-ই। কবে একদিন আল্পনা আর কল্পনা নামে দুটি বাচ্চা মেয়ের নামও ঢুকে গিয়েছিল, আর তারপর থেকে ওই দুটো নাম উচ্চারিত না হলে নাতির মন ভরত না। খালি বায়না ধরত, আলবল কালবল ঘুনু বল। আলবল কালবল ঘুনু। সেই নাতি আর কাছে আসে না। কখনও মা বাবার পেছনে পেছনে এসেও দরজায় দাঁড়িয়ে পড়ে। ঘরে ঢোকে না। আশালতা দেখেন শুধু। কাছে ডাকার সাহস পান না।
ছেলে দিবাকর, বউ সুনন্দা আর নাতি দীপ্তকে নিয়ে আশালতার সংসার। এরকম ভাবতে ভাল লাগে। আসলে দিবাকর, সুনন্দা আর দীপ্তর সংসারের এক অধিকন্তু অংশ আশালতা। অবহেলিত নন। একটি কাজের মহিলা রোজ এ বাড়ির অন্য ঘরগুলোর সঙ্গে তার ঘরও ঝাড়ু দেয়, মোছে। তা ছাড়া প্রণতি নামের বউটি আছে তার সকালবেলার পরিচর্যার জন্য। রোজ এসে তাকে স্নান করিয়ে বাসি কাপড় পালটিয়ে দেয়, নোংরা বিছানা পরিষ্কার করে, কাপড়চোপড় কেচে দেয়। বউটির মাত-বোল ভাল। এসেই বলবে, কিতা গো মাসী, আইজ কিলান আছ। কিন্তু রুটিনের হাতে কাজ সারতে গিয়ে খেয়াল রাখে না আশালতা কোথায় চোট পান, কোথায় ব্যথা লাগে। আশালতা উঃ করে উঠলে প্রণতি সতর্ক হয়, বউদি শুনতে পেল কি? শুনলে খামোখা বকা ঝকা করবে। সুস্থ থাকলে আশালতা খুব সহযোগিতা করেন। তাতে তার নিজেরই কষ্ট কমে, প্রণতিরও সুবিধা হয়। কিন্তু জ্বর-জারি হলে তখন আর পারেন না। শরীরের লাশ ছেড়ে দেন একেবারে। তখন এই হাড়ে হাড় লাগা শরীরখানা সামলাতে গেলে এক আধটু চোট তো লাগতেই পারে। কিন্তু সামান্য উঃ শব্দ বউদির কানে গেলেই হয়েছে। প্রণতি চাপা গলায় গজ গজ করে, অত যদি মায়া লাগে, তে নিজে আইয়া আত লাগাও না কেনে? মনো করো পয়সা দিতরায় তে আর নিজে গু-মুত ছানতায় কেনে। হড়ি কার, তুমার না আমার? নিজেকে অসহায়ের মত প্রণতির হাতে সঁপে দিয়ে বিরক্ত আশালতা অপেক্ষা করেন, কখন এই স্নান-পর্ব শেষ হয়। স্নানের পর অবশ্য তাকে বেশ তরতাজা দেখায়।  
পুত্রবধূ সুনন্দা দিনে রাতে অনেকবার এ ঘরে আসে। সকালে চোখ মুখ ধুয়ে মুছিয়ে দেয়। বসে চামচে করে চা খাওয়ায়। গ্লাসে করে একটু একটু দুধ ঢেলে দেয় গলায়। যত্ন করে তিন-বেলার খাবার খাইয়ে দেয়। সন্ধ্যার পর মশারী খাটিয়ে দেয়। কাজের কথা বলে, কিন্তু গল্প গাছার তার সময় হয় না। আশালতার দেখভাল ছাড়াও এ ঘরে ওর নানা কাজ থাকে। কখনও বাক্স-আলমারি খোলে, কিছু বের করে অথবা কিছু ঢুকিয়ে রাখে। আশালতা ঘাড় কাত করে ওর চলা ফেরা দেখেন। কাজ শেষ করে আশালতার চেয়ে থাকা চোখের ওপর দিয়ে সুনন্দা চলে  যায়।    
সকালে ছেলে অফিসে আর নাতি স্কুলে চলে গেলে এ বাড়ি ভীষণ চুপচাপ। একা হাতে বাকী রান্নাবান্নার কাজ সারে সুনন্দা। টুকিটাকি অনেক কাজ থাকে তার। তারপর স্নান সেরে বেলা দেড়টা নাগাদ বেরিয়ে যায় ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে। ফিরে আসার পর কচি গলার কলকল কথায় বাড়িটা অল্প সময় প্রাণ পায়। আশালতা কান পেতে রাখেন, যদি একটা দুটো শব্দ বোঝা যায়। খাওয়া দাওয়া সেরে দীপ্ত ঘুমিয়ে পড়ে। সুনন্দার তখন একটুকরো অবকাশ। সে তখন টিভি চালায়। টিভি চালিয়ে কখনও ঘুমিয়েও পড়ে। টিভির পর্দায় হাসি কান্নার এতে বিরাম ঘটে না। এভাবেই বিকেল কাটে, সন্ধ্যা হয়। সন্ধ্যায় নিয়ম করে সন্ধ্যা-বাতি দেয় সুনন্দা। সে জোকার দিয়ে উঠলেই আশালতা দুটো হাত এনে কপালে ঠেকান। রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ তার ছেলে ফেরে। টুকটাক কথা শোনা যায়। ছেলের গলা, বউয়ের গলা, নাতির কলকলানি থেকে একটি সুখী সুখী চিত্রনাট্য তৈরি হয়। প্রতিটি উচ্চারণ থেকে আলো ছড়ায়, উত্তাপ ছড়ায়। উচ্ছলতা ছড়ায়। পাশের ঘরে শুয়ে থেকে আশালতা এই চিত্রনাট্যে নিজেকে খুঁজতে থাকেন। মাঝে মাঝে কোনও আত্মীয় স্বজন, বা ছেলের বন্ধুদের কেউ আশালতার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ওরা তাকে এ ঘরে নিয়ে আসে। পায়ের শব্দে চোখ খুলে তাকান আশালতা। মাসীমা কেমন আছইন? ছেলে কিম্বা বউমা কেউ মশারিটা তুলে ধরে। চোখ ছোট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মানুষটিকে চেনার চেষ্টা করেন আশালতা। তারপর গলায় স্বর ফুটলে স্পষ্ট করে বলেন, ভালা আছি। নইলে মাথা নেড়ে বোঝান, ভাল। কখনও শুধু কোঁচকানো চোখে তাকিয়ে থাকেন অনেকক্ষণ।
সুনন্দার মত দিবাকরও মাঝে মাঝে তার নিজের কাজে এ ঘরে আসে। আলমারি খুলে ফাইল পত্র বের করে। দিবাকরের পায়ের শব্দে চোখ খোলেন আশালতা। পুত্রের প্রতিটি নড়া চড়াকে দৃষ্টি দিয়ে লাগাতার অনুসরণ করেন। কখনও দিবাকরের চোখে পড়ে সেই তাকিয়া থাকা। সময় থাকে না একটু বসার। হয়তো কাউকে বসিয়ে রেখে এসেছে, বা কোনও জরুরী কাজ সারতে হবে। অথবা অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে শেষ ওভার, মিস করা যাবে না। হঠাৎ কোনও দিন, যদি সময়ের হিসেব মিলে যায়, দিবাকর এসে আশালতার পাশে বসে। মশারিটা উঠিয়ে দেয়। গলার স্বর একটু বাড়তি তরল করে দিয়ে, অনেক দিনের জমে থাকা ঘাটতি একসঙ্গে পুরিয়ে দেবার মত বাড়তি অন্তরঙ্গতায় কথা বলে। কিতা বুড়ী। কিতা কর। ছেলের এ জাতীয় বাক্যালাপে আশালতা আনন্দ পান। তার চোখে মুখে কৌতুক ফোটে। একটা ভালোলাগা ছড়ায় মুখে।  কোঁচকানো চোখে অনেকক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কখনও দিবাকর বলে, বুড়ি আর কয়দিন আছো আমরার বাড়ি? এই প্রশ্নেও মজা পান আশালতা। মুখের প্রশান্ত ভাব বজায় রেখে ডান হাত সামান্য উঠিয়ে হাত-ঘুরানো মুদ্রায় বুঝিয়ে দেন, জবাব জানা নেই। দিবাকর বলে, মরবার সময় আইলে, তিন দিন আগে আমারে কইবায়। আগে না কইয়া মরবায় না। বুঝছ? ঘাড় কাত করে সম্মতি জানান আশালতা। ভালোলাগায় আপ্লুত হন তিনি। কিন্তু ছেলের হাতে সময় বেশী থাকে না। মশারি নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। বলে যায়, ঘুমাই থাকো অখন। আশালতা মাথা নাড়েন, হ্যাঁ।
          অনেক দিন পর আজ রোদ উঠেছে। সুনন্দার তাই অনেক ব্যস্ততা। যত ভেজা কাপড় জমেছে এ ক’দিনে, সব শুকিয়ে নিতে হবে। আকাশের কোনও ভরসা নেই। একটু আগে রোদের মধ্যেই তড়বড়িয়ে বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টির ধারায় রোদ পড়ে রুপোর জরির মত ঝলমল করছিল চার দিক। গত কয়েকদিন ধরে ঘরের ভেতর চারদিকে দড়ি টাঙিয়ে ভেজা কাপড় শুকোনো হচ্ছিল। চলতে ফিরতে গায়ে লাগত। কেমন চাপা দুর্গন্ধ ভাসত ঘরের মধ্যে। আজ সব জানালা খুলে দিয়েছে সুনন্দা। একটু রোদ, একটু হাওয়া ঢুকুক, ভ্যাপসা গন্ধ কাটুক। আশালতার জ্বরটা সামান্য কমেছে দেখে আশ্বস্ত হয়ে সে চলে গেল নিজের কাজে। আশালতা শুয়েই থাকলেন।   
একটু পরেই প্রণতি এসে গেল।  
          গা হাত পা ভালো করে উম-গরম জলে মুছিয়ে দিয়ে আশালতাকে ভাল জামা কাপড় পরিয়ে দিয়েছে প্রণতি। তারপর সুনন্দাকে ডেকে বলল, ও বউদি, মাসীমারে আইজ বারিন্দাত নিতায় নি? মাঝে মাঝে আশালতাকে ওরা ধরে ধরে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বেতের চেয়ারে বসিয়ে রাখে। এতে মনটা ভাল হয় আশালতার। সুনন্দা ঘরে ঢুকল, বলল, নিতাম তো, কিন্তু শরীরর যে অবস্থা, পরে নি আনতাম পারমু। প্রণতি বলে, ঠিক আছে, আমি ফিরার সময় একবার মুখইর দিমু নে। প্রণতি আরও দুটো বাড়ির কাজ সেরে এ পথেই বাড়ি ফেরে। তে আইচ্চা, ধর। দুজনে মিলে আশালতাকে আস্তে আস্তে হাঁটিয়ে নিয়ে আসে বারান্দায়। বেতের চেয়ারে ভাল করে কুশন ঠেস দিয়ে জুত করে বসিয়ে দেয়। অনেক দিন পর আশালতার মনটা খুব উৎফুল্ল আজ। বেশ দেখতে পাচ্ছেন সামনের রাস্তা দিয়ে লোক আসছে যাচ্ছে। উঠানের গাছ পালা গুলো দেখলেন, নারকেল গাছ, সুপুরি গাছ। বৃষ্টির জল জমে আছে উঠানের এখানে ওখানে। সব চোখে পড়ল। সত্যি মন ভাল হয়ে গেছে আশালতার। প্রণতি চলে গেল। সুনন্দাও ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের কাজে। আশালতা বসে রইলেন। বসে বসে একসময় ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। তন্দ্রার মধ্যেই শুনলেন, কে যেন ডাকল, মাসীমা ভালা নি গো?
          আশালতা কষ্টে চোখ খুললেন। ঘুমের চটকা কাটিয়ে অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চেহারা আর কণ্ঠস্বর মেলাতে মেলাতে মনে পড়ল, এ তো গন্ধরাজ! কত দিন পরে এল। অয় বা, ভালা আছি। তুমি ভালা নি। বউত দিন পরে দেখলাম। আও না নি ইবায়। মাঝে মাঝে আইও। ওউ দেখ চাইন, টাট্টির বেড়া ইখান কাইত অই রইছে। আমার পুয়ারে কত কই, গন্ধরাজরে একটা খবর দে। তারা ইতা হুনাত নায়। দেখো চাইন, পারলে ওখানতা একটু ঠিক করিয়া দিয়া যাও। বউ কই গেলায় গো, গন্ধরাজরে একটু চা দিও। গন্ধরাজ, চা খাইয়া যাইও।
          গন্ধরাজ দেখে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আশালতা। সে-ও তার হাসি হাসি মুখখানা নিয়ে তাকিয়ে থাকে আশালতার দিকে। আশালতার চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারে, চিনতে পেরেছেন। নিজেই বলতে থাকে, বড় মনে টানের গো কয়দিন ধরি। আইজ দিন দিছে তে মনো করলাম যাই, একবার মাসীমারে দেখিয়া আই। আখতা কুন দিন যাইবায়গি, তেউ আর দেখতাম নায়। কথা শেষ করে আশালতার দিকে তাকিয়ে ছিল গন্ধরাজ। আশালতার চোখে ভাষা ফুটেছে, ঠোঁট দুটোও একটু ফাঁক হয়েছে, সামান্য কাঁপছে। কিছু বুঝি বলবেন আশালতা। মনে হচ্ছে যেন অনেক কিছু বলতে চান। কিন্তু কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে কোনও বাক্য স্ফুরিত হয় না। আবেগ-রুদ্ধ গলায় শুধু ঘড়ঘড় শব্দ ওঠে। বারান্দার মেঝেতে বসেছে গন্ধরাজ। আশালতার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে এক সময় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। তারপর উঠে পড়ল। হাসি লটকানো মুখখানা নিয়ে এগিয়ে গেল উঠানের দিকে। বউদি কই, ভালা আছইন নি? ভেতর থেকে সুনন্দা তার ডাক শুনতে পায়। বেরিয়ে এসে বলে, গন্ধরাজ নি, ভালা আছো নি। গন্ধরাজ বলে, অয়, ভালাউ আছি। এর পরের কথাটা সুনন্দা বলতে গিয়েও নিজেকে থামিয়ে দিল। বলল না, বইও গন্ধরাজ। চা খাইয়া যাইও। এখন তার ব্যস্ততার শেষ নেই। এখন আবার আলাদা করে গন্ধরাজের জন্য রান্নাঘরে গিয়ে চা বসাতে পারবে না। গন্ধরাজ বসে না। এমনি এদিক ওদিক হাঁটে। নিজের অভ্যাসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, কোথায় কী মেরামতির দরকার আছে। সে আজ কাজ করতে আসে নি। হাত-দা খানাও সঙ্গে আনে নি। তবু সুপুরি গাছের নীচে পড়ে থাকা ভেজা সুপুরির ছইগুলো একপাশে সরিয়ে রাখে। কাঁঠাল গাছের নিচে পাতা পড়ে পড়ে কাদা মেখে জঞ্জাল হয়ে আছে, একটা ঝাড়ু খুঁজে এনে সেগুলো এক জায়গায় জড়ো করে। তারপর সামনের বারান্দায় এসে আশালতার দিকে তাকায়। আশালতা তখন চোখ বন্ধ করে মাথা এলিয়ে দিয়েছেন এক পাশে।
          স্নান টান সেরে সুনন্দা যখন সামনের বারন্দায় এল, গন্ধরাজকে দেখতে পেল না। মনটা একটু খচখচ করল। এখন এক কাপ চা দিতে পারত সুনন্দা। পুরনো লোক। এইটুকু খাতির সে পায় এ বাড়িতে। এবার আশালতার দিকে দৃষ্টি ফেরায় সুনন্দা। ঘুমোচ্ছেন। এভাবে ঘুমোলে ঘাড়ে ব্যথা হবে। সুনন্দা তাই আস্তে আস্তে ডাকে, মা, উঠইন। বিছ্‌নাত  চলইন। ভাত দিমু, খাইয়া ঘুমাই থাকবা। ঘোর লাগা চোখে তাকালেন আশালতা। সুনন্দাকে চিনতে পেরেছেন বলে মনে হল না। একটা দুর্গন্ধ নাকে লাগতে সুনন্দার সন্দেহ হল। নাক দিয়ে জোরে শ্বাস নিতে গিয়ে বুঝতে পারল, কি কাণ্ডটা ঘটে গেছে। মাথায় আগুন জ্বলে উঠল তার। এখন,  এই অবেলায় এই সব নোংরা সাফ করতে হবে? প্রণতি বলেছিল আসবে। সেও কি এখন আবার নোংরা ঘাটতে রাজী হবে? নিজেকেই দোষ দেয় সুনন্দা। মরতে কেন আজ উনাকে ভাল কাপড় পরিয়ে বারান্দায় এনে বসিয়েছিল! এর পর বেশ কিছুক্ষণ চলল নিজের ভাগ্যকে গালাগাল। সমস্ত ঝামেলা তার ঘাড়ে ফেলে ছেলে দিব্যি অফিস করছে। কোন পাপ করে সে এসেছিল এই সংসারে। অর্দ্ধচেতন অবস্থায় আশালতা বুঝতে পারেন, উনি গোলমাল করে ফেলেছেন। মরমে মরে থেকে সব বাক্যবাণ হজম করেন। একটু পরে নিজের কথা রাখতে প্রণতি আসে। আশালতার দায়িত্ব নেয়। সুনন্দার রাগারাগি দেখে বলে, আইচ্চা গো বউদি, আর গাইল্লাইও না, বুড়া মানুষ। আশালতাকে পরিচ্ছন্ন করে বিছানায় শুইয়ে দেয় প্রণতি। গা ঘিন ঘিন করছিল বলে সুনন্দা আবার স্নানে যায়। ফিরে এসে রাগে গজগজ করতে করতে থালায় খাবার বেড়ে এনে আশালতাকে বলে, নেইন, খাইয়া আমারে উদ্ধার করইন। আশালতা তখন চোখ খুলতে পারছেন না। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তার। অথচ সুনন্দাকে বেরোতেই হবে। দীপ্তর ফেরার সময় হয়ে গেছে। আবারও মনটা খচ খচ করে তার। হাল্কা সাজ করে দরজা খুলে বেরোয়।
*        *        *
          রাতে দিবাকর বাড়ি ফেরার পর সুনন্দা তার সমস্ত অভিযোগ, উষ্মা, হতাশা উজাড় করে দিল দিবাকরের উপর। আর সম্ভব নয় একজন বৃদ্ধাকে এভাবে দিনরাত টানা। এক অসুস্থ শাশুড়িকে সামলাতে বছরের পর বছর তার কোথাও যাওয়া হয় না। বসে আছে এখানে নোংরা ঘাটার জন্য। দিবাকর যেন দিনরাতের জন্য লোক রাখে। আর নইলে নিজে অফিস কামাই করে এসে মা-র সেবা যত্ন করুক। দিদিরা সব দূর থেকে উপদেশ দেবে শুধু। হাত লাগানোর জন্যে কেউ নেই। চুপচাপ সব শুনল দিবাকর। মা-র বকাবকি শুনে ছেলে দীপ্ত এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে। দিবাকর অফিসের পোশাক পাল্টে মা-র ঘরে গেল। পেছন পেছন এসেও দীপ্ত দরজায় আটকে রইল। মশারি খাটানো রয়েছে। কম আলোর একটা সি এফ এল জ্বলছে ঘরে। দিবাকরের খেয়াল হল, বেশ ক’দিন এ ঘরে আসা হয় নি তার। বিছানাপত্র থেকে কেমন একটা কটু গন্ধ বেরোচ্ছে। দিবাকর মশারি উঠিয়ে আশালতার কপালে হাত রাখে। গা বেশ গরম। সুনন্দাকে জিজ্ঞেস করে, ওষুধ দিয়েছ কিছু? যেটা চলছিল সেটাই দিয়েছি। সুনন্দা জানায়। দিবাকরের হাতের স্পর্শে চোখ খুলেও বেশীক্ষণ তাকাতে পারলেন না আশালতা। চোখ বন্ধ হয়ে গেল। দিবাকরের খুব অসহায় লাগে। সুনন্দার অভিযোগ নিয়ে কিছু বলার নেই। কারই বা ভাল লাগে এই রকম একজন রোগী ঘাটতে। কিন্তু সারাক্ষণের লোক রাখার খরচের দিক বাদ দিলেও, সেই বাড়তি লোকটি কি খাবে, কোথায় শোবে, এসব ঝামেলার দিকও আছে। চট করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। দিবাকর হাত বাড়িয়ে আশালতার হাতখানা ছুঁলো। জলের বোতল থেকে একটু জল হাতে নিয়ে আলতো করে কপাল ভিজিয়ে দিল। আশালতা আবার চোখ খোলেন। তারপর দিবাকরের দিকে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে থাকেন। আশালতাকে তাকাতে দেখে দিবাকর জিজ্ঞেস করে, কিতা গো। আবার জ্বর উঠিগেছে নি? আশালতার কথা ভাল বোঝা যাচ্ছে না। গলায় কফ ঘড়ঘড় করছে। দিবাকর আবার জিজ্ঞেস করে, কিতা কও? আশালতা আরেকবারের চেষ্টায় একটু স্পষ্ট করে বললেন, গন্ধরাজ! দিবাকর সুনন্দার দিকে তাকায়। গন্ধরাজ আইছিল নি? আইছিল দুপরে। দিবাকর জিজ্ঞেস করে, কিতা অইছে গন্ধরাজর? এবার অনেকটাই স্পষ্ট উচ্চারণে আশালতা থেমে থেমে বলেন, গন্ধরাজরে, একটু চা দেও। আশালতার চোখের দিকে তাকিয়ে দিবাকর বলে, আইচ্চা, দিব নে। তুমি ঘুমাও অখন। আশালতা সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়লেন। তারপর চোখ বন্ধ করলেন।
----------------- 
(সেবা, করিমগঞ্জ, মে ২০১৬?)

Tuesday 12 January 2016

এক কাপ চায়ের সঙ্গে



এক কাপ চায়ের সঙ্গে
-      মলয়কান্তি দে
বিকেডি স্যারের সকালের কোচিং ভেঙ্গেছে। তার মানে কাঁটায় কাঁটায় সকাল নটা। অভ্যেসমত বিকেডি বারান্দায় এলেন। গেটের বাইরে সার দিয়ে রাখা চারটে বাইক আর তিনটে সাইকেল। বাইকগুলো ভ্রুম্‌ ভ্রুম্‌ শব্দে গর্জে উঠলো প্রায় একসঙ্গে। তারপর গর্‌র্‌র্‌র্‌ শব্দ তুলে গলি কাঁপিয়ে বেরিয়ে গেল। গলির রাস্তাটা দুর্দশাগ্রস্ত, ভাঙ্গা-ভাঙ্গা, উঁচু-নিচু। সব সময় ভয় থাকে এই না কেউ কাত হয়ে পড়ে যায়,  হাত পা ভাঙ্গে, রক্তপাত ঘটে। কিন্তু বাইক-ওলারা ওস্তাদ। কাত হতে হতেও সামলে নিয়ে বেরিয়ে যায় বাহাদুর স্টান্টবাজের মত। ওদের এই বাহাদুরি নীরবে হজম করে নিয়ে একটু ধীরে সুস্থে সাইকেল-ওলারা প্যাডেলে চাপ দেয়। শুরুতে একবার ডানে, একবার বাঁয়ে কেতরে তারপর সোজা হয়ে গতি বাড়ায়। মোট আটজন ছাত্র আর তিনজন ছাত্রী ছ’টা বাহনে বাঁটাবাঁটি করে চলে গেল।
বিকেডি স্যারের এই বারান্দায় এসে দাঁড়ানোর এমনিতে কোনও প্রয়োজন নেই। দশ বছর আগে যখন এখানকার কলেজে চাকরি পেয়ে এই বাড়িটাতে থাকতে আসেন, এবং ছাত্র পড়াতে আরম্ভ করেন,  তখন পড়ানো শেষ হলে এভাবে এসে বারান্দায় দাঁড়াতেন। একটা দুটো মেয়ে পড়তে আসত। বিকেডির কেমন যেন মনে হত, এই ছাত্রীদের যাতে কেউ উত্যক্ত না করে, অন্তত স্যারের বাড়ির সামনে, সেটা খেয়াল রাখা তার দায়িত্ব। এতেই একটা অভ্যেস তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এখন অবশ্য ছেলেরা মেয়েরা এমন সহজ ভাবে মেশে, গার্জেন-গিরি ফলানোর জায়গা থাকে না। এখন যে তিনি আগের মত বারান্দায় এসে দাঁড়ান, সেটা অনেকটা এই ভাঙ্গা রাস্তার কৈফিয়ত সেজে। চিন্তাও হয়, কেউ পড়ে টড়ে গেলে কোচিং-এর বদনাম হয়ে যাবে বাজারে। ছাত্র ছাত্রীরা চলে যাবার পর বিকেডি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন।  
ছাত্র পড়ানোর জন্য বেঞ্চ ডেস্ক বানিয়ে নিয়েছেন বিকেডি। এ ছাড়া তার বইপত্র রাখার জন্য একটা কাঠের টেবিল রয়েছে ঘরের এক কোনে। টেবিলের একটা ড্রয়ার খুলে খৈনির প্যাকেট হাতে নিতেই তার স্ত্রী এসে ঢুকলেন। এই শোনো-, তারপর বিকেডির হাতে খৈনির প্যাকেট দেখে মুখ বেঁকিয়ে বললেন, এ:, কলেজের প্রফেসর খৈনি খাচ্ছে দেখো, ছিঃ। তবে কি সিগারেট খাবো? তা-ও ভালো। একটু ভদ্রলোক দেখায়। স্ত্রীর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বিকেডি পরিমাণ মত খৈনি বাঁহাতের তালুতে নিয়ে ডান হাতে ডলতে শুরু করলেন। মুখে বিরক্তি বজায় রেখে স্ত্রী বললেন, যাকগে, যা খুশী কর, বলছিলাম রাতের চিকেন ফ্রিজে রাখা আছে, খাবে এখন? গরম করবো? যা খুশী করো, তবে তাড়াতাড়ি কর। এই সময় ঘরের ডোরবেল বাজল। দরজার দিকে তাকিয়ে স্ত্রী বললেন, এখন আবার কে এলো? হবে কোনও ছাত্র, কিছু ফেলে গেছে, বা অন্য কোনও দরকারে। তুমি যাও, তাড়াতাড়ি করো।
স্ত্রী বেরিয়ে গেলে বিকেডি খৈনির টিপ ঠোঁটের ফাঁকে চালান করে দিয়ে দরজা খুললেন। ভেবেছিলেন কোনও ছাত্র, তার জায়গায় দেখলেন অন্য তিনটি ছেলে। কুড়ি বাইশ বছরের ছেলেটিকে মনে হল পাড়ায় দেখেছেন, বাকী দুজন অচেনা। মুখে একটু লজ্জা লজ্জা হাসি ঝুলিয়ে পাড়ার ছেলেটি বলল, স্যার, এরা আপনার সাথে একটু কথা বলবেন। ‘স্যার’ বলে ডাকলেও ছেলেটিকে, বা এদের কাউকেই, কখনও তাদের কলেজে দেখেননি বিকেডি। এই সময়টাতে বিকেডির ব্যস্ততা থাকে। ঝট পট স্নান খাওয়া সেরে কলেজে ছুটতে হবে। ফার্স্ট পিরিয়ডেই ক্লাস আছে। উনি সময় নষ্ট না করে বললেন, এখন নয়, এখন সময় হবে না। পেছন থেকে অন্য একটা ছেলে, সাতাশ আটাশ হবে বয়স, বলল, বেশী সময় নেবো না স্যার। জাস্ট দু মিনিট। ছেলেগুলো চাঁদাপার্টী নয়। হলে বোঝা যেত। হাতে রসিদ বই জাতীয় কিছু থাকতো। বিনা-বাক্যব্যয়ে বিদায় করা যেত। এরা কারা এবং কি জন্যে এসেছে বোঝা যাচ্ছে না। তাই একটু কৌতূহলও জাগছে। বিকেডি বললেন, দু মিনিট হলে এস। কিন্তু তার বেশী সময় দিতে পারব না। আমার কলেজ আছে। বলে বিকেডি দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। ছেলেগুলো ভেতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকল, বিকেডি বসতে বললেন না। সাতাশ আটাশ বছরের ছেলেটা মুখে কঠিন কর্তৃত্বের একটা ভাব এনে বলল, আমরা একটা রিকোয়েস্ট নিয়ে এসেছি স্যার। আপনি মুসলিম ছেলেদের পড়ানো বন্ধ করুন।
কেন?
বিকেডি আকাশ থেকে পড়লেন। তার কোচিং-এ তিনটে মুসলিম ছাত্র আছে। কলেজেও যথেষ্ট সংখ্যায় মুসলিম ছাত্র আছে। সবগুলো কোচিং-এই কিছু সংখ্যক মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী থাকে। মুসলিম অধ্যাপক আছেন চারজন। ওদেরও কেউ কেউ বাড়িতে ছাত্র পড়ান। সেখানেও তিরিশ ভাগ মুসলমান ছাত্রের সঙ্গে সত্তর ভাগ হিন্দু। এরকম নিষেধাজ্ঞার অর্থ কী? বিকেডির চোখে মুখে বিরক্তি স্পষ্ট।
সাতাশ আটাশ এবার তার চোখে চোখ রেখে একটু রোয়াব দেখানো গলায় বলল, কেন স্যার, আপনি জানেন না? আপনার চোখের ওপর দিয়ে রোজ ওই মোল্লাটা একটা হিন্দু মেয়েকে বাইকের পেছনে বসিয়ে নিয়ে যায়, আপনি দেখেন না?
মোল্লা? হ্যাঁ, ইমরান নামের ছেলেটা বেশীর ভাগ সময় ধপধপে শাদা পাজামা পাঞ্জাবীর সঙ্গে মাথায় সুন্দর কারুকাজ করা মুসলমানি তক্কি পরে আসে। এমন কি এমনি শার্ট প্যান্টের সঙ্গেও পরে। ভদ্র ছেলে, খুবই মার্জিত আচার আচরণ। কিছু প্রশ্ন করলে অন্যরা যখন বলে অয় স্যার, ইমরান বলে জী অয় স্যার। চেহারা পোষাকে মনে হয় সম্পন্ন পরিবারের ছেলে। হয়তো একটু বেশী ধর্মনিষ্ঠ। সে তো কেউ হতেই পারে। তাতেই ও মোল্লা হয়ে গেল? আর হলেই বা, আপত্তিটা কোথায়? শিবানী নামের একটু মলিন চেহারার মেয়েটাকে মনে পড়ল। সকালে আসার সময় মেয়েটা কীভাবে আসে বিকেডি খেয়াল করেনি নি, কিন্তু ফেরার সময় কখনও কখনও ইমরানের বাইকের পেছনে ওঠে, এটা দেখেছেন। বাইকে গেলে মেয়েটার সময় বাঁচে। ওদেরও তো বাড়ি গিয়ে আবার সময় মত ক্লাসে পৌঁছতে হবে। হয়তো ওর আর ইমরানের বাড়ি একই রাস্তায়, তাই ইমরান ওকে নামিয়ে দিয়ে যায়। এ নিয়ে তো কারও কোনও মাথাব্যথা নেই? তাহলে এদের আপত্তির কারণ কি? আর ইমরানের বাইকে চড়ে শিবানীর যাওয়া নিয়ে যদি আপত্তি হয়, তার জন্যে সব মুসলিম ছাত্রকে পড়ানো বন্ধ করতে হবে কেন?
কিন্তু একে তো এখন তার কথা বলারই সময় নেই, তার উপর এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলার কিছু আছে বলেও তার মনে হল না। তাই উনি বললেন, তোমরা যাও এখন। আমাকে বেরোতে হবে। তৃতীয় ছেলেটি, যে এতক্ষণ চুপ করে ছিল, সে এবার পেছন থেকে বলল, আপনি আমাদের কথা শুনবেন না? হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিয়ে সাতাশ আটাশ এবার সিদ্ধান্ত জানানোর ভঙ্গীতে বলে, এই মাসটা আপনাকে দিচ্ছি স্যার। সামনের মাস থেকে ওই মোল্লাকে এদিকে দেখলে ওর বিপদ হবে। তার দায় কিন্তু থাকবে আপনার। তখন আমাদের দোষ দেবেন না। বলে দুপ দাপ শব্দে পা ফেলে বেরিয়ে গেল। ওর পেছন পেছন বাকী দুজন।   
দরজা বন্ধ করতে করতে বিকেডির কপালে ভাঁজ ফোটে। এ তো মনে হচ্ছে একটা উটকো ঝামেলায় পড়া গেল! কিন্তু এখন তার দুশ্চিন্তা করারও সময় নেই। দেরী হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আবার এসে ঢুকলেন তার স্ত্রী। কেন এসেছিল গো ছেলেগুলো? তার মানে স্ত্রী জানালা দিয়ে দেখেছেন ছেলেগুলোকে। তুমি চেনো ওদের? না, চিনি না। তবে কেমন যেন উগ্র মেজাজের মনে হল। একটা তো এ পাড়াতেই থাকে। সারাদিন গুলতানি করে বেড়ায়। পড়া শোনা কিছু করে বলে মনে হয় না। কী বলল? কপালের ভাঁজ মসৃণ করে দিয়ে বিকেডি বললেন, জিজ্ঞেস করল রান্না হয়ে গেছে কি না।   
কলেজে টানা দুটো ক্লাস শেষ করে বিকেডি কমন রুমে এসে প্রথমেই এক গ্লাস জল খেলেন ঢক ঢক করে। সারা শরীর সেই জল শুষে নিল। একটা ঠাণ্ডা তৃপ্তি ছড়াল শরীর জুড়ে। লম্বা শ্বাস নিয়ে উনি তার নির্দিষ্ট চেয়ারে বসলেন আরাম করে। পরবর্তী দুটো পিরিয়ড অফ। উল্টোদিকের চেয়ারে বসে লুৎফুর রহমান একটা বড় খাতায় কি সব নোট করছে, সামনে তিনটে বই খোলা। কখনও এটার পাতা ওলটাচ্ছে, কখনও ওটার। নিশ্চয়ই ছাত্রদের জন্যে নোট তৈরি করছে। এই ফাঁক-গুলোয় বিকেডিও নানা বইপত্র ঘাঁটেন, অঙ্ক করে রাখেন, যাতে ক্লাসে বা কোচিং-এ ছাত্রদের সামনে অপ্রস্তুত হতে না হয়। আজও তেমন কিছু শুরু করার কথা ভাবতে গিয়েই তার মনে পড়ল সকালবেলার ঘটনাটা। এতক্ষণ ক্লাসে বকবক করে করে সে সব মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। বিকেডি এখন একটু ঠাণ্ডা মাথায় সমস্ত ব্যাপারটা ভাবতে বসলেন। ঠাণ্ডা মাথা তাকে বোঝাল, ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-বেঠিক এসবই আসলে আপেক্ষিক। অন্য অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। বিকেডি ঝামেলায় জড়াতে চান না। কলেজের ক্লাস আর বাড়ির কোচিং ছাড়া অন্য কোনও ব্যাপারে তার কোনও উৎসাহ নেই। চাকরি পাবার পর থেকেই তিনি জানেন তাকে অনেক টাকা রোজগার করতে হবে। তিনি জানেন সংসারে টাকার গুরুত্ব কতখানি। টাকা নেই তো কিছুই নেই। এখন এই চাকরি তাকে যতখানি সুযোগ দেয়, তার সদ্ব্যবহার করে তাকে টাকা জমাতে হবে। বাড়িঘর বানাতে হবে। প্রাচুর্যের নানা উপকরণ করায়ত্ত করতে হবে। ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষার জন্যে টাকা লাগে। অসুখ বিসুখে টাকা লাগে। টাকাই এখন তার ধ্যান জ্ঞান। একটা ছাত্র তার কাছে দুখানা হাজার টাকার নোট। মুসলমান ছাত্রদের যদি না পড়ান, ছাত্রসংখ্যা একজন দুজন কমে যাবে। আবার বাড়িতে যদি কোনও হুজ্জতি হয়, তাতে অন্য ছাত্রদেরও আসা কমে যাবে। একবার তার মনে হল, এই ঝুট ঝামেলা থেকে সহজে রেহাই পেতে ছেলে তিনটেকে বলেই দেবেন, তোমরা আর এসো না। তারপরই ছেলেগুলোর মুখ মনে পড়ল। বাচ্চা বাচ্চা সরল উৎসাহী মুখগুলো, কত দূর থেকে পড়তে আসে। এমন কথা ওদের বলতে পারবেন উনি? এমন কথা যে এক লহমার জন্যেও তার মনে এসেছিল, সে জন্যে বিকেডির অনুশোচনা হল। ছিঃ, এত নীচে নামতে হবে? কিন্তু ঝামেলাটা তাহলে মিটবে কী করে?   
কারও সাথে পরামর্শ করতে পারলে ভাল হত। কিন্তু কার সাথে করবেন? নিজেদের কোচিং-এর বিষয়ে অধ্যাপকরা একে অন্যের সাথে বিশেষ কথাবার্তা বলেন না। এ নিয়ে কারও কারও মধ্যে রেষারেষি চলে, তো কারও কারও মধ্যে হিংসা-হিংসি। অতনু সাহার কথাটা স্বাভাবিকভাবেই প্রথম মনে এল। অতনু সাহা টিচার্স এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি। বামপন্থী। একেবারে পার্টীর লোক। সুযোগ পেলেই দক্ষিণ-পন্থীদের মুণ্ডপাত করেন। আজকাল মুণ্ডপাতের অছিলাও জুটছে খুব। প্রায়ই এমন কিছু ঘটনা ঘটছে, যাতে অতনু সাহা বাজার গরম করার লাগাতার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন। অতনু-দাকে ঘটনাটা বললে উনি এটা নিয়ে বিশাল কিছু কাণ্ড ঘটিয়ে দিতে পারেন। হয়তো একটা মিটিং, মিছিল কিংবা ধর্নারই বন্দোবস্ত করে ফেলতে পারেন। তাতে বিকেডির লাভ নেই কিছু। বরং একটা ব্যাড পাবলিসিটি হয়ে যাবে। যদি ওই ছেলেগুলো কাল ইমরানকে ধরে বেধড়ক পিটিয়ে দেয়? হয়তো পুলিশ কেস হবে। হয়তো ছেলেগুলোকে পুলিশ ধরবে। কিন্তু বিকেডির কোচিং-এর বদনাম রটে যাবে বাজারে। ছাত্র আসা কমে যেতে পারে।
অতনু সাহার বিপরীত অবস্থানে আছেন সত্যেন চক্রবর্তী, রাজনীতির বর্ণ-পরিচয়ে যিনি গেরুয়া, এবং সাম্প্রতিককালে হঠাৎ নিজেকে ক্ষমতাশীল ভাবতে শুরু করেছেন। এই মুহূর্ত্যে তার প্রধান লক্ষ্য দুটো। এক, আগামী কলেজ নির্বাচনে তার গেরুয়া ছাত্র সংগঠনটিকে বেশী বেশী আসনে জেতানো, পারলে ছাত্র সংসদে গরিষ্ঠতা পাইয়ে দেওয়া, আর দুই, অতনু সাহাকে হটিয়ে টিচার্স এ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক হওয়া। দুটো কাজই কঠিন, তবে সামান্য হাওয়া ঘোরাতে পারলে অসম্ভব নয়। সত্যেন চক্রবর্তীর তৃতীয় একটা গোপন বাসনার কথা লোকে বলাবলি করে। সেটা হল আগামী বিধানসভা নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া। সত্যেন চক্রবর্তীকে কথাটা জানালে উনি কী করবেন বলা শক্ত। হয়তো ছেলেগুলো কারা জেনে নিয়ে বলে দেবেন এরকম না করতে। আবার হয়তো উনি ওই ছেলেগুলোর পক্ষ নিয়েই লেকচার দিতে শুরু করবেন। লাভ জেহাদের তত্ত্ব ঝাড়বেন। বলবেন তাড়িয়ে দাও ওদের। তাহলে বিকেডি কী করবেন? একটু আগে সারা শরীরে একটা ঠাণ্ডা তৃপ্তি ছড়িয়েছিল। এখন সেখানে মরুভূমির শুষ্কতা অনুভব করছেন বিকেডি। উঠে গিয়ে আরেক গ্লাস জল খেলেন।
পিরিয়ডের ঘণ্টা বাজতে বই খাতা গুছিয়ে লুৎফুর বেরিয়ে গেল, ওর ক্লাস আছে। আরও দু একজন বেরোলেন। ক্লাস শেষ করে এসে  কমন রুমে ঢুকলেন দু তিনজন। দরজার সামনে সত্যেন চক্রবর্তীকে দেখা যাচ্ছে। তার সঙ্গে কয়েকটা ছেলে, উঁচু ক্লাসের ছাত্র। উত্তেজিত গলা শোনা যাচ্ছে সত্যেনের। প্রতিবাদ করবে তোমরা। করতে দেবে না ওই নাটক। এই সব দেশ-বিরোধী এজেন্ডাকে কোনও ভাবেই সফল হতে দেবে না। বলতে বলতে সত্যেন চক্রবর্তী এসে ঘরে ঢোকেন। সঙ্গে ঢোকে সেই ছেলেগুলো। বিকেডি একবার দেখে নিলেন কমন রুমে কে কে আছেন এই মুহূর্ত্যে। অন্যরাও ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে, এবং ওর সঙ্গের ছেলেগুলোকে দেখল। বুঝতে চাইল কি নিয়ে চলছে কথাবার্তা। সত্যেন এবার গলা নামিয়ে, অনেকটা ফিস ফিস করে, হাত মাথা নাড়িয়ে ছেলেদের কিছু নির্দেশ দিলেন। সব শোনা গেল না। শুধু শেষ কথাটাই বোঝা গেল, - তোমরা শুধু এইটুকু করো, বাকীটা আমি দেখব। ছেলেগুলো বেরিয়ে যেতে সত্যেন তার চেয়ারের দিকে এগোলেন। কমনরুমে উপস্থিত সব কয়টি মুখে আলাদা করে চোখ ফেলে ফেলে দেখলেন। তারপর বসলেন তার নির্দিষ্ট চেয়ারে। বিকেডি অন্যমনস্ক চোখে সত্যেন চক্রবর্তীর দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। চোখাচোখি হবার পর আর চোখ ফেরাবার সুযোগ ছিল না। কিছু বলতেই হয়। তাই জিজ্ঞেস করেন, কি হয়েছে সত্যেনদা, বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে? আর বল কেন। সত্যেন যেন এই সংকেতটুকুরই অপেক্ষায় ছিলেন। বলতে শুরু করলেন, দেশের সংস্কৃতি, দেশের মনিষী, দেশের কোনও কিছুর প্রতি এদের কোনও শ্রদ্ধা নেই। বিদেশের সব কিছুই ওদের চোখে ভাল, সব কিছু মহান। দেশের ঐতিহ্য যত পারো খাটো কর, বিদেশীদের কাছে বাহবা জুটবে। চাই কি নোবেল টোবেলও পেয়ে যেতে পারো।
মৃদুলা কানুনগো বসেছিলেন সত্যেন চক্রবর্তীর দুটো চেয়ার পরে। নিপাট ভাল মানুষের মত বললেন, এটা কিন্তু সত্যি। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি যেন সবাই ভুলতে বসেছে। নাচ গান বলতে আজকাল যা দেখি আর যা শুনি, বমি পেয়ে যায় একেবারে। কথাটার অগভীরতা অনুধাবন করতে পারলেও এই সুযোগে সত্যেন এবার গলা চড়ান। আরে, পেছনে কারা আছে সেটা দেখবে তো। বিদেশী তত্ত্ব কপচে যারা রাজনীতি করে তারা কী ভাল শেখাবে বল। সারা দেশে তো অস্তিত্ব বলতে কিছুই নেই, শুধু এর ওর লেজুড় হয়ে টিভিতে মুখ দেখায়। কথাগুলো বলতে বলতে সত্যেন আড়চোখে দীপেন্দু সেনগুপ্তকে দেখছিলেন। দীপেন্দু অবশ্য আজকের কাগজের এডিটোরিয়েলের পাতায় চোখ নিবদ্ধ করে বসে আছে। রাজর্ষি দেবনাথ বসেছে কমন রুমের অন্য দিকে, সত্যেনের চেয়ে অনেকটাই দূরে। সেখান থেকেই গলা তুলে বলল, আরে হয়েছে টা কি সেটা তো বলবেন। কী হয়েছে সেটা দীপেন্দুকে জিজ্ঞেস কর। ও-ই তো সব কোন্দলের কারিগর। এবার শেষ সামলাক। দীপেন্দু এবার কাগজ থেকে মাথা তোলে। আমি আবার কী করলাম সত্যেনদা? কেন, নাটকটা তো তুমিই লিখেছ। হ্যাঁ, আমিই লিখেছি। তো? তো আবার কি। এই রকম নাটক কি করে লিখতে পারলে? সারা নাটক জুড়ে শুধু আমাদের ধর্মগ্রন্থ গুলোকে নিয়ে কাঁটাছেঁড়া। হিন্দু সংস্কৃতির মধ্যে কিছুই কি ভালো পাওনা তোমরা? শুধু নিন্দা করে গেছ? সত্যেনদা, নাটকটা আপনি পড়েছেন? আমি পড়িনি। আমাদের ছাত্ররা বলেছে। ওরা কি মিথ্যে বলবে?  তোমার নাটকে তুমি গেরুয়া রঙটাকেই কাঠগড়ায় তুলেছ। আরে সত্যেনদা, আমার নাটকে গেরুয়া রঙটা এসেছে একটা প্রতীক হিসেবে। আমি শুধু নাটকে দেখাতে চেয়েছি, যে দর্শন, যে সংস্কৃতির কথা বলা হয়েছে আমাদের ধর্মগ্রন্থ গুলোয়, সে সবই উচ্চবর্ণের স্বার্থ বহনকারী সংস্কৃতি। নিম্ন বর্ণের সমস্ত অধিকার খর্ব করার, নিম্ন বর্ণের লোকদের ওপর আধিপত্য কায়েম করার সংস্কৃতি। এটা আমি নতুন কী বললাম? অনেক ঐতিহাসিক, অনেক গবেষক এমন কথা লিখে গেছেন। আমি শুধু এই দর্শন, এই সংস্কৃতিকে একটা প্রতীকের মাধ্যমে ধরতে চেয়েছি। সেই প্রতীক হচ্ছে গেরুয়া। এখানেই তোমাদের কারসাজী। শুধু ধর্ম সংস্কৃতির নিন্দা করেই ক্ষান্ত হও নি, সরাসরি রাজনৈতিক কটাক্ষ করেছ আমাদের দলকে। সত্যেনদা, আমার নাটক আপনার পছন্দ না হতে পারে। তা নিয়ে যুক্তি দিন, তথ্য দিয়ে আলোচনা, সমালোচনা করুন। বাধা দেবেন কেন? বাধা দেব না তো। আমরা কেন বাধা দিতে যাব। তবে জনগণেরও অধিকার আছে প্রতিবাদ করার। সেটাই এখন হবে। শেষটা সামলিও।  
বীণা মোদক বসেছিল বিকেডির বাঁ পাশে। কলেজের বার্ষিক উৎসবে নাট্য পরিচালনার দায়িত্ব বীণা মোদকের ওপর। ও এবার বলে, সত্যেনদা, নাটকটা ছাত্ররাই করতে চেয়েছে। দীপেন্দুদা নাটকটা লিখেছে সত্যি, কিন্তু একবারের জন্যেও ছাত্রদের বলে নি এই নাটকটা কর। ওরা নাটকটা অন্য কোথাও দেখেছে, ওদের ভাল লেগেছে, করতে চেয়েছে, দীপেন্দুদা রাজী হয়েছেন। ব্যাস। আর আপনি তো জানেন, আপনাদের ছাত্ররা অন্য একটা নাটক করতে চেয়েছিল। শিবাজীকে নিয়ে। এটাও প্রচলিত নাটক। বহুবার মঞ্চস্থ হয়েছে। কিন্তু এরা অনেক জায়গায় মূল নাটক থেকে সরে গিয়ে এমন কিছু সাম্প্রদায়িক সংলাপ ঢুকিয়ে দিয়েছে, যে ওটা করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া এই কাজটাও করেছে অত্যন্ত কাঁচা হাতে। সত্যেন এবার বেশ ঝাঁঝ দেখিয়ে বলেন, নাটকে নতুনত্ব আনা কি অন্যায় কিছু? আগে করে নি কেউ? ছেলেরা কিছু কিছু জায়গায় মূল নাটক থেকে সরে গিয়ে নতুন নতুন সংলাপ ঢুকিয়েছে। একটা ফ্রেশনেস এনেছে। ব্যাস, ওতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল। বীণা মোদক এবার বলেন, আরেকটা নাটকও কিন্তু জমা পড়েছিল। সেটাও বিখ্যাত নাটক। গ্যালিলেওর জীবন নিয়ে। ওই নাটকে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাসের সংঘাতের কথা আছে। এটাও আজকের দিনে খুব রেলিভেন্ট। কিন্তু ছাত্ররা শেষ পর্যন্ত দীপেন্দুদার নাটকটাই বেশী পছন্দ করে। এটা তো বেশীর ভাগ ছাত্রের মত অনুযায়ী হচ্ছে। কয়েকজনের কথায় গুরুত্ব দিয়ে বেশীর ভাগের মতামতকে উপেক্ষা করি কি করে বলুন। দৃশ্যতই অসন্তুষ্ট সত্যেন চক্রবর্তী এবার বলেন, ঠিক আছে। যাদের মতামতকে গুরুত্ব দিলে না, এবার দেখো ওরা কি করতে পারে। বলেই সত্যেন চক্রবর্তী চেয়ার ছেড়ে উঠে বেরিয়ে যান। মৃদুলা কানুনগো বলে উঠলেন, এবার নিশ্চয়ই প্রিন্সিপালের কাছে গেলেন। আজকাল কথায় কথায় উনি প্রিন্সিপালের ভয় দেখান। প্রিন্সিপালও কী বুঝে কে জানে সত্যেনদাকে বেশ গুরুত্ব দিতে শুরু করেছেন।  
বীণা মোদক এবার দীপেন্দু সেনগুপ্তের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ তো রীতিমত হুমকি! একটা কিছু ঝামেলা পাকানো হবে দীপেন্দু দা। শেষ পর্যন্ত নাটকটা নামানো যাবে কি না কে জানে। দীপেন্দু সেনগুপ্ত নির্বিকার চিত্তে বলেন, তা হলে বাদ দিয়ে দাও। ওদের নাটকটাই করে ফেল। বীণা মোদক বললেন, মাথা খারাপ? তেমন হলে গ্যালিলেওর নাটকটাই করব। কিন্তু ওদের নাটক টা কোনও অবস্থাতেই নয়। বিকেডি টেনিস খেলা দেখার মত করে একবার ডানদিকে, একবার বাঁদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে সকলের সব কথা শুনে গেলেন শুধু। কথাগুলোর ভেতরে ঢুকলেন না।
পিরিয়ডের ঘণ্টা বাজতে বিকেডি বিমর্ষ মুখে উঠে ক্লাসের দিকে এগোলেন। তার সমস্যার কোনও সুরাহা আজ হল না। মন দিয়ে ক্লাস করলেন বিকেডি। ঘণ্টি বাজতে ক্লাস থেকে বেরিয়ে কমন রুমের দিকে এগোচ্ছেন, চোখে পড়ল প্রিন্সিপালের রুমের সামনে একটা ছোট খাটো জটলা। অতনু সাহাকে ঘিরে কয়েকজন অধ্যাপক। কৌতূহল নিয়ে বিকেডিও সেই জটলার পিছনে দাঁড়ান। অতনু সাহা বলে চলেছেন, বেলা এগারোটায় রওয়ানা দিয়ে বদরপুর পৌঁছতেই দেড়টা বেজে গেল। ভাবতে পারো? আধঘণ্টার পথ, তিরিশ কিলোমিটারও নয়। একজন জিজ্ঞেস করল, বদরপুর থেকেই ফিরে এল ওরা? আরে না। যদিও আশা করার কিছু ছিল না, তবু শিলচর গিয়ে মেডিকেল কলেজে ডাক্তার দেখিয়েছে। ডাক্তার দেখে বলল সব শেষ। সার্টিফিকেট লিখে দিল। বলল, ঘণ্টা খানেক আগে এলেও হয়তো কিছু করা যেত। বিকেডি ঠিক বুঝতে পারছিলেন না, কার কথা বলা হচ্ছে। পাশের অধ্যাপককে জিজ্ঞেস করলেন কার কী হয়েছে সুমন্ত? হিমাদ্রি-দা। কাল রাতে অসুস্থ হয়ে সিভিল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এখানে তো কোনও ব্যবস্থাই নেই। না ডাক্তার, না যন্ত্রপাতি, না কোনও পরীক্ষা নিরীক্ষা। সকাল হতেই বলল শিলচর নিয়ে যান। আর যেতে যেতেই রোগী শেষ। হিমাদ্রি-দা অসুস্থ, এ খবর বিকেডি জানতেন না। মারাই গেলেন? মনটা খারাপ হয়ে গেল বিকেডির। একমাথা পাকা চুল সহ হিমাদ্রি-দার চেহারাটা মনে পড়ল। বেশ হাসিখুশি লোক ছিলেন। পলিটিকাল সায়েন্স পড়াতেন।
বিকেলে অন্য অধ্যাপকদের সঙ্গে বিকেডিও গেলেন হিমাদ্রি শেখরের বাড়ি। মৃতদেহ নিয়ে গাড়িটা একটু আগেই এসে পৌঁছেছে। শ্মশানযাত্রার আয়োজন হচ্ছে। কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন সবাই। এর মধ্যে বীতশোককে চোখে পড়ল। বীতশোকও বাড়িতে অনেক ছাত্র পড়ায়। যদিও কোচিং সংক্রান্ত বিষয়ে ওর সাথে কখনই কথা বলেননি বিকেডি, আজ সমস্যায় পড়ে প্রথা ভাঙলেন। শোকসন্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেও একটু সুযোগ করে বীতশোককে আলাদা ডেকে নিয়ে নিজের সমস্যাটা খুলে বললেন। বীতশোক একটু আশ্চর্য হলেন। তাই নাকি। আমার কাছেও তো অনেক মুসলিম ছাত্র পড়ে। আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি এখনও। এরকম হলে তো সত্যিই সমস্যা হয়ে যাবে। নিজের সংকট বীতশোকের মধ্যেও কিছুটা ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন দেখে একটু যেন হাল্কা লাগল বিকেডির। বীতশোক এরপর অনেকটা সান্ত্বনার মত বলল, দেখো, হয়তো এটা ছুটকো ঝামেলা। মিটে যাবে। সন্ধ্যা পার করে সবাই বেরোলেন। বিকেডি হেঁটেই ফিরছিলেন। সারা শহর জুড়ে কারেন্ট নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজের গলিতে এসে সাবধানে পা ফেলেন বিকেডি। একটু বেকায়দায় পা পড়লে কেলেঙ্কারি হবে। পা মচকে যেতে পারে, ভাঙতেই বা কতক্ষণ। বিরক্ত লাগল বিকেডির। একটা জায়গা বটে, না আছে ভাল রাস্তাঘাট, না আছে আলো, না আছে জল, না ভাল চিকিৎসার ব্যবস্থা। একটা প্রতিবাদ করারও কেউ নেই। সাবধানে গলি পার হয়ে গেট খুলে বাড়ির দরজায় নক করলেন বিকেডি। ইনভার্টারের আলো জ্বলছে ঘরে। স্ত্রী এসে দরজা খুললেন।
ঘরে ঢুকে চোখে পড়ল, ডেস্কের ওপর দুটো ছোট ছোট কাগজ। লিফলেটের মত। জুতো খুলে ঘরে ঢোকার সময় লিফলেট দুটো উঠিয়ে নিলেন বিকেডি। ড্রয়িং রুমের সেন্টার টেবিলে রেখে বাথরুমে ঢুকলেন। ফিরে এসে চেয়ারে বসলেন। স্ত্রী চা এনে রেখেছেন। চায়ে চুমুক দিতে দিতে বিকেডি লিফলেট দুটো হাতে নিলেন। স্ত্রী বললেন, একটা দিয়ে গেছে সকালে যে ছেলেটা এসেছিল, বাচ্চা মত, ও। ছেলেটা বোধ হয় খারাপ নয়। বেশ আন্টি আন্টি করল। আর অন্যটা? বিকেডি প্রশ্ন করেন। পাড়ারই দুজন ভদ্রলোক এসেছিলেন। নাম জানি না। কাগজ দুটো পড়েন বিকেডি। একটিতে লিখেছে, গরুর মাংস ফেলে হিন্দুদের মন্দির অপবিত্র করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আগামী রবিবার শহরের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের একটা মিছিল বের করা হবে। সকলের উপস্থিতি প্রার্থনীয়। আর অন্যটাতে, ওই রবিবারই, শহরের শুভ-বুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের একটি ডেপুটেশন যাবে জেলা উপায়ুক্তর কাছে, রাস্তাঘাটের সংস্কার, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান ইত্যাদির দাবীতে। সবাইকে অনুরোধ, দলমত নির্বিশেষে এই কর্মসূচীতে যোগ দিন। বিকেডি দুটো কাগজই দলামচা করে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিলেন। চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দিয়ে স্ত্রীকে বললেন, দুটো ডাইজেস্টিভ বিস্কিট দাও তো!
______________
(একা এবং কয়েকজন, গুয়াহাটি, ডিসেম্বর ২০১৫)

বাঘ ও কুকুরের গল্প



বাঘ ও কুকুরের গল্প
-      মলয়কান্তি দে
কুকুরটা একেবারে বাঘের মতন গর্জায়।
ভয়ে ভয়ে মাথা তোলে বাঘুয়া। এত বড় তিনতলা বাড়িটার ঠিক কোন ঘরে যে এখন আছে কুকুরটা, ঠাহর করতে পারে না। এক একটা ডাক সোজা এসে ওর কলজেতে কামড় বসাচ্ছে। চাপা গরগরে ডাক, বুকের ভেতরটা ঝনঝনিয়ে ওঠে সেই ডাকে। একেক সময় যেমন মেঘ ডাকে, চাপা গুড়গুড় শব্দে লম্বা সময় ধরে, সেই শব্দে কানে তালা লাগে না কিন্তু বাড়িঘরের দরজা জানালা ঝনঝনিয়ে ওঠে, এ ঠিক সেই রকমের ডাককুকুরটাকে অনেকবারই দেখেছে বাঘুয়া। সারা শরীরে চকচকে কালো লোম, আকারে যেন প্রায় একটা পূর্ণবয়সের বাঘবাঘের মতই রাগী রাগী মুখটা সব সময় হাঁ করে থাকেগাঢ় লালরঙের পাতলা জিভখানা সারাক্ষণ ঝুলতে থাকে লকলক করে, দু পাশে ঝিলিক দেয় শাদা শাদা দাঁত। দেখলেই বুকের ভেতর কি যেন খামচা দিয়ে ধরে। বাঘুয়াকে দেখে কখনও তেড়ে আসে নি, কিন্তু কেমন একটা হেলাফেলার চোখে তাকায়। সে যে বাঘুয়া, এ বাড়ির বুড়ো কর্তার খাস পেয়ারের মানুষ, কত স্নেহ করেন বুড়ো কর্তা ওকে, কুকুরটা তবু তাকে একটুও রেয়াত করে নাআর আজতো মনে হচ্ছে কুকুরটার যত রাগ, যত গরগরানি, সব স্রেফ এই বাঘুয়ারই জন্যে। ছাড়া পেলেই ছুটে এসে ওর টুঁটি চেপে ধরবেভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে যায় বাঘুয়া।  
বেলা নিশ্চয় বারোটা হবেআকাশে খাড়া রোদগাছপালার নীচে ছায়ারা জড়োসড়ো হয়ে আছে। দু তিন জন লোক মিলে বাগানে সাফ সাফাইয়ের কাজ করছেকেউ কুটো কাটা সরাচ্ছে। কেউ ঘাস ছাঁটছে। অন্য দুজন গর্ত খুঁড়ছে, বাঁশের খুঁটি পোতা হবেওখানে ম্যারাপ বাঁধা হবেবাঘুয়া জানে, আর ক’দিন বাদেই বুড়ো কর্তার নাতির বিয়ে। আত্মীয় স্বজনে বাড়ি এখন ভরে আছেসকাল থেকেই নানা লোকের ব্যস্ত আনাগোনা চলছেএকজন লোক মাটিতে ইলেকট্রিকের তার ফেলে ফেলে এগিয়ে গেল একদিক থেকে আরেক দিকেতার পেছনে চলেছে মই হাতে আরেকজন। অন্য সময় হলে বাঘুয়া এখন সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াত, আগ্রহ নিয়ে সকলের কাজকর্ম দেখত। বাইরের লোকদের উপর একটু হম্বি তম্বিও করত। হাত চালাও, হাত চালাও। বসে আছো কেন? সে জানে এসব তার অধিকার। সে বুড়ো কর্তার খাস লোক। তার কথা হল বকলমে বুড়ো কর্তারই কথা। হুঁ হুঁ বাবা। বাঘুয়াকে ঘাটাতে এসো না।
কিন্তু আজ তার নিজেরই এমন অবস্থা, এই যে  বকুল গাছের চিলতে ছায়ায় গুটি সুটি মেরে বসে আছে বাঘুয়া, পাশ দিয়ে চলে যাওয়া লোকেরা তাকে যেন দেখেও দেখছে না।  বাঘুয়ার এই লাল-লাল, ফোলা-ফোলা, জল আটকে থাকা চোখদুটো, আর তার এই জবু থবু হয়ে বসে থাকা, এতেই যেন সকলের কাছে কিছু একটা বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে। বাঘুয়া ভয় পাওয়া জন্তুর বোবা দৃষ্টিতে জুলজুল করে দেখছে সবাইকেঅন্য সময় বাড়ির সবসময়ের কাজের লোকেরা বাঘুয়াকে দেখলে দু-একটা কথা বলত। ওরাও জানে বাঘুয়া খোদ বুড়ো কর্তার মানুষ। কিন্তু আজ ওরাও কিছু একটা বুঝে ওকে পাশ কাটাচ্ছেকত দিন ধরে বাঘুয়া মনে মনে হিসেব করেছে, আরেকটা মোচ্ছব হবে এ বাড়িতে। কত আমোদ করবে সে, ব্যান্ডপার্টির বাজনার সাথে নাচবে। কত খাওয়া দাওয়া হবেনতুন কাপড় পাবে। তারপর মোচ্ছব মিটে গেলে মন-ভরানো বকশিস! কিন্তু মাঝের থেকে কি যে হয়ে গেল। এই যে বেলা দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, কেউ জিজ্ঞেসও করে নি সে কিছু খেয়েছে কি না। অজান্তেই তার হাত চলে গিয়েছিল গালেঅনেকক্ষণ ধরেই গালে একটু জ্বালা করছেবাঘুয়া খেয়াল করে নি। এখন হাত ছোঁয়াতে জ্বালাটা টের পেল। হাত উল্টে দেখল বাঘুয়া, শুকিয়ে আসা একফোঁটা রক্ত। ছোট-দাদাবাবুর আঙটি পরা হাতের ঘুষি লেগেছিল গালে। হাড়ের ওপর। চামড়া চিরে  রক্ত বেরিয়েছে। দুই চোখে অনেক ক্ষণ ধরে লটকে থাকা দু ফোঁটা জল এবার যেন ছাড়া পেয়ে ওর কালো পাথুরে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।   
মাঝে মাঝেই বাঘুয়ার ভীরু চোখ চলে যাচ্ছে দোতলার বারান্দার দিকেবুড়ো কর্তা কখনও এসে এই দোতলার বারান্দায় দাঁড়ান। কখনও চেয়ার পেতে বসেন। কখনও দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ ফেলেন। আজ শুধু দেখল খুব ফর্সা, চশমা পরা একজন ছোকরা বাবুকে। মোবাইলে কার সাথে খুব হেসে হেসে কথা বলছে। বাঘুয়া বুঝতে পারে এটাই বুড়ো কর্তার নাতি। বড় নাতি। বড় দাদাবাবুর বড় ছেলে। এই নাতিরই বিয়ে  কত ছোট দেখেছিল বাঘুয়া আর এখন কত বড় হয়ে গেছে। একবারই দেখল শুধু। আর যখনই তাকিয়েছে, বারান্দা ফাঁকা। এমনিতে এ বাড়িতে লোকজন বলতে এক থাকেন বুড়ো কর্তা নিজে, আর থাকে পরিবার নিয়ে তার মেজো ছেলেতিন ছেলের বড় এবং ছোট - দুজনেই বউ বাচ্চা নিয়ে বাইরে থাকে। চাকরি করে। বেশ ভারি ভারি চাকরি তাদের। হাকিম গোছের কিছু হবে নিশ্চয়ই, বাঘুয়া অতো ভাল বলতে পারবে না। ছোট-দাদাবাবু দু-মাস তিন-মাসে বাড়ি আসে বউ বাচ্চাদের কথা বার্তা হাসির শব্দে সেই ক’দিন বাড়িতে একটু লোকজনের আওয়াজ পাওয়া যায়। বড়-দাদাবাবু আসেন সেই বছরে দু-বছরেঅনেক দূরে থাকেন বড়-দাদাবাবু, সেই দিল্লি-বোম্বাই। বড় দাদাবাবুকে চোখে পড়লো না বাঘুয়ার। বোধহয় আসেন নি এখনও, একেবারে বিয়ের দিন হিসেব করে আসবেন। ব্যস্ত মানুষ।
এই বড় দাদা আর ছোট দাদা বাইরে থাকলে বাড়িটা একেবারে নিরিবিলি হয়ে যায়গিন্নি-মা মারা গেছেন অনেক বছর হয়ে গেল। বুড়ো কর্তার দেখভালের আলাদা লোক আছে। চা-বাগানের কাজকর্ম কিছুই এখন বুড়ো কর্তা দেখেন না। সেসব এখন মেজো-দাদাবাবুর হাতেমেজো-দাদাবাবুর আরও নানা ব্যবসা আছে। বাঘুয়া সব জানে না। মেজো-দাদাবাবুর কাছে নানা কাজে নানা লোক আসে দিন ভর। বাঘুয়া তাদের চা-বাগানে কানাঘুষোয় একটা কথা শুনেছে এবারমেজো দাদা না কি এবার ইলেকশনে দাঁড়াচ্ছেন। এমেলে হবেন। বাগানের কেউ কেউ তাকেও জিজ্ঞেস করেছে, তু জানিস নাই? জানে না বাঘুয়া। তবে না জানলেও সে জানার মত করেই মাথা নেড়েছে। এবং বলেছে, সময় আসুক, বলব সবসন্ধ্যাবেলা অবশ্য মেজো-দাদাবাবু বড় একটা বাড়িতে থাকেন না। গাড়ি করে বেরিয়ে যান। কখনও বউ ছেলে মেয়ে সঙ্গে যায়। কখনও একা। সঙ্গে থাকে মেজো-দাদাবাবুর এই প্রিয় কুকুরটা।
সন্ধ্যাবেলা বাড়ির নীচের তলার বড় হলঘরটায় বড় বড় আলো জ্বলে। তখন বুড়ো কর্তার কাছে আসেন শহরের নানা মান্য গণ্য লোকবুড়ো কর্তাকে শহরের লোকেরা খুব মান্যি করে। খুব ধর্ম-কর্ম করেন বুড়ো কর্তা। মাঝে মাঝে নামঘরে যান। সভা-সমিতিতে যান। বুড়ো কর্তাকে লোকেরা গোহাইঁদেউ বলে ডাকে, শুনেছে বাঘুয়া। কিছু বলতে গেলে বলে গোহাইঁ মানু। শুনে শুনে বাঘুয়াও বলতে চেষ্টা করেছিল। তার ঠিক আসে না। সে বুড়ো কর্তাই বলে। বয়স হয়ে বুড়ো কর্তার চেহারা যেন আরও খুলেছে। ছোটবেলায় দেখা সেই কোট প্যান্ট পরা পাক্কা বিলিতি সাহেবটি আর নেইএখন তার রুপোলী চুল ঢেউ খেলিয়ে ঘাড় অবধি নেমেছে, ধবধবে ফর্সা মুখ, রোদ পড়লে একটু লালচে দেখায়শাদা ধুতি আর শাদা পাঞ্জাবিতে তাকে যে কী অপরূপ দেখায়। ঠিক যেন ভগবানের মত।
সেই ভগবানকে একটি বার দেখার জন্যেই সকাল থেকে বাঘুয়ার ভাষাহীন চোখ দুটো চঞ্চল হয়ে আছে। কতবারই সে ভেবেছে, এই বুঝি দোতলার বারান্দায় হাসি মুখে এসে দাঁড়াবেন বুড়ো কর্তা। প্রশান্ত দৃষ্টিতে তাকাবেন বাড়ির চারদিকে।  আর অমনি বাঘুয়া ছুটে যাবে সামনের উঠোনে, যাতে বুড়ো কর্তার নজরে আসে বুড়ো কর্তাকে সে বলবে সব কথা। পুঁছবে, কেন ছোট দাদাবাবু তাকে মারল। কি দোষ করল সে। আর দোষ যদি কিছু করেছে তো বুড়ো কর্তা নিজের হাতে শাস্তি দেবেন। জুতো মারবেন দরকার হলে। কিন্তু এই ছোট দাদাবাবু, ছোটবেলা কত কোলে তুলেছে বাঘুয়া, কত বল খেলেছে, বাঘ সেজে কতবার ছোট দাদাবাবুর নকল বন্দুকের গুলি খেয়ে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়েছে বাগানের ঘাসে, সেই ছোট-দাদাবাবু ওর গায়ে হাত তুলল? ওকে ঘুষি মারলো?
মনে খুব লেগেছে বাঘুয়ার। অভিমানে বুকে মোচড় দিচ্ছেকিন্তু এই অভিমান স্পষ্ট কোনও দিশা পাচ্ছে না কারণ নিজেকে নির্দোষ ভাবার তার কোনও উপায় নেই। ট্রেনের দুলুনিতে শেষ রাতের দিকে তার ঘুম এসে গিয়েছিল। সেই সময় কে তার বুকে আঁকড়ে থাকা চটের ব্যাগের ভেতর থেকে কাগজে মোড়া, রশি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা প্যাকেটটা হাপিশ করে দিয়েছে সে টেরও পায় নি। এটাই তো তার দোষ। সে তো না বলতে পারবে না। ছোট-দাদাবাবু এত করে বলে দিয়েছিল, খুব সাবধানে নিয়ে যাবি। খুব দরকারি জিনিষ আছে এতে। বুড়ো কর্তার জন্যে জড়িবুটির ওষুধ। ট্রেনের জেনারেল কামরায় ওর জন্যে সীটের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ছোটবাবুর অফিসের লোক। কোয়ার্টার থেকে বেরোবার সময় ছোট-দাদাবাবু নিজে ওর হাতে তুলে দিয়েছিল চটের ব্যাগ। তার ভেতরে ছিল কাগজের প্যাকেট। বলেছিল সে-ও আসবে ওই একই গাড়িতে, তবে অন্য কামরায়। এমন কি রাতে একবার যখন কি জানি কোন এক ষ্টেশনে গাড়ি থামলে পরে ছোট-দাদাবাবু জানলা দিয়ে কাগজের ঠোঙায় করে পুরি সবজি দিয়ে গেল, তখনও তো সে সেই একই ভাবে চটের ব্যাগটা বুকে আঁকড়ে ছিল। পুরি সবজি খেয়ে হাত ধোবার জন্যেও উঠে যায় নি। কাগজে হাত মুছে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছে। জলতেষ্টা পেলে জল খেতেও যায় নি। কাঠের বেঞ্চে বসে কামরার নানা লোকের নানা কথা শুনতে শুনতে দিব্যি জেগে ছিল সে। তারপর এক সময় রাত গভীর হল। কামরায় লোকজনের ওঠা নামা কমে এলোচারদিকে বসে বসে ঢুলতে থাকা যাত্রীরা কেউ কেউ ঘুমিয়ে এ ওর গায়ে হেলে পড়ছিল, এসব দেখল বাঘুয়া। কেউ কেউ শুয়েও পড়েছে কামরার মেঝেতে। কোথাও গাড়ি থামলে বাইরে কারা ছুটে ছুটে যাচ্ছে, রাতজাগা ভারী গলার ব্যস্ত কথা বার্তার টুকরো কানে এসেছে। তারপর একসময় শেষ রাতের ঠাণ্ডা হাওয়া এসে গায়ে লাগলে বেশ আরাম হচ্ছিল তার। কখন যে ঘুমে ঢলে পড়েছিল, বুঝতেই পারে নি।
জাগল যখন তখন চারদিক বেশ ফরসা। জেগেই সে দেখে তার কোলের কাছে নেতিয়ে পড়ে আছে চটের ব্যাগ। ভেতরের কাগজের প্যাকেটটা নেইআঁতকে উঠেছিল বাঘুয়াপ্রায় চিৎকার দিয়ে বলেছিল, প্যাকেটটো কোথা গেল? শুনে আশপাশের লোকজন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালএকজন ভালমানুষের মত মুখ করে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে? আরে, প্যাকেট ছিল। এই ব্যাগের ভিতরে প্যাকেট ছিল একটাকোথা  গেল? লোকজন অবাক চোখে ওর দিকে তাকালএকজন বলল, কি ছিল প্যাকেটে? দরব ছিল আইজ্ঞা, জড়িবুটির দাওয়াই ছিল। হামার বুড়া বাবার ওষুধ। বাঘুয়ার গলাটা কান্না কান্না শোনাল। সন্দেহের চোখে ও চারপাশের লোকজনের দিকে তাকালসবাইকেই কেমন ভাল মানুষ ভাল মানুষ দেখাচ্ছে। আবার মনে হচ্ছে এরাই কেউ ওর ঘুমের মধ্যে ব্যাগটা সরিয়ে এখন ভাল মানুষ সেজে চোখ পিটপিট করছে। না কি অন্য কেউ প্যাকেট সরিয়ে নেমে পড়েছে কোনও রাতের স্টেশনে! কিছুই বুঝতে না পেরে বাঘুয়া বেঞ্চের তলা, ওপরের বাঙ্ক তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে। তার মন বলে এক্ষুণি ছোট-দাদাবাবুকে খবরটা দেওয়া দরকার কিন্তু কোথায় খুঁজে পাবে ছোট-দাদাবাবুকে। ছোট-দাদাবাবু এই ট্রেনেই আছে, অন্য কামরায়উঁচা কামরা সেটা। বাঘুয়া জানে না সে কেমন কামরা। সে কি পারবে খুঁজে বের করতে? অসহায় ভাবে সে পাশের লোকটির দিকে তাকায়। সেই লোক বলে, তোমার সঙ্গে কে একজন আছে না, যে তোমাকে রাতে খাবার দিয়ে গেল! যেন ছোট-দাদাবাবুর কাছে পৌঁছবার একটা রাস্তা খুঁজে পাবে, এমনি আগ্রহ নিয়ে সে বলে ওঠে, হামার ছোট-দাদাবাবু। বুঢ়া বাবার ছোট ব্যাটা। এই গাড়িতেই আছে। ওপাশ থেকে অন্য একজন বলে ওঠে, আচ্ছা ভাই, তোমার ছোট দাদাবাবু এই একই ট্রেনে আসছে তো ওর বাবার ওষুধ তোমার হাতে দিল কেন? নিজেই তো সঙ্গে নিতে পারত! এই প্রশ্নের উত্তর বাঘুয়ার জানা নেইওর মনেও আসে নি এমন প্রশ্ন। কাজের কথায় আবার উল্টে প্রশ্ন করা যায় না কি? কাজ তো যা বলে দেয় সেটাই করতে হয়। কেন করবে, করে কী হবে, সে প্রশ্ন কি করে কেউ? আর সব চেয়ে বড় কথা, বুড়ো কর্তার কাজ – এটা শুনলে তো আর কিছুই জিজ্ঞেস করার থাকে না। লোকটির কথার উত্তরে কিছুই বলতে পারে না সে। আরও যে দু চারজন ঘাড় ঘুরিয়ে এই কথাবার্তা শুনছিল, তাদের একজন তার সঙ্গের লোকটির দিকে তাকিয়ে কেমন রহস্যময় চোখ ঠারে। বাঘুয়ার নজরে পড়ে সেই চোখ ঠারাঠারি। বুঝলি কিছু? তারপর গলা নামিয়ে দুজনে খুব ফিসফাস করে। অন্যজন বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ে। বাঘুয়া কিছুই বুঝতে পারে না। সে শুধু ছোট-দাদাবাবুর সঙ্গে দেখা হলে কী বলবে সেটাই ভাবতে থাকে।
ট্রেনখানা যেন জোর পাচ্ছে না চলতে। ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চলছে। বাঘুয়া আর অন্য কারুর দিকে তাকায় না। নিজের ভাবনায় ডুবে যায়। তার অভিব্যাক্তিহীন চেহারায় সেই ভাবনার কোনও ছাপ ফোটে না। সেই যারা ঠারে ঠোরে কথা বলে ছিল, তাদেরই একজন এবার ওকে বলে, তোমার ছোট দাদাবাবু কী করে। চাকরি করে আইজ্ঞা। হাকিমের চাকরি। ওরা আবার নিজেদের মধ্যে কথা শুরু করে। এবার আর তেমন ফিস ফাস নয়। কিছু কথা কানেও আসে বাঘুয়ার।
... দু-নম্বরি পয়সা। অনেকেই এভাবে পাঠায়।  
... কেউ টের পেয়ে টার্গেট করেছিল, বুঝলি? সুযোগ বুঝে হাতিয়ে নিয়েছে।
... ওদের না কি এরিয়া ভাগ করা থাকে, শুনেছিনিজের এরিয়ার মধ্যে কাজ সারতে না পারলে অন্য এরিয়ার লোকদের কাছে খবরটা বেচে দেয়।
... এই ব্যাটা বোধ হয় ডিফু-তে এসে বিক্রি হয়ে গেছে। না-কি ডিমাপুরে, কে জানে।
...
কথাগুলো কানে আসে, কিন্তু তার বার্তা কিছুই বোধগম্য হয় না বাঘুয়ার। কে বিক্রি হল, কি করে বিক্রি হল, কিছুই বুঝতে না পেরে শূন্য চটের থলিটাকেই আগের মত যত্নে আঁকড়ে ধরে সে বাইরের দিকে তাকায়। ছোট-দাদাবাবু বলেছিল সকাল নাগাদ মরিয়ানিতে এসে গাড়ি ঢুকবে, ছোট দাদাবাবুকে জানালায় দেখতে পেলেই ও যেন গাড়ি থেকে নেমে আসে। মুখের ভেতরটা তেতো লাগছে। কেমন যেন হাত পা চলছে না বাঘুয়ার। তার মনে হয় মরিয়ানি ষ্টেশনে এসে ছোট দাদাবাবুকে দেখে ও নামতেই পারবে না। দাঁড়াতেই পারবে না বোধ হয়। গাড়িটা যে কখন মরিয়ানি ঢুকবে।
কামরা থেকে নামতে যেতেই ছোট-দাদাবাবুর চোখ পড়ল চটের থলির দিকে। এ কি? প্যাকেট কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে কোনও উত্তর দিতে পারে না বাঘুয়া। পুরোপুরি নামেও নি সে ট্রেন থেকে। অসহায় দৃষ্টি মেলে ছোট-দাদাবাবুর দিকে তাকিয়ে ছিল। পেছনের লোকের ধাক্কা খেয়ে এখন একেবারে দাদাবাবুর মুখোমুখি। - আইজ্ঞা, চুরি হইয়ে গেল। কী? এত জোরে আওয়াজ করল ছোট দাদাবাবু, আর তার সাথে বাঘুয়ার শার্টের কলারের দু পাশে ধরে এমন জোরে ঝাঁকানি দিল যে, বাঘুয়া পড়েই যাচ্ছিল প্রায়। অনেকটা যেন ঝুলে রইল তার কলারের ফাঁসে। চারদিকের চলমান ভিড় থেকে কেউ কেউ ঘুরে তাকাচ্ছে তাদের দিকে। দু এক জন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। টনক নড়ে ছোট দাদাবাবুর। যেন অনেক কিছু  একসাথে বলতে গিয়ে সব কথা গিলে ফেলল ছোট-দাদাবাবু। চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যেন আগুন গিলে বসে আছে। হিসহিসে গলায় বলল, চল্‌, বাড়ি চল্‌। একটু পরে আবার সামান্য গলা তুলে বলল, এত কষ্ট করে জঙ্গল খুঁজে খুঁজে জোগাড় হয়েছিল জড়িবুটির ওষুধ। তুই এভাবে হারিয়ে ফেললি? দাদাবাবুর গলা কি একটু নরম শোনাল? কিছু একটা ভরসায় ও দাদাবাবুর পেছন পেছন হাঁটে। ষ্টেশনের বাইরে ওদের জীপগাড়ি খানা। মেজো-দাদাবাবু এই গাড়ি করেই বাগানে যান। বাঘুয়া গিয়ে জীপের পেছনে ওঠে। ছোট-দাদাবাবু গাড়ি স্টার্ট দেয়যোরহাটের বাড়ি অবধি গাড়িখানা এত জোরে চালায় যে পিছনের সীটে বসে বারবার এদিক ওদিক হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল বাঘুয়া। গেটের ভিতরে এসে গাড়ি থামে। গাড়ি থেকে নামতে ভয় পাচ্ছিল বাঘুয়া। ছোট-দাদাবাবু আবার তার কলার ধরে টেনে হিঁচড়ে নামায় ওকেটানতে টানতে নিয়ে যায় নীচের তলার বারান্দার পাশের ঘরখানায়।  তারপর দরজা বন্ধ করে দেয়   
ঘরের ভেতর একটা সোফায় বসে ছিল মেজো-দাদাবাবু। এভাবে ওদের ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়ায়কী হয়েছে?
ছোট-দাদাবাবু উত্তর না দিয়ে ওকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলার মত করে ছুঁড়ে দেয়টাল সামলাতে না পেরে বাঘুয়া মাটিতে উবু হয়ে বসে পড়লতারপর যা তাকে জীবনে করতে হয় নি কখনও, কিন্তু যা তার রক্তের ভেতর ছিল, সেই রক্ত-বাহিত অভ্যাসে দু-হাত জোড় করে কান্না কান্না গলায় বলে উঠে, হামি কিছু জানি না দাদাবাবু।
-      তুই জানিস না কিছু? বল কাকে দিয়েছিস।
-      আইজ্ঞা শেষ রাইতে চোখ লেগে গেল আর...
কথা শেষ করতে পারে না বাঘুয়া। কলার টেনে তাকে দাঁড় করিয়েই মুখে ঘুষি চালিয়ে দেয় ছোট দাদাবাবু। হাউ হাউ করে ডুকরে কেঁদে ওঠে বাঘুয়া। মেজো দাদাবাবু এবার ব্যস্ত হয়, আস্তে, আস্তে। এখন আর কেলেঙ্কারি বাঁধাস না।  
 ঘুষি খেয়ে মেঝেতে বসে পড়ে বাঘুয়া। কান্না কান্না মুখে দু ভাইয়ের মুখের দিকে নির্বোধ দৃষ্টি মেলে তাকাতে থাকে। মেজো-দাদাবাবু জিজ্ঞেস করল, কত ছিল? ছোট দাদাবাবু উত্তর না দিয়ে পলকহীন চোখে তাকাল মেজো দাদাবাবুর দিকে। তাকিয়েই থাকল। মেজো দাদাবাবুও তাকিয়ে ছিল ভাইয়ের চোখে। এক সময় চোখ সরিয়ে বাঘুয়ার দিকে তাকালো ছোট-দাদাবাবু বলে, আমার হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। গাধাটাকে বিশ্বাস করে এমন ভুল হল!
-      মেজো-দাদাবাবুর মুখ থমথম করছে। চাপা গলায় বলে, ইলেকশনে কী হবে তা হলে?
-      আর ইলেকশন। আমার যে কী গেল সে আমিই জানি।   
-      গেল তো আমার। দরকার তো আমারই ছিল।
ছোট-দাদাবাবু রেগে উঠে কি বলতে যেতেই মেজো দাদাবাবু বলে উঠল, এই শোন, আগে এটাকে বের কর। বাজারে ঢোল পেটাস না।
তারপর নিজেই বাঘুয়াকে ধরে দাঁড় করিয়ে বলেন, তুই বাইরে যা তো এখন। সাবধান, কোথাও যাবি না কিন্তু। বাড়িতেই থাকবি। না পেলে পুলিশ ডাকব।
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে এখানে কিছুক্ষণ, ওখানে কিছুক্ষণ, এভাবে নানা জায়গায় বসে থেকে থেকে রোদ চড়া হতে বাঘুয়া এসে আশ্রয় নিয়েছে এই বকুল গাছের তলায়। তখনই কুকুরটার ডাক শুনতে পেয়েছিল। আর এই প্রথম কুকুরটাকে ভয় করতে থাকে তার। জীপগাড়িখানা ঢোকার সময় বাগানের মালী গেট খুলে দিয়েছিল। সে দেখেছে ছোট-দাদাবাবু কি ভাবে বাঘুয়াকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে ঘরে ঢোকালোবেরিয়ে আসার পর মালিটাকে আর চোখে পড়ে নি বাঘুয়ার। তবে ওর থেকেই কথাটা পাঁচকান হয়েছে নিশ্চয়। তাই অন্য কাজের লোকেরাও বাঘুয়ার কাছে ভিড়ছে না। আনমনে আবার গালে হাত বোলায় বাঘুয়া। পেটের ভুকটা এখন খুব জানান দিচ্ছে।   
কুকুরটা আবারও ডাকছেআর সেই দাকের সঙ্গে এবার বাঘুয়ার মনে ছোট-দাদাবাবুর চেহারাটাই  ভেসে উঠলছোট-দাদাবাবুর রেগে ওঠা মুখটা যেন কুকুরের মুখের সাথে মিলে যাচ্ছে। চাপা স্বরের কথাগুলো যেন কুকুরটার গরগরানি। কানে আছড়ে পড়ছে কুকুরের ডাক, আর চোখ বন্ধ করে বাঘুয়া দেখতে পাচ্ছে ছোট-দাদাবাবুকেপেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে মেজো-দাদাবাবু।  
ট্রেনের সেই লোকটির কথা মনে পড়ে যায় তার। তোমার ছোট দাদা-ই তো ওষুধটা সঙ্গে নিয়ে আসতে পারত। যেন নিজের স্বপক্ষে একটা যুক্তি খুঁজে পায় বাঘুয়া। ঠিকই তো। এত কষ্ট করে জোগাড় করা ওষুধ ছোট দাদাবাবু কেন নিজের কাছেই রাখল না? যেন বুড়ো কর্তাকে পেলে এ নিয়েই নালিশ জানাবে বাঘুয়া। তার দোষ কোথায়, দোষ তো সব ছোট-দাদাবাবুর। ভেবে মনটা একটু শান্ত হয় বাঘুয়ার। বেলা ঢলে পড়েছে পশ্চিমেশরীরটা ঝিমিয়ে আসছে। গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়েই পড়েছিল বাঘুয়া।  
-      আরে বাঘ বাহাদুর যে!  
পরিচিত গলার আওয়াজে ঘুমের চটকা কেটে যেতে চোখ খুলে এদিক ওদিক তাকায় বাঘুয়া। আর তখনি যাকে সামনে দেখে, তাকে দেখে আনন্দে আপ্লুত হয় সে। জামাই-দাদাবাবু! তার মানে কলকাত্তার দিদিরা এসে গেলেন? কখন এলেন? এই আমুদে লোকটাকে দেখলে সব সময়ই আনন্দ পায় বাঘুয়া। সমস্ত দুঃখ কষ্ট সরে গিয়ে তার মুখের শক্ত, রেখা-বহুল চামড়ায়, তার ঘোলাটে চোখ দুটোয় খুশি ঝিলিক দিল। এগিয়ে গেল সে জামাই-দাদাবাবুর দিকে। একটাই শব্দ উচ্চারণ করতে পারল, আইজ্ঞা!
-      কেমন আছো, বাঘ বাহাদুর?
উত্তরে কিছু একটা বলতে গিয়েও শব্দ যোগায় না বাঘুয়ার মুখেমাথাখানা প্রবলভাবে এপাশ ওপাশ ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দেয়, ভাল আছে। জামাই-দাদাবাবুর টুকটাক কথার উত্তরে শরীরটা নানা ভাবে দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে তার ভাব প্রকাশ করে। যেন শরীরের এই সব ভঙ্গীই তার ভাষা। তখন তার মনেও পড়ল না সকাল থেকে যা হয়ে গেছে তার সঙ্গে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু কি বুঝল জামাই দাদা?
-      কি হয়েছে তোমার বল তো? গালের ওপর রক্ত শুকিয়ে আছে, মুখটাও কেমন শুকনো দেখাচ্ছে?   
বাঘুয়ার মনে হল ও কেঁদেই ফেলবে। নানাভাবে মাথা নাড়িয়ে বোঝাতে চাইল, কিছুই হয় নি। জামাই দাদা কি বুঝল কে জানে। তার মুখে চিন্তার ছায়াটা জেগেই রইল।
-      ঠিক আছে। ভালো থাকলেই ভালো।
পাজামা পাঞ্জাবি পরা জামাই দাদা চলে গেল বাগানের অন্য দিকে। ঘরে বেশীক্ষণ থাকে না জামাই-দাদাবেরিয়ে যায় এদিকে সেদিকে। এমন কি বাড়ির গাড়িটাও চড়তে চায় না। রিক্সা নিয়ে বেরোয়। বুড়ো কর্তার একমাত্র মেয়েটি, পড়তে গিয়েছিল দিল্লি না কোথায়। সেখানে এই দাদার সাথে পরিচয়। ভাব হয়ে যায় দুজনের মধ্যে। তারপর বিয়ে। জামাই-দাদাবাবুটি ঠিক এ বাড়ির লোকের মত নয়। কেমন যেন কাছের মানুষ বলে মনে হয়। কানাঘুষোয় শুনেছে বাঘুয়া, এই বিয়েতে বুড়ো কর্তার মত ছিল না। এদের মতো বড়লোক নয় জামাই-দাদার পরিবার। সেই জন্যেই বোধ হয় এর ব্যবহারে ঠাট-বাট কমবাঘুয়া ভাবে।  
বাঘ বাহাদুর। এই নামে আর কেউ ওকে ডাকে না। বাঘুয়া নামটা অবশ্য টিকে গেছে। সেটাও তো তার পাওয়া নাম। সেই কবে ছোকরা বয়সে একটা বাঘ মেরে ফেলেছিল সে। সেই থেকে তার মা-বাপের দেওয়া নামে আর কেউ ডাকে না ওকে। সে হয়ে গেল বাঘুয়া। ইনাম দিয়েছিলেন বুড়োকর্তা। তখন তো আর বুড়োকর্তা বুড়ো ছিলেন না, বাঘুয়ারা বলত মালিক বাবা। তাকে বানিয়েছিলেন নিজের খাস লোক। এমনিতে বাগানের নিত্যকার কাজ যা আছে তা করত, তবে মালিক বাবা বাগানে এলে বাঘুয়ার কাজ ছিল সব সময় তার কাছে কাছে থাকা। ভিড় জমলে সে একা হাতে ভিড় সামলাতো। কাউকে মালিক বাবার কাছে ঘেঁষতে দিত না। মালিক বাবা বসতে চাইলে চেয়ার এগিয়ে দিত। গাড়িতে উঠবেন তো দরজা খুলে দিত। এমন কি মালিক বাবা কাছাকাছি অন্য বাগানে গেলেও বাঘুয়ার ডাক পড়ত। সব বাগানের লেবারদের মধ্যেই ছড়িয়ে গিয়েছিল তার বাঘ মারার গৌরবগাঁথাসেটা বেশ কাজে লাগত এই ভিড় নিয়ন্ত্রণে। লেবাররা সমীহ করতে শিখেছিল তাকে। আস্তে আস্তে মালিক বাবার বয়স হয়ে গেলে বাগানে আর বেশী আসতেন নাতখনও মাঝে মাঝে তার ডাক পড়ত যোরহাটের বাড়িতে। বাগান থেকে সাইকেল চালিয়ে গিয়ে হাজির হত বাঘুয়া। আজকাল তেমন আর ডাক পড়ে না। তবু মাঝে মাঝে সে নিজে থেকেই গিয়ে হাজির হয়। একবার বুড়ো কর্তার সঙ্গে দেখা হলে, বুড়োকর্তার দু একটা কথা শুনলে তার মন ভাল হয়। এবারও ডাক পড়েছিলএসে শুনল, বুড়োকর্তা নয়, এবার ডেকে পাঠিয়েছে ছোট-দাদাবাবু। তারপর তো ছোট-দাদাবাবুর সঙ্গে তার কাজের জায়গায় যাওয়া। আর এই ট্রেনে করে ফিরে আসা। আর এই ফিরে আসার পথে অতো বড়ো একটা কাণ্ড ঘটে যাওয়া। বড় একটা শ্বাস ফেলে বাঘুয়া। জামাই-দাদাবাবুর সঙ্গে দেখা হতে মনটা যেমন হাল্কা হয়ে গিয়েছিল, এখন আবার বুক খানা ভারী হয়ে যায়। বিয়ের পরে এ বাড়িতে এসে জামাই-দাদা কারও কাছ থেকে শুনে ছিল তার বাঘ মারার বৃত্তান্তসেই থেকে নাম দিয়েছে, বাঘ বাহাদুর। একমাত্র জামাই-দাদাই এখনও মনে করিয়ে দেয় তার বাঘ মারার ইতিহাসবাকিরা তো বোধ হয় ভুলেই গেছে। এমনকি বুড়ো কর্তারও কি মনে আছে, সে যে একদিন একটা বাঘ মেরেছিল, সে যে বাঘুয়া! শরীরটা আর টানতে পারছে না সে। ইচ্ছে করছে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় বলে আবার বকুলের গোড়ায় পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করল বাঘুয়া।
-      এই বাঘুয়া, তোকে ছোট দাদাবাবু ডাকছে।
ডাক শুনে যখন চোখ খুলল বাঘুয়া, তখন বেলা পড়ে গেছে। ছায়া নেমেছে চারদিকে। শুধু বাড়ির পেছন দিককার একটা উঁচু গাছের মগডালে হাল্কা রোদ লেগে রয়েছে তখনওতড়াক করে উঠে দাঁড়াল সে। পা বাড়াতে গিয়েই আবার তার ভয়টা ফিরে এলোআবার মারবে ছোট-দাদাবাবু? ভয়ে ভয়ে পা ফেলে  আবার সে সেই বারান্দার লাগোয়া ঘরটাতে ঢোকে। দুটো আলাদা সোফাতে ছোট ও মেজো দাদাবাবু বসে আছেকেউই কোনও কথা বলল না। বাঘুয়া পালাক্রমে দুজনের দিকেই তাকায়। কী করবে বুঝতে পারে না। তারপর এক সময় মেজো-দাদাবাবুই বলেন,
-      সত্যি করে বল, কারা সরিয়েছে প্যাকেট।
-      আইজ্ঞা, হামি কিছু জানি নাই। ঘুম আসে গেল চোখে, আর কুছু নাই জানলাম।
ছোট-দাদাবাবু সোফা ছেড়ে উঠে আসে মারমুখো হয়ে। আর কুকুরটার কথা মনে করে বাঘুয়া দু হাত বুকে এনে জড়ো করে।  
-      তুই জানিস, আমার কত বড় সর্বনাশ করে দিলি? শালা জানোয়ার! 
আবার কান্না পেয়ে যায় বাঘুয়ার। বলতে ইচ্ছে করে, ওতো দামের ওষুধ আপনি কেন নিজের কাছে রেখে দিলেন না দাদাবাবু? বলা হয় না। ভাষা যোগায় না মুখে। হাউ মাউ করে কিছু একটা বলে যার একটি বর্ণও বোধগম্য হয় না। মেজো-দাদাবাবু এবার বলে, শোন, তুই বাগানে চলে যা। কারো সাথে কোনও কথা বলবি না। যখন খবর দেব, চলে আসবি। মনে রাখিস, এটা কিন্তু পুলিশ কেস। বাধ্য ছেলের মত মাথা নাড়ে বাঘুয়া। মেজো-দাদাবাবু দরজা খুলে দেয়। আর সারা দিন যাকে এক ঝলক দেখার জন্যে বাঘুয়ার প্রাণ আঁকু পাঁকু করছিল, সেই বুড়ো কর্তা কি না একেবারে দরজার সামনে! বুড়ো কর্তা খোলা দরজা দিয়ে এক পলক দেখলেন জবু থবু হয়ে থাকা বাঘুয়াকে, আর তারপর ছোট ও মেজো দুই ভাইকে দেখলেন। দুই ভাইয়ের কেউই সরাসরি বাবার দিকে তাকাচ্ছিলো না। অন্য দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পাথরের মত দাঁড়িয়ে ছিল।  বাঘুয়া তার কান্না কান্না চোখে একবার বুড়ো কর্তাকে আর একবার দুই ভাইকে দেখছিল। তার ইচ্ছে হচ্ছিল এক্ষুণি গিয়ে বুড়ো কর্তার পায়ের কাছে পড়ে। কিন্তু দুই ভাইয়ের উপস্থিতিতে সেরকম সাহস হল না। বুড়ো কর্তা কি বুঝলেন কে জানে, যা বুঝলেন তা নিজের মধ্যেই রেখে স্বাভাবিক ধীর পায়ে বারান্দা থেকে নামলেন 
একটু ক্ষণ অপেক্ষা করে মেজো-দাদাবাবু বাঘুয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, এবার যা। বাঘুয়া পায়ে পায়ে ঘর থেকে বেরোয়। বারান্দা থেকে উঠোনে নামে। তার পর ভীরু পায়ে গেটের দিকে এগোয়। তার পেছনে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। এতক্ষণে গেটের দু পাশে দুটো শাদা আলোর ডোম জ্বলে উঠেছে। শুভ্র আলো ছড়াচ্ছে সেগুলো থেকে। মন ভালো করা আলো। গেটের দিকে এগোতেই বাঘুয়ার নজর পড়ে, সামনে বুড়ো কর্তা। সেই শাদা ধুতি পাঞ্জাবি, ফর্সা পায়ে দামী চকচকে চামড়ার জুতো, সেই ঘাড় পর্যন্ত লম্বা কোঁকড়ানো রুপোলী চুল, সেই ভগবানের মত চেহারা। আর কিছু ভাবতে পারে না বাঘুয়া। ছুটে গিয়ে বুড়োকর্তার সামনে মাটিতে বসে পড়ে। আবারও সে অনেক কিছু বলার চেষ্টা করে। তার সব শব্দ জট পাকিয়ে দুর্বোধ্য কিছু আওয়াজ বেরোতে থাকে মুখ দিয়ে। তার দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন বুড়ো কর্তা। কি যেন ভাবেন মনে মনে। তার দুই চোখে এবং মুখের চামড়ায় করুণা ও প্রশান্তির ছাঁচ অটুটএকটু সময় তাকিয়ে থাকেন বাঘুয়ার ্দিকে। তারপর আবার চোখ তুলে তাকান সেই ঘড়টার দিকে, যেখানে দুই ছেলের সঙ্গে বাঘুয়াকে দেখেছিলেন একটু আগে। তারপর বাঘুয়াকে পাশ কাটিয়ে পা বাড়ান। তার মুখে অম্লান থাকে করুণা ও প্রশান্তি। তাঁর চলে যাওয়া ফর্সা পা দুটির দিকে তাকিয়ে বাঘুয়া তখনও তার সেই দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বলেই চলেছেভগবান ফিরে তাকালেন না 
দোতলার জানালা দিয়ে গোটা দৃশ্যটি দেখছিল জামাই-দাদা চাপা উচ্চারণে বলে ওঠে, - বাঘটা শালা কুকুরের মত কুঁই কুঁই করছে দেখো
 (উজান, তিনসুকিয়া, ২০১৫)